ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন এপ্রিল-মে-জুন ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

আঁখি
বিজয়া দেব  

বিয়ের পর আঁখি সুখ নিয়ে একটি ছোট্টো গদ্য লিখেছিল –
“সুখ বস্তুটা নিয়ে অনেক ভাবতাম। শব্দটার মাঝে কল্পনা, আবেশ কিম্বা শৈল্পিক কারুকৃতি নেই। বরং কিছুটা স্থূল ব্যাপার আছে। অনেকটা ভাল ভাল খাবার খেয়ে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার মত। বিয়ের পর ভাল ঘরবর হলে লোকে বলে মেয়েটি সুখে আছে। বিয়ের আগে ভাবতাম বিয়ে ব্যাপারটি ঠিক কেমন? বিয়েবাড়িতে গিয়ে কনের গা ভর্তি গয়না, জমকালো পরিচ্ছদ ও সলজ্জ মুখ, সানাইয়ের সুর, বিয়েতে দান করা পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি দেখে সুখ নামক বস্তুটার স্থূলত্বটা পরিমাপ করতে পারিনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু নিজের বিয়ের সময় স্বামীর রূপ দেখে অবশ্যই আমি মুগ্ধ হলাম। এমন একটি সুন্দর পুরুষের সাথে আমার গাঁটছড়া বাঁধা হল যে মেয়েরা যা নিয়ে স্বপ্নই দেখে। এই মুহূর্তে আমার কাছে গা ভর্তি গয়না, রূপবান স্বামী অভিরূপ, নতুন নতুন আসবাব, নতুন বিছানা এবং সারা গায়ে বিয়ে বিয়ে গন্ধ ...।’’
গদ্যটা লিখে ডাইরিটা বন্ধ করে রেখেছিল আঁখি বিয়ের ঠিক পরপর। তারপর আর খুলে দেখা হয়নি। কলমটাও আর হাতে নেয়নি। ‘সুখ’ নামক বস্তুটির কুহকজালে সে ততদিনে বাঁধা পড়ে গেছে।
মাসখানেক পর সে ছাদে এলো। অভিরূপ অফিসের কাজে গেছে দূরের শহরে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। লালচে, কিছু মৃত আলো ছড়িয়ে আছে চাঁদের আকৃতি জুড়ে। কলঙ্কের ছাপটা কিন্তু এই মরা, লালচে আলোর ভেতর বেশ প্রখর হয়ে আছে। তার পাশে ফুটফুট করছে দুটি ম্রিয়মাণ তারা, আকাশজুড়ে মেঘ আছে –ছন্নছাড়ার মত। এদিক থেকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা একলা কাক কা কা ডেকে উঠল। সন্ধ্যা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অদূরে এক প্রাসাদোপম বাড়ির ছাদে একটি ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে, পথের মোড়ে হেডলাইট আর তীব্র হর্নের দাপাদাপি আওয়াজ, পাশের বাড়িতে কারও কাতরোক্তি।
একটা বিবর্ণ বিশীর্ণ কষ্টবোধে তাড়িত হল আঁখি। মনে হল অনেকদিন হল সে কোনও স্বপ্ন দেখেনি। অনেকদিন হল রাতের অন্ধকারে কালো ঘোড়ায় চেপে সেই ঘোড়সওয়ারও আসেনি।
এখন তার স্বামী অভিরূপের অনুপস্হিতি, কৃষ্ণপক্ষের এই পাণ্ডুর চাঁদের কলঙ্কিত রূপ, সেই কালো ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ার তার মনটাকে অস্থির করে তুলল। তার মনে হতে লাগলো সেই পুরনো পৃথিবীটাকে – যা ধ্বস্ত, বর্ণহীন, ধূসর। তার মনে পড়তে লাগলো ফুটপাত, ক্ষয়, দারিদ্র্য, পাগলি ভিখারিণীর কথা। নিজেকে, অভিরূপসহ এই সুখী বর্তমানকে জাদুবাস্তবতায় মোড়া এক মঞ্চসফল নাটক বলে মনে হতে লাগলো। সে চমকিত হয়ে দেখলো একটি বুড়ো প্যাঁচা উল্টোদিকের পুরনো স্যাঁতাপড়া ছাদের আলসেতে বসে তার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে।
আঁখির ঠাকুমা যখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাবার তোড়জোড় করছিল তখন কালো ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের কথা বলত। সে বেশ আগের কথা। তখন আঁখি সদ্য যুবতি। একটা আবছায়া জগৎ তখন আঁখির সামনে এঁকে দিয়েছিল ঠাকুমা। ঐ কালো ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের কথা শুনতে শুনতে সে এক নবীন মানুষের ছবি নিজের তুলিতে এঁকেছিল। কালো পোশাক তার, খুব দৃপ্ত, লম্বা চুল পনিটেল করে বাঁধা। ঠাকুমাকে ছবিটা দেখিয়েছিল। কী অসম্ভব ভালবাসত ছবিটাকে ঠাকুমা। আমৃত্যু ছবিটা নিজের কাছেই রেখেছিল ঠাকুমা।
আজ সেই ছবি, এই লাল চাঁদ, ছাদ ঘিরে নেমে আসা মেদুর সন্ধ্যা আর প্যাঁচার নির্নিমেষ দৃষ্টি ঘিরে আঁখি উদ্বেলিত হল। এক নিষিদ্ধ জগৎ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই ঘোড়সওয়ারের দৃপ্ত ভঙ্গি এক অমোঘ আকর্ষণে তাকে টানছে। সে ক্রমশই কামতাড়িত হয়ে উঠেছে।
ছাদ থেকে ছুটে নিচে নেমে এল সে। ফ্রেমে আটকানো অভিরূপের হাস্যমুখর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অবাক বিস্ময়ে দেখল এক বড় ফ্রেমে সেই কালো ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের ছবিটি তাদের শোবার ঘরের দেয়াল জুড়ে আছে। তার কাছে অভিরূপ অনেকটা ম্লান।
পরদিন অভিরূপ ফিরে এলো। সে বুঝতে পারল না যে আঁখিকে সে রেখে গিয়েছিল আর যে আঁখি আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মাঝখানে এক কালো ঘোড়া ও এক দৃপ্ত ঘোড়সওয়ার দাঁড়িয়ে আছে।

                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন