মুক্তগদ্য

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন এপ্রিল-মে-জুন ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

আমার ভাবনা ঘরে যে তরঙ্গ ওঠে বারেবারে
নীতা বিশ্বাস  

উঃ! সকাল সকাল কান ঝালাফালার একশেষ। যেন ফালা ফালা করে চিরে ফেলছে সকালের নিবিষ্ট পরিবেশ। সকালের একটা নিজস্ব রঙ থাকে, নিজস্ব চরিত্র। একটা-দুটো শাঁখের সুর। খানিকটা চন্দনগন্ধী ধুপ বাতাসে ঘোরা ফেরার আস্কারা। গাছের ‘T-zone’ এ নতুন ফ্ল্যাট বানানোর জোগাড়ে যুগল পাখির কিচিরমিচির ব্যস্ততা। গাছে গাছে ফুলেদের পূজাগন্ধ। সকালের এই চিন্ময় জগৎ ছিঁড়েখুঁড়ে আচমকা কানের পর্দায় দামামা বাজিয়ে পিলে চমকানো চিৎকার, ‘কাগাজ পেপাআআআআর বিক্রি ক্রোওওওও। পূরানা পেপাআআআর...’ চিৎকার এমন পর্যায়ে উঠে যায় যে ‘করো’ শব্দটা ‘ক্রো’ হয়ে কাকের বিশ্রী ডাকের মত শোনায়। মুহূর্তে দৃশ্যপট বদলে যায়। বাতাস হয়ে ওঠে বানিজ্যগন্ধী। হাওয়া বদলে যাওয়া এই চিৎকারের উত্তরে রাগের চোটে বলতেই হয়, আরে পুরোনো দেবো না তো কি নতুন পেপার দেবো তোমাকে?
রাগ করি বটে। কিন্তু রাগ করতে গিয়ে থমকেও যাই, এরাই তো ঘরের দুর্ধর্ষ বেড়ে ওঠা খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনের পাহাড় সরিয়ে আমাদের পাখির খাঁচা সদৃশ ফ্ল্যাটবাড়িতে একটু হাত-পা নাড়ার জায়গার সুরাহার দেবদুত! যদিও কাগজ ওজন করার সময়ে ওরা দ্যূতক্রীড়ার শকুনিসদৃশ হয়ে ওঠে। হোক গে। এই ভাবেই তো মানুষের করে খাওয়া! বড় বড় শিল্পপতিদের কাছে তো এইসব ঠকানো জলভাত। তারা ব্যাঙ্কলোন নেওয়া মানেই কোটি কোটি টাকার তছরুপ! সকলেই তো জানে ওরা এভাবেই ঠকিয়ে বিলাসিতার চরম উপভোগ করে উইদাউট এনি টেনসন! ওরা এই আপ্ত বাক্যটি ভালোই জানে, টেনসন লেনে কা নেহি। দেনে কা। ধারের টাকায় হীরে মুক্তোর বিশাল ব্যবসা, বিশাল প্যালেস, বিশাল হোটেল! তারাই যখন এসব পারে তখন এই সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে দু’পয়সার ব্যবসাদারদের টুঁটি হাতের কাছে আছে বলেই টিপতে হবে! তাছাড়া আমার মতো লোকের পাল্লায় পড়লে তো ওদের ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যায়। এই আমি নামক লোকটা, পুরোনো বই তো দূরের কথা, পূরোনো খবরের কাগজ বিক্রির সময়েও কোনো আকর্ষক আর্টিক্যাল পড়া সত্ত্বেও আবার পড়ে দেখবার বাসনায় সায় দিয়ে কোন কাগজওয়ালা বসে থেকে সময় নষ্ট করবে! ওদের সময়ের দাম নেই! নাকি জজমানের অভাব! আর বই! পুরোনো বই তো ভাতে বাড়ে! অ্যান্টিক! মাসে ৬-৭টা করে ম্যাগাজিন যখন বইএর র্যাক, আলমারি, টেবিল, কাপড়ের ওয়ারড্রোব, টেবিল, খাট বিছানা দখল করে আমাকে বাইরে বের করে দেবার হুমকি দেয়, তখন উদ্বাস্তু আমি বুকের পাঁজর খসিয়ে কিছু বইকে নিতান্ত ঠোঙা হওয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজেকে পাপী মনে করি। এরকম পাপে ডুবে থাকে কিছু কিছু জীবন অধিকারী বা জীবন মহম্মদ বা এ্যাব্রাহাম জীবন নামের নৌকোগুলো!
তুমি বলবে, এতে আবার পাপ কী? প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে যার, তার কোনও মূল্য নেই সংসারে! মূল্য ধরে দিয়ে যা পেতে হয়েছে যদি তার থেকে এককণাও মূল্য উদ্ধার হয় তাতে পাপ কী আর ক্ষতিই বা কী হোলো। আমি বলি মূল্যবোধের চোদ্দটা বাজলো!

হাঃ! মূল্যবোধ! তুমি হেসে ওঠো। ব্যঙ্গ তোমার চোখে মুখে ঠিকরে ওঠে। দোষ দিতে পারিনা তোমাকে! মূল্যবোধ বলে শব্দটা আজ যে অভিধানের জেলখানায় বন্ধ হয়ে আছে! হয়তো সব অভিধানের পরবর্তী সংস্করণে মূল্যবোধ শব্দটা হাস্যকর রকমের প্রাগৈতিহাসিক প্রমাণিত হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে! এই শব্দের অনুষঙ্গে আরো যেসব শব্দ জড়িয়ে আছে—শ্রদ্ধা, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা, এডমিরেসন, সহানুভুতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি অনেক শব্দ অভিধানমুক্ত হয়ে অভিধানের ওজন কমিয়ে দেবে! এসব বাজে পচনশীল অনুভূতি মনের মধ্যে আর অযথা টিঙ্কার বেল হয়ে বেজে উঠবার বাজে হয়রানিতে যাবে না। যত মুক্ত হতে পারা যায় ততই ব্যপ্তি—এ যুগের বাণী।
তো আমি নামের গাছটা সেযুগের মাটির হলেও, আমারও তো হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ‘বদলতি হুয়ী সময় কী আইনা’ হওয়া উচিত। তাইনা? বস্তা বস্তা সেন্টিমেন্ট নিয়ে সময় নষ্ট না করে নষ্টসময়কে শিখে নেওয়াই উচিত! এখনের হাওয়া-বাতাস এই কথা খুলে-আম আমাদের মত মানুষদের বলে যায়।
পুরোনো থেকে মুক্তি, ফালতু নস্টালজিয়া থেকে মুক্তি, কর্তব্যবোধকে হা হা হেসে তামাশা মারা, প্রেমের নামে ঠকিয়ে সহবাস এবং তারপর চিনতে না পারা, নিজের কার্যসিদ্ধির পর মানুষটিকে বেমালুম ভুলে যাওয়া, তাকে অসম্মান করা, পূর্বসূরীদের কাছে কৃতজ্ঞতা নামক বিনিময়কে অস্বীকারের স্পর্ধা, -- বলছিনা এ শুধু এই প্রজন্মের দূষিত ফসল! এগুলি সব প্রজন্মেই ছিল। এখন তুলনামুলক ভাবে ঊর্ধ্বগতি।

গতি। হ্যাঁ এই আরেকটি দুরন্ত শব্দ। গতিরোগে ভুগছে কিংবা হাসছে কিংবা ভাসছে আজকের হৈহৈ ধেইধেই জীবন। তাহাদের ‘দাঁড়াবার সময় তো নাই’ মেসোমসাই। ‘ওই ফুল ফুটে বনে, যাই মধু আহরণে’। দাঁডাবার সময় নেই আজকের মৌমাছি জীবনের। এই বুঝি বড় দামি প্রজেক্ট’টা হাতছাড়া হয়ে গেল! এই বুঝি অফিস পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেল, ওই বুঝি দেরি দেখে প্রেমিকা অন্য কারো হয়ে গেল, এই বুঝি নেক্সট প্রমোশনটা পিছলে গেল! গেল গেল করতে করতেই জীবন মহিমার খোলা জানালা, বিশাল আকাশ, পাখির ডানা অকালে বয়স্ক হয়ে যায়। হ্যাঁ তাইই যাচ্ছে আজকাল এদের কছে সময় বহুৎ কিমতি। আমি বলি ‘সময় বড়া বে-ইমান’। তার নিজের যে একটা সৌন্দর্যকটেজ আছে তা এদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলো! সময় এদের সবুজ দেখাতে শেখালো না। গোধুলির কণেদেখা আলোর মর্ম বোঝালো না। অস্তরাগের আকাশ দেখে মুগ্ধ হতে শেখালো না। মাঝে মাঝে এরা জেটগতির হ্যাংওভার থেকে পালিয়ে পাহাড় সমুদ্র জঙ্গলে এলেও প্রতিমুহূর্তের মুহুর্মুহু ফোনকল এদের তাড়া করে ধেয়ে আসে। কাজ বুঝিয়ে দিতে দিতে সময় সন্ধ্যে হয়ে রাতের বিছানা কখন যেন চিন্তাচ্ছন্ন ঘুমের বেল বাজিয়ে দেয়। পাহাড় জঙ্গল তাদের উন্মোচিত সৌন্দর্য নিয়ে একা বসে কাঁদে। ঘুমটাও এদের অফিসময়। মধ্যরাত পর্যন্ত অন্যদেশের সাহেব-মেমদের সাথে কাজের কথা নিয়ে ভিডিও কনফারেন্স, ট্রেনের সমস্ত জার্ণিটা প্রকৃতি বাদ দিয়ে শুধু ল্যাপটপের কিবোর্ড নিয়েই নিবিষ্ট ২৫ ২৬ ২৭ এর ছেলেমেয়েরা। তাদের ঘুমে নির্দয় ভাগ বসায় যন্ত্র আর কাজ। তাই ঘুমের কাঙাল চোখেরা আজ ফ্লাইটের স্বল্পসময়ের পরিসরে মুহূর্তের মধ্যে গভীর ঘুমিয়ে পড়ে। শিশুর মতো ঘুমকাতর চোখগুলোকে দেখলে খুব কষ্ট লাগে। বড় দুঃখী লাগে ওদের চোখমুখের জেসচার। শিশুবেলায় এই চোখগুলোই না ঘুমানোর জন্য কত বকুনি খেয়েছে মায়ের কাছে!

ঘুম! ঘুমই যে কতপ্রকারের! ইনসা আল্লা! রকমফেরের ঘুম দেখে বয়সে তাজ্জব লাগে! এই কলি কালে আমদের আর কিছু হোক না হোক ধর্মকর্মটি খুব বেড়ে গেছে। শ’ শ’ একর জমি গ্রাস করে ধর্মগুরু বাবাজীদের এক একটি ধম্মভিলেজ। সেই ভিলেজধর্মটির উঞ্ছবৃত্তির যৌনধর্মী পরিপাটি খুব ভালো করে জেনেও, রাতের অন্ধকারে এমনকি অন্ধকার দিনেও রোজ যুবতী তরুণী নাবালিকার কুমারিত্ব ভয়ঙ্করভাবে চুরি হয়ে যাচ্ছে জেনেও সরকার মন্ত্রী আমলাদের তাপ-উত্তাপহীন দিনযাপন, — সেও একপ্রকারের ঘুম। একে বলে জেগে ঘুমানোর বদমাইশি। এই বাবাজী আর তাঁর প্রসাদপাওয়া রইসি ভক্তরা যখন বৃন্দাবনী লীলায় মত্ত, তখন হয়তো সরকার বৃন্দাবনের আসপাশ ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগানে মুখরিত করে রেখেছেন। তা দেখেও দেশরক্ষার স্বঘোষিত কান্ডারীরা কী সুন্দর না-দেখার নিশ্চিন্ত ঘুমে বিছানা ভরিয়ে রাখেন! এ আরো একপ্রকারের ঘুম। বাবাজীদের নাম সচরাচর রাম শব্দটি দিয়ে শুরু হয়। আহা! রাম নাম সত্য হ্যায়। জীবনেও। মরণের পালঙ্কেও। আর কী আশ্চর্য! যত রাম, তত স্ক্যাম। এরা ইনসানিয়াতের চাদর গায়ে মঞ্চ শাসন করে।

ধরা পড়ে যাওয়া এই যাচ্ছেতাইদের প্রাত্যহিক খবরের কাগজের পাতা জুড়ে রসালো পদচারণা রোজ রোজ দেখতে দেখতে আমাদেরও তো মনোবিকার হতেই পারে! পুরোনো কাগজ কিনে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বাকি কিছু মানুষের মনকে সুস্থ রাখার দায়-দায়িত্ব কাগজ পেপার ওয়ালারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এজন্য তো ওদের ধন্যবাদই প্রাপ্য। জয়জয়কারই পাওয়া উচিত। তলিয়ে বুঝে বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলি ‘পুরোনো কাগজ খরিদনেওয়ালা, যুগ যুগ জিও!
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন