নিবন্ধ

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন এপ্রিল-মে-জুন ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

আজকের শৈশব ও পড়াশোনার ভার
লোপামুদ্রা সিংহ দেব

উৎসবের বাড়ি, তাই বাড়িতে আজ থেকেই আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা। পিকুর দিকে মায়ের নজরটা আজ তাই একটু কম – অন্যদিন মায়ের কড়া শাসনে পড়ার বই ছেড়ে এক মিনিটের জন্যও তার ছুটি নেই। তিনটে টিউশন, স্কুল করার পরও মায়ের নির্দেশে তাকে বই নিয়ে বসতে হয়।
হাঁপিয়ে উঠেছে পিকু, অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে ওঠে। মায়ের দেওয়া টাস্ক করে তবেই সে যেতে পারবে আনন্দ-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, দুদিন বাদেই যে বিনিদিদির বিয়ে। ঋক, খোকন, মিষ্টু, গোগোল দৌড়ে আসে ওর ঘরে — সমস্বরে বলে ওঠে – “কি রে আজকের দিনেও তুই বই নিয়ে বসে! চল চল বাইরে কত মজা হছে।” পিকু বলে, “এই তো home task গুলো করে নিয়েই যাচ্ছি।” শোনেনা ওরা, টেনে নিয়ে যায় তাকে। পিকুও ভাবে মা নিশ্চয় আজ আর বকাবকি করবে না।
খেলায় মেতে ওঠে সে খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোনদের সাথে। সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে পিকু। বেশ কিছুক্ষণ খেলাধুলার পর জল খেতে এসে মার নজরে পড়ে যায় পিকু। “যে অংকগুলো দিয়েছিলাম হয়েছে?” মার কড়া গলা। আমতা আমতা করে পিকু বলে, “না, না মানে আমি পরে ঠিক করে নেব মা, আজ একটু খেলি?” “সময়ের মূল্য বোঝনা, যে সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে, আর ফিরে পাবে তাকে”- মা’র গলা আরও কড়া, “যাও study room এ, সব শেষ করে তবেই খেলতে বের হবে।”
অভিমানে, অপমানে মুখটা লাল হয়ে ওঠে পিকুর। কোন কথা না বলে study room এর দিকে চলে যায় সে।
বেলা গড়ালে পিকুর জেঠিমা তাড়া দেন, “বেলা অনেক হলো, ছোট ছেলেপুলে গুলোকে খেতে বসিয়ে দিই। গোগোল, মিষ্টু - সব্বাইকে ড়েকে এনে বসে পড়।”
বেশ খানিকটা সময় কেটে যাবার পরেও বাচ্চাগুলোর দেখা নেই। জেঠিমা ব্যস্ত হয়ে ওদের ডাকতে যান। দোতলায় পিকুর study room এর সামনে বাচ্চাগুলো কী করছে? “এখানে কি করছিস রে তোরা” বলতে বলতে পিকুর জেঠিমা মায়াদেবী এগিয়ে যান ওদের দিকে। “দেখ না, পিকুটা, দরজা খুলছে না”-- সমস্বরে বলে ওঠে ওরা। নাঃ, পিকু দরজা আর খোলে না। লোকজন এসে দরজা ভাঙে, পিকুর ঝুলন্ত দেহ তখন নিথর। অভিমানী পিকু চলে গেছে এক বিরাট ছুটির দেশে, যেখানে নেই পড়াশোনার চাপ, না মায়ের রক্তচক্ষু।

‘ছুটি’ এই দু অক্ষরের শব্দটি আমাদের প্রাণের ভেতর এনে দেয় এক অদ্ভুত খুশির আমেজ। কিন্তু আজকের প্রজন্ম কি পায় সেই খুশির আনন্দ? তাদের জীবন থেকে ছুটি শব্দটাই যে হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তাঁদের জীবন থেকে সেই লুকোচুরি খেলা, মাঠে-ঘাটে দৌড়ে বেড়ান। কালবৈশাখীর পর বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বুকে নিয়ে আম কুড়োনোর হুড়োহুড়ি, কিম্বা দাদু-ঠাকুমার কোল ঘেঁষে রূপকথার গল্প শোনা। ইঁদুর দৌড়ে ঢেলে দিয়েছি আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের। সর্বক্ষণ আমরা তাঁদের বোঝাই --
“ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়, ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়,” সাঁতারে, চিত্রকলায়, ব্যায়ামে, পদ্য বলায়। “ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়, ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়,” --- গানে আর তবলার তালে, ক্রিকেট ও দাবার চালে। সর্বত্র ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়, ছোটদের ফার্স্ট হতে হয়।

তাই শুধু পড়া নয় ড্রইং, সাঁতার, দাবা সব কিছুতেই প্রথম হবার প্রাণান্তকর চেষ্টায় মেতে উঠেছে সবাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতা কাহিনী’র মত মা-বাবারা আজ তাঁদের সন্তানদের তোতাপাখি করে তুলতে বদ্ধপরিকর। শিশুদের পচ্ছন্দ অনুযায়ী নয়, অভিভাবকদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের শিখতে হয় বিভিন্ন বিষয়। এ ছাড়া বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুলে ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে home work ও project-এর বোঝা। তাই ক্লাস ওয়ানের ছেলে ‘অনুজপ্রতীম দাসে’র কাঁধে চার চারটি টিউশনির বোঝা।
সে বলে ----
“মায়ের ইচ্ছে ক্রিকেট শিখে শচীন হয়ে উঠি,
বাবার সাধ পূরণ করতে দাবায় কাটে ছুটি
কাকার ভীষণ ইচ্ছে আমি রবীন্দ্রনাথ হই,
তাঁর প্রতিজ্ঞা ভাইপোটাকে লিখতে শেখাবই।”

ছোট্ট অনুজের জিজ্ঞাসা
আমার মতো আরো অনেক ‘অনুজপ্রতীম দাস’
নিজের জন্য পায়না কেন একটু অবকাশ।”

নতুন প্রজন্মকে পড়াশোনার নাগপাশে বেঁধে ফেলেছি আমরা। একটা নম্বরও কম পাওয়া চলবে না। এক ফোঁটা রক্তের মতনই যে এক-একটা নম্বরও বড্ড বেশি দামি। বাবার কন্ঠে শুনি-----
“তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইএর বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম।
তাঁর বদলে মাত্তর পঁচাশি
পাঁচটা নম্বর কেন কম? কেন কম?
প্রথম হওয়া দরকার প্রথমে।
তা হলেই ছবি ছাপবে খবর কাগজ
আরো দরজা খুলে যাবে, আরো পাঁচ,
আরো পাঁচ, আরো আরো পাঁচ,
পাঁচ পাঁচ করেই বাড়বে, অন্যদিকে মন দিস না,
বাঁচবি তোঁ বাঁচার মতো বাঁচ”।

ছেলে বলে ওঠে---
না, আমি খেলতে যাইনা, কখনো খেলতে যাইনি,
না, আমার বন্ধু নেই, না বাপী একজন আছে অপু,
এক ক্লাসে পড়ে,
ও বলে যে ওর বাবাও বলেছে প্রথম হতে,
বলেছে কাগজে ছবি, ও’র বাবা ওকে...
অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম,
বলেছে ও ব্যাক পাবে,
ব্যাক পেলে ও বলেছে বাড়িতে কোথায়
বাথরুম সাফ করার আসিড রয়েছে জানে,
হ্যাঁ বাপী হ্যাঁ বলেছে উঠে যাবে কাগজের
প্রথম পাতায়”।

এক বিশাল প্রতিযোগিতার দৌড়ে সর্বক্ষণ ছুটে চলতে হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। শিশুদের জীবন আজ যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র, সব শিশুই যোগ দিচ্ছে সেই যুদ্ধে, শুধু তারাই নয় সেই ইঁদুর দৌড়ে শামিল হয়েছে তাঁদের অভিভাবকরাও। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, কবিতা ছবি আঁকা, মার্শাল আর্ট অনেক কিছুই শিখছে তাঁরা। কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে এসব সুকুমার বৃত্তির চর্চা করেও অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মনোজগতে বিশেষ পরিবর্তন ঘটছে না।
আজকের সমাজজীবন অণু পরিবারে পরিণত। বাবা, মা ও তাঁদের একমাত্র সন্তান্ সেই পরিবারের সদস্য। প্রায় সব পরিবারের মা-বাবার এক গগনচুম্বী প্রত্যাশা থাকে সেই সন্তানকে কেন্দ্র করে। তাই ক্ষণিকের অমনোযোগিতাও ক্ষমা পায়না। এ ছাড়া অন্য কৃতি ছাত্রদের সাথে অহরহ তুলনা শিশুমনে এক ভয়ংকর আঘাত সৃষ্টি করে, সেই আঘাত তাঁদের অনেক সময় বিপথে চালিত করে, এক অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। অনেক সময় শিশুমনে এমন গভীর ছাপ ফেলে, এতে তাঁর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়।
আবার এই ভার বহন করার মতো মানসিক শক্তি সকলের থাকে না। পরাজিত যারা তাঁদের অনেকেই জীবন থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, তাই খবরের কাগজের পাতায় প্রায়শঃই দেখি কচিকাঁচাদের মর্মান্তিক পরিণতি। ইংরাজি তে একটা কথা আছে –“more is not always best”। শিশুদের শৈশব তাই আজ ক্ষতবিক্ষত।
আচ্ছা, আমরা কি পারিনা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এক সুস্থ স্বাভাবিক জীবন উপহার দিতে, যেখানে নেই কোনো প্রতিযোগিতা, আছে বন্ধুত্ব। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে কোন অপুর দরকার হবেনা বাথরুমের এসিড খোঁজার, কোন পিকুকে পালিয়ে যেতে হবেনা এই সুন্দর জীবন আর সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসিক শক্তি যোগানোর দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরকেই। ভালোবাসায় ভরা হাতের যাদুস্পর্শে তারা যেন বুঝতে পারে, পরীক্ষায় প্রথম হওয়াই জীবনের শেষ কথা নয়। মাথা উঁচু করে, সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যাবার নামই জীবন। আমরা যেন তাদের বুঝতে শেখাই শিক্ষা মানে সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটানো নয় বরং সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো। জাগিয়ে তুলতে হবে শিক্ষার প্রতি তাঁদের ভালবাসা।
আপনি, আমি, আমরা কি পারিনা ওদের জন্য এক স্বপ্নময় সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে যেখানে প্রকৃত মানুষ হওয়াই হবে একমাত্র লক্ষ্য। পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে নয়, পৃথিবীর সমস্ত রস, সমস্ত মাধুর্যকে নিজেদের জীবনের অঙ্গ করে বাঁচুক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
(নির্বাচিত কবিতার পংক্তিগুলি কবি প্রমোদ বসু ও কবি জয় গোস্বামীর কবিতা থেকে নেওয়া।)
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন