নিবন্ধ

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন এপ্রিল-মে-জুন ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

প্রতিবাদের সাহিত্য ও শৈলেশ্বর ঘোষ
নকুল রায়

‘প্রতিবাদের সাহিত্য’ বইটি ছাপা হয় ২৬ (+৬) বছর আগে। এই বইটিতে যে-কয়টি গদ্য আছে, এর মধ্যে ১৯৬৮ সালে ক্ষুধার্ত কাগজে হাংরি জেনারেশনের লেখক-কবিদের সামনে মোহিত চট্টোপাধ্যায় কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন। সেখান থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
শৈলেশ্বর ঘোষ লিখেছেন –
“একথা ঠিক সে মুখোসধারী ফুঁসে উঠবে, প্ররোচিত করলে রিঅ্যাকট্‌ করবে – জীবনে সত্য বিন্দুর দিকে যেতে থাকলে যে সচেতনতায় আঘাত পড়ে তা সকলে সহ্য করতে পারে না যে পৃথিবীতে সুখ অতি সহজ, একটি মুখোসের দাম যেখানে একটি কানাকড়ির বেশি নয়, ন্যায়পরায়ণ ভণ্ডামী যেখানে সত্য হিসেবে মূল্য পায়, সেখানে যে অস্তিত্ব মূলত একা আলাদা, স্বাধীন হয়ে যাওয়া যার আকাঙ্ক্ষা, নিজের জীবনই যার মুক্তির পথ, শরীরই যার কেবলমাত্র কম্যুনিকেট করে তাকে পৃথিবী বরদাস্ত করতে রাজী নয়, রাজি নয় সমাজ, রাষ্ট্র – তাই প্রতিটি মানুষ যখন একা আলাদা হয়ে যেতে থাকে তখনই পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ শুরু হয় – তাকে ইতিহাস অপরাধী বলে ঘোষণা করে – ঘোরতর এই যুদ্ধের পারমাণবিক বিস্ফোরণই সাহিত্য এবং এখানে জীবন ও সাহিত্য এক – কোন তফাৎ থাকা মানেই কৃত্রিমতাকে মেনে নেওয়া – মানুষের ইতিহাসে অতঃপর এই যুদ্ধের ধারাবিবরণীই থেকে যাবে আর থাকবে প্রতিটির একক যোদ্ধার পরাজয় ও পতনের কাহিনী – ‘কল্যাণধর্ম’, ‘মূল্যবোধ’ শব্দগুলি কেবল বিচারকই উচ্চারণ করে যাবে –
মোহিত চট্টোপাধ্যায় আমার ও আমার বন্ধুদের লেখা পড়েছেন এবং কিছু জানতে চেয়েছেন – উনি বিচারক নন, সাহিত্যিক ঈর্ষা, ব্যর্থতাদের থেকে উনি কিছু বলেননি – বললে তার কোন জবাব পেতেন না – যেমন কিছুদিন আগে, ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’ নামক ঈর্ষাকাতর ব্যক্তির নিজের ব্যর্থতাজনিত সাহিত্যিক কিচিরমিচির এর কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন আমি বোধ করি না – মোহিত রানিং ডগস্‌ অব এস্টাব্লিশমেন্টের কেউ একজন নন –
তিনি প্রশ্ন করেছেনঃ আমরা একধরণের কবিতা লিখছি, এটা শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া পদ্ধতিকেই স্বীকার করা।
উত্তরে বললামঃ না, যা লিখছি আমরা কবিতা হিসেবে তা বুর্জোয়া মেনে নেয় না। ...”

রাজনীতি ও সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্নের উত্তরটি এসময়েও (১৯৬৮র পরও) বেশ তাৎপর্যময় মনে হয়েছে। দেখুন শৈলেশ্বর ঘোষ ৪৪ বছর আগে (তাঁর বয়েস তখন ৩০) কী উত্তর দিয়েছিলেনঃ-
‘যতদিন পর্যন্ত শোষণ, তা সে বিন্দুমাত্র হলেও, মানুষের মধ্যে কাজ করবে ততদিন জীবনের মূল্যবোধ বিকৃত হতে থাকবে, আর বিকারের বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করুক আমি তাই চাই। আমাদের রচনা মানুষকে এই বিকার সম্পর্কে সচেতন করবে – এই আমরা মনে করি।
সৎ লেখাই মানুষকে এই বিদ্রোহের প্ররোচনা দেবে, তাকে আরও স্বাধীন হতে বলবে। একজন কবি বা লেখকের চেয়ে বেশি সচেতন মানুষ, সমাজে হাজার হাজার থাকে না। প্রকৃত লেখকের মধ্যেও রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কাজ করে, কারণ সে তো ঐ বাস্তবের মধ্যেই শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় – কিন্তু তাৎক্ষণিক বাস্তবকে নিজের মধ্যে নিয়েও সে আরও কিছুর সাধনা করে – এই আরও কিছুর মূল্যেই তার মূল্য, না হলে একজন রাজনৈতিক কর্মীর বা নেতার চেয়ে তার প্রয়োজন বেশি হতে পারে না। এর বেশি কিছু যদি সে তার ভিসানে ধরতে পারে তবেই ভবিষ্যৎ তাকে তুলে নেবে, না পারলে নেবে না। আর এই বেশি কিছুকে ধরবার জন্য লেখকের মনের বড় একটা অংশকে ফাঁকা করে বসে থাকতে হয় – অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে ঐ মহামূল্য জায়গাটা ভরাট করলে সে লেখক হিসেবে মরবে – লেখকের কাজ, আমার এই মনে হয়, সবকিছু বুকে নিয়ে আরও বেশি কিছুর জন্য সমস্ত অস্তিত্ব নিয়োগ করা।’

পাঠক, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন বোধ হয় ‘কল্যাণধর্ম’, ‘মূল্যবোধ’ সম্পর্কে বিচারকেরাই উচ্চারণ করে উক্ত শব্দগুলি বলেছেন প্রথম দিকে মোহিত চট্টোপাধ্যায়কে। মোহিত চট্টোপাধ্যায় একাধারে সে-সময়ের (এবং মৃত্যুও পর এখনও) একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার, কবি, অধ্যাপক। তিনি গত হয়েছেন প্রায় ১ যুগ হলো, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে লিখিত নাটকের যে রূপবিন্যাস ও মৌলিক অবদান রেখেছেন, তা অস্বীকার করাই যাবে না। এমন ব্যক্তিত্বকে জবাব দিচ্ছেন কবি শৈলেশ্বর যখন তাঁর বয়স ৩০ বৎসর। তিরিশেই তিনি বললেন “যতদিন পর্যন্ত শোষণ, তা সে বিন্দুমাত্র হলেও, মানুষের মধ্যে কাজ করবে ততদিন জীবনের মূল্যবোধ বিকৃত হতে থাকবে, আর বিকারের বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ করুক আমি তাই চাই।”
একজন কবির কাছে ওই বয়সেই যে অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ প্রজ্ঞার দিকে ধাবমান অনুভূতি তা বোধ হয় ৭০ বছর বয়সে গিয়েও মুখ থুবড়ে পড়েনি বরং আলোকিত হচ্ছে বারবার।

গত ২৩ এপ্রিল ২০০৮, দুপুরের কথাবার্তাঃ

আমি – লেক ভিউ পার্কের সব রাস্তাই সোজা, পিচঢালা ক্রশরোড, পরিষ্কার ঝকঝকে বসত বাড়িগুলি দেখতে ভালোই লাগছে। এটাও কি ভাড়া? দ্বিতলায় বেশ হাওয়া খেলছে।
শৈলেশ্বর – না। রিটায়ারমেন্টের পর যা ছিল অবশিষ্ট, সব ঢেলেছি। ওর থাকবে কোথায়। রোজগার নেই তো কারোর। প্রথমে একটু জমি, তারপর এই ঘর। দ্বিতলে এই টুকরো ঘর, পড়াশোনার অথবা নিজের সঙ্গে যুদ্ধের জায়গা।
আমি – কীরকম?
শৈলেশ্বর – মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের টাইটেল হাজরা। বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ছেলেটি ভালো। ভালো চাকরিও করছে। তার ব্যক্তিস্বাধীনতা কী বুঝলাম না। স্বপ্নদীপ এই বাচ্চা শিশুটিকে দেখতে আসেনা। দেখলেন, স্বপ্নদীপের মা নিচে বসে টিভি দেখছে তার মায়ের সঙ্গে। এই দৃশ্য ওই হাজরা বোঝেনা। ডিভোর্স করেছে। আজ দুবছরের মতো। মেয়ে এবং মেয়ের ছেলে এই যে এই স্বপ্ন থাকে আমাদের কাছে।
আমি কী করবো বলুন! অদ্ভুত সম্পর্ক এসব মানুষের!
আমি – কাগজপত্র হয়ে গেছে সব? আই মিন ডিভোর্স হলে তো স্ত্রী-পুত্রের খরচা বা আর্থিক বিষয়ে আইনি নিয়ম কানুন মানতে হবে মিস্টার হাজরাকে।
শৈলেশ্বর – দেখি, অনেকদিন ভেবেছিলাম এ ব্যাপারে ভাববো। দেখি। এদিকে দেখুন, আমার স্ত্রীর কথা তো জানেনই। দীর্ঘ ২০ বছর, আমি তাকে এখন সারিয়ে তুলেছি নার্সিং-এর জোরে ...।
আমি – মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা এবং একাগ্রতা আপনার আছে বলেই ...।
শৈলেশ্বর – হয়তো বা। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট বলেছিলেন, নার্সিং এবং নার্সিং, আর সেই সঙ্গে আন্তরিক সহমর্মিতার সঙ্গে সেবা করতে পারলেই এরোগ সারবে। আমিও কিছুটা জানতাম। বাস্তবে আমি বেশি জেনেছি। একসময় তার পাগলামো বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আমি যে-সময়টা কাটিয়েছি আমার স্থীর সঙ্গে, তার দুইভাগও মিস্টার হাজরা বুঝতে পারে না। বুঝলে এ ডিভোর্স হয় না। এটা কী ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ! মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তো অনুভবের, অনুভাবের। অবশ্য ব্যক্তিরুচির। কিন্তু নিজের সন্তান? তার যেদিন জন্ম, আমি হাসপাতালে গেছি, এবং অবাক কাণ্ড, সেদিন কী কারণে আমি ২৫ হাজার টাকা তুলেছিলাম, সম্ভবত ঘর অথবা সাংসারিক কাজে, জানতাম না এই নাতিটি, জন্মসূত্রেই পৃথিবীটাকে দেখছে অনাথরূপে, আমি ভাবতেই পারিনি তার বাবা এরকম ফেলে রেখে থাকতে পারে কীরকম! অবশ্য সে এসেছিল হাসপাতালে। আমার ২৫ হাজার থেকে সে-রাত্রেই সাত হাজার টাকা জমা দিলাম নার্সিং হোমে। অথচ এখন দেখুন, সে স্বপ্নদীপ আপনার গা ঘেঁষে বসে সব শুনে যাচ্ছে ...।
অনেকদিন বাদে একটু সাংসারিক আনন্দ পেলাম আপনাকে দেখে। বসুন। চা-র কথা বলে আসি।
[নিচে নেমে গেলেন। স্বপ্নদীপ আমার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করে যাচ্ছে তার মতো করে। আবার উপরে উঠে এসে বসলেন একই অভিব্যক্তিতে কবি শৈলেশ্বর ঘোষ।]
আমি – বউদিকে দেখে তো এখন আমার আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আপনার সময়টা সাংঘাতিক প্রতিরোধময় ‘নিজেকে ব্যবহার করাই ধর্ম’ আপনিই তো বলেন।
শৈলেশ্বর – আপনার লেখাটা (মেরুদন্ড-বিষয়ক) সম্পর্কে যখন আমার মতামত নেয়া হয়েছিল, আমি ওই তরুণ প্রকাশককে বলেছিলাম, ২২ হাজার টাকা খরচ করছো, টাকা উঠবে কিনা জানিনা, তবে নকুল রায়ের এই লেখাটা যখন বাছাই করেছো, তাতে মনে হয় এবং আমারও ধারণা, লেখাটি ২৭ বছর পরেও এখনো বোধহয় গ্রহণযোগ্যতা অনেকের চেয়ে অন্যরকম। তখন তরুণ প্রকাশক বীজেশ সাহা ‘প্রতিভাস’-র কর্ণধার আমাকে জানালো যে ২০০টি লেখা বাতিল হওয়ার ভেতর এই ‘মেরুদণ্ড বিষয়ক শৈলেশ্বর ঘোষ’ লেখাটি বারবার সকলের পছন্দের আওতায় আসছে। কোন খারাপ হয়নি তো ছেপে?
আমি – আরে না না। আমিও পড়ে দেখেছি। এখন তো মনে হয় আপনার প্রজ্ঞার বয়স...।
শৈলেশ্বর – হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। তরবারী উন্মুক্ত, তবে ময়লা কাটার জন্য। আমরা তো জীবনকেই ভালোবাসি। জীবনের সূত্রপথে জড়কে দেখেছি বারবার। বলুন, এখন এছাড়া আর কী লেখার আছে!
আমি – এখানকার প্রতিবেশীরা কেমন দেখছেন? যোগাযোগ হয় পড়োশিসুলভ?
শৈলেশ্বর – স্ত্রী ভালো হচ্ছিলেন একটু একটু করে এই বাড়িতে ঢোকার পর। সাতটা বিড়াল পালতাম। তাদেরই সন্তান, নাতি। পাশের বাড়ি থেকে প্রতিবাদ এলো একদিন। সব বিড়ালই তাদের সর্বনাশ করছে। বিড়ালের উৎপাত তারা সহ্য করতে পারছেন না।। একদিন সব বিদায় করে দিলাম। তবু মাঝে মাঝে এরা আসতো। অন্ধকারেও বিড়াল, সন্তান এবাং নাতিরা যে হাঁটাহাঁটি করছে টের পেতাম। প্রতেবেশী-স্বস্তির জন্যে আবারও বিদেয় করে দিই।
[কিছুক্ষণ পর সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। তখন প্রায় বিকাল চারটা। বহুদূর যেতে হবে। রাস্তায় হেঁটে হেঁটে চলে এলেন বিদায়-সংলাপে।]
আমি – প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়? অন্যান্যদের সঙ্গে?
শৈলেশ্বর – খুব কম। আপনি কি যাদবপুর যাবেন? বলছিলেন-না দিদির বাড়ি যাবেন। ঝিলরোডে সাধন সাহার দেখা হলে শৈলেশ্বর ঘোষ সংখ্যাটি দিয়ে দেবেন কি? বলেই আবার বাড়িতে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর ‘সাধন সাহা’র নাম লিখে সংখ্যাটি দিলেন পৌঁছে দেবার জন্যে।
আমি – যদি সময়টা না-কুলিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আগরতলায় নিয়ে যাবো। সাত্ত্বিককে দিয়ে দেবো। সে তো কোলকাতায় আসে প্রায়ই।
শৈলেশ্বর – হ্যাঁ, ঠিক আছে।

এই পর্যন্তই শৈলেশ্বরের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎকার। ঘরে এসে ফের পড়লাম প্রতিবাদের সাহিত্য থেকে এই কটি বাক্যঃ
‘ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ – এই উক্তির মধ্য দিয়েই শঙ্খ ঘোষের হৃদয়কে, মননকে পড়ে নেওয়া যায়। খুবই মানবোচিত আকাঙ্ক্ষা। বর্তমানকে কবি চেনেন এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিচলিত। স্বপ্নহীন এক পৃথিবীতে আমাদের বাস, আর সময়ের সাথে সাথে সত্যকল্পনা থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমরা” উৎক্ষিপ্ত জেব্রা ও রাত-জাগা পাখি --- শৈলেশ্বর ঘোষ ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’।
শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে প্রদীপ চৌধুরীর লেখার একটি অংশ থেকে (১৯৭৮) পুনর্পাঠ করতে পারিঃ শৈলেশ্বর ঘোষ আমার বহুদিনের পুরনো বন্ধু, কখনো কখনো মনে হয় প্রকৃত শৈলেশ্বরকে স্পর্শ করার যোগ্যতা আমি আজো অর্জন করতে পারিনি। ‘ সমগ্র জীবন দিয়ে চীনের প্রাচীরের মতো এক ভাষা আবিষ্কার করেছি আমি’ ৮ বছর আগে (১৯৭০) আমাকে এক চিঠিতে লিখেছিল শৈলেশ্বর। এ শতাব্দীর একজন সচেতন কবির উপলব্ধ এই ভানহীন উক্তি যে কত সত্য, যত দিন যাচ্ছে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যতই ‘উত্তেজনা’র স্থান দখল করে নিচ্ছে চেতনা, ‘ঐ ভাষা’ আমার কাছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
“কেচ্ছাকাহিনী এবং স্বনামে / বেনামে ধার করা বিষয়বস্তু ও ‘আদর্শ-কথা’র পুরুষানুক্রমিক চুরি-জোচ্চুরিই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আঁতুড় ও অনুপ্রেরণা। সেই অর্থে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখিত হয়, তাহলে নিশ্চিত, শৈলেশ্বর একাই একটা গোটা জেনারেশন হিসেবে বিবেচিত হবে। অনাচার, বিশ্বাসহন্তা, খুনী, প্রতারক এবং সর্বোপরি ভালবাসা-বর্জিত নগর সভ্যতার পাকস্থলীর ভেতর থেকেও শৈলেশ্বর ঘোষ একক ও অনন্যসাধারণ ঘটনা।”
(একই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে স্থাপিত ভালবাসা মৃত্যু অমৃত জীবন --- প্রদীপ চৌধুরী)
এবার দেখুন ‘অপরাধীদের প্রতি’ কবিতার কিছু পংক্তি থেকে শৈলেশ্বরকে পুনর্পাঠে কী অসাধারণ অনুরণন জাগায় মনে –
“চোখ তুই দেখেছিস তুই অন্ধ হবি
কান তুই শুনেছিস তুই কালা হয়ে যাবি
মুখ তুই ভক্ষণের ও বমনের, শব্দপাতের ও
শব্দ ধারণের, তুই বোবা হয়ে যাবি –
হাত তুই অস্ত্রের মেহনের ও লিখনের
তুই হৃদয়স্থান চিনতে পারিস না বলে পঙ্গু হবি
পা তুই ইচ্ছায় অনিচ্ছার কাজ করিস
দুরকম চরিত্রে তুই স্বস্থানে ও পরস্থানে
যাতায়াত করিস, তুই খুলে যাবি –
লিঙ্গ তুই, কামহীন সহবাসে লুপ্ত হয়ে যাবি
হৃদয় তুই শূন্যতার কাছে গিয়ে নেচে উঠিস
হৃদয়ের কাছে যাবার আগে বিদীর্ণ হবি ...”

সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে, এই পংক্তিগুলির ভেতর আমাদের মানব্জীবনের অভিশপ্ত এবং আতঙ্কিত মনোভাবটি ধরা দেয়, এবং আমাদের বোধের ব্যাপ্তি যতই গভীর কিংবা সরল হোক, যখন পড়ি – ‘হৃদয় তুই শূন্যতার কাছে গিয়ে নেচে উঠিস / হৃদয়ের কাছে যাবার আগে বিদীর্ণ হবি...’ এ এমন এক বোধ যা বিশ্বে দানবাক্রান্ত মানুষের জীবন ও হৃদয় শেষাব্দি শূন্যই হয়ে পড়ে, নিজের অহংটাও সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় বোধের আকাশে, আমাদের বেঁচে থাকার ভূ-আকাশে।

আরেকটি কবিতার অংশ, শৈলেশ্বরের ভালোবাসার আর্তি লক্ষ্য করুন—

‘শেষ দিনে খুনী লিখে রাখছে কপালে তার ‘জানতে চেয়েছিলাম
ছিল-কি-না-ছিল ভালবাসা হৃদয়ে আমার ‘ মধ্যরাতে বাবা
মাকে খুন করতে গেলে সেও তার বাবাকে খুন করবে ভেবেছিল
একটি মেয়েও একদিন চিৎকার করে বলেছিল, ‘প্রাণ বাঁচাও
আমি তো তোমাকেই ভালবাসি’। শেষ রাত্রির নক্ষত্র
মাথার ওপর, পুলিশের টহল, জিঞ্জির নিবদ্ধ প্রাণ
খুনী জানতে চাইছে ‘কে কে বলেছিল আমি খুনী,
আমি তাদেরও খুন করতে চাই’, যে পাখি ঘুমায় না সেও
সেদিন ভয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল – জানি এই সারাংশ-সহ
পার হতে পারব না, এই আমার জয়গর্ব, যতক্ষণ জেগে
আছি ততক্ষণ ভুলতে হবে না কিছু – করোটি কপালে
প্রবেশ ও প্রস্থান ছাড়া আর কিছু লেখে না, খুনী আমি,
যাদের খুন করেছি ভালবেসে তাদের সঙ্গেই রয়ে গেলাম
ছিল-কি-না-ছিল ভালবাসা শুধু এই জানতে চেয়েছিলাম।”
(জয়গর্ব, অপরাধীদের প্রতি। পৃ ৫১)

কবি প্রদীপ চৌধুরীর বিশেষ বাক্যটি এরকম – “বুর্জোয়া সমাজের পরিকল্পিত ‘বিশেষ’, রিপ্রেশন এবং আবেগের যন্ত্রীকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান – তথাপি শৈলেশ্বর কোন অবস্থাতেই এর শিকার নয়। আর্তো এ-পয়েন্টে উন্মত্ততা এড়াতে পারেননি। শৈলেশ্বর ঘোষ বাংলা সাহিত্যে সম্ভাবনাময় সাইবেরিয়া।”
এই উল্লিখিত ‘সম্ভবনাময়’ শব্দটি নিয়ে আমি বেশ কিছু গদ্যে উল্লেখ করেছি যে এই শব্দটির ভেতর চিন্তাস্রোতের কলধ্বনি শোনা যায়, বহুভাবেই বহুক্ষেত্রেই এর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। বিশাল পৃথিবীতে মানুষের চিন্তা ও ভাবের প্রকাশ মাধ্যমের শিল্পরূপে কবিতার স্থান ঊর্ধে। ব্যক্তিসত্তার বিকাশে আত্মগঠনের ক্ষেত্রে কবিতার ভয়ংকর সৌন্দর্য অস্বীকার করা যায় কী করে!
বাস্তবতাকে রূপকল্পে আক্রমণ করে কবিতার ভাষাকেই ভাষা দিয়ে আক্রমণ করার সভ্যক্ষমতা জাত কবিদের থাকে। “একটি মেয়েও একদিন চিৎকার করে বলেছিল, ‘প্রাণ বাঁচাও / আমি তো তোমাকেই ভালবাসি’। শেষ রাত্রির নক্ষত্র / মাথার ওপর, পুলিশের টহল, জিঞ্জির নিবদ্ধ প্রাণ / খুনী জানতে চাইছে ‘কে কে বলেছিল আমি খুনী, / আমি তাদেরও খুন করতে চাই’, যে পাখি ঘুমায় না সেও / সেদিন ভয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল” – এ সমস্ত পংক্তিতে কবি শৈলেশ্বর শুধু অপরাধীর মনের আগুনে পোড়া শব্দই ব্যবহার করেননি, একই সঙ্গে পাঠকের অন্তর্গত বোধে অপরাধচর্চার ভেতরেও যে ভালোবাসার জ্বলন্ত ভাবোন্মাদনার সৃষ্টি করে, এবং পাঠকও যে কবিদগ্ধের মতো হতে হয় নিজেকে ব্যবহারের মাধ্যমটিতে – তা একজন দূরদর্শী সৎ কবি শৈলেশ্বরের মতো মানুষই আমাদের জানিয়ে এবং জাগিয়ে দিতে পারেন নির্দ্বিধায়। পূর্বমেঘ,২০১২।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন