ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন এপ্রিল-মে-জুন ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

অন্য এক কুরুক্ষেত্রে
সদানন্দ সিংহ  

বলটা, যেটার রং ছিল অনেকটা ডালিমের মত, একটু যেন লাফালো। তারপর ওটা আটকে গেল গাছের একটা ডালে আর ডালিম ফলের মতই শোভা পেতে লাগল। অথচ একটু আগেও ওটা ছিল সুশান্তের হাতে। কি আর করে সে। একটু কসরত করে সে গাছে উঠল। হাত বাড়াল ডালিম ফলের দিকে। এটা একটা বাস্তব, না পরাবাস্তব, নাকি স্বপ্ন? সুশান্ত এ অবস্থায় অনেকবার পড়েছে। এই সময়েই তার পছন্দের গানের কলিটা সে শুনতে পায়, মুকালা মুকাব্লা লায়লা...। প্রথমে মনে হল আওয়াজটা যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। তারপর আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে একসময় তার একদম কানের কাছে নাচতে লাগল। অনেকদিন আগের পুরোনো গান। গানটা তার খুব পছন্দের। গানটা শুনলেই প্রভু দেবার নাচটাও তার সামনে যেন ভেসে উঠে। গানের কলিটা বেজেই চলছে। আসলে ওটা তার মোবাইলের রিংটোন।
বালিশের পাশেই একটা টেবিলঘড়ি সবসময় গড়াগড়ি খায়। সুশান্ত শুয়ে শুয়েই ঘড়িটা চোখের সামনে তুলে ধরে। দেখে, রাত একটা বেজে গেছে। সে একটু বিরক্ত হয়, এই রাতে আবার কে ফোন করছে!
রিংটোনের আওয়াজে মালবিকাও জেগে ওঠেছে। সে বেশ বিরক্ত, কী একটা রিংটোন লাগিয়েছ। কেবল মুকালা মুকাব্লা। কেন ওটা চেঞ্জ করছ না?
সুশান্ত মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, সীমান্ত ওকে কল্‌ করছে। হ্যালো বলতেই ওপার থেকে সীমান্তের গলা ভেসে আসতে থাকে, প্রবীণের মা ঘন্টা খানেক আগে মারা গেছেন। আমি এখন প্রবীণের বাড়ি যাচ্ছি। তুই আয়। তাড়াতাড়ি। সীমান্ত ফোনটা কেটে দেয়।
মালবিকা জিজ্ঞেস করে, কার ফোন?
বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে সুশান্ত বলে, সীমান্তের ফোন। প্রবীণের মা মারা গেছেন। আমি এখন প্রবীণের বাড়ি যাচ্ছি।
পাশের ঘরে ওদের একমাত্র ছেলে সপ্তর্ষি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওর ইঞ্জিনীয়ারিং পড়াশোনার ফাইনাল ইয়ার চলছে। ইতিমধ্যেই ওর চাকরির দুটো অফার পেয়ে গেছে। বাইকের চাবিটা ওর টেবিলেই। সুশান্ত তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টিয়ে বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরুতে বেরুতে মালবিকার উদ্দেশ্যে বলে, উঠো, গেইট-দরজাটা বন্ধ করতে হবে।
মালবিকা উঠতে উঠতে বলে, দাঁড়াও। হেলমেট কোথায় ?
--- ওটা বোধহয় বাইকেই ঝোলানো।
হেলমেটটা বাইকেই ছিল। বারান্দার গ্রীলের দরজা খুলে সুশান্ত বেরিয়ে যায়। এদিকটায় বাইকচোরের বেশ উপদ্রব। বারান্দার গ্রীলের দরজা খুলে বেশ কয়েকজনের বাইক চুরি হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে সুশান্ত দেখে মালবিকা বারান্দার গ্রীলের দরজা লাগাচ্ছে।
প্রবীণ সুশান্তের বাল্যবন্ধু। অবশ্য স্কুলটা আলাদা ছিল। সীমান্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যাবার পর প্রবীণের মাধ্যমে। এদের বন্ধুত্ব এখনো অটুট। এই দশদিন আগেও সুশান্ত প্রবীণের বাড়ি গিয়েছিল। কথা বলার মত অবস্থায় ছিল না প্রবীণের মা। বয়স নব্বইয়ের ওপরে। বার্ধক্যজনিত নানান রোগে আক্রান্ত। হাই ব্লাড প্রেসার তো ছিলই। আসলে সবাই উনার মৃত্যুর জন্যেই বোধহয় অপেক্ষারত ছিল। তাই বোধহয় মালবিকাও এব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞেস করে নি, যেন ও জানতো ব্যাপারটা।

মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রবীণের বাড়ি পৌঁছে যায় সুশান্ত। ওদের বাড়িটা অনেকদিনের পুরোনো, বাপ আমলের। বড় বড় চারটি কামরা, একটি রান্নাঘর এবং একটি কমন বাথরুম নিয়ে একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক ফাঁকা জায়গা। মার জন্যেই প্রবীণ এতোদিন পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করতে পারেনি। ওর বাবা মারা গেছেন প্রায় কুড়ি বছর আগে।
সুশান্ত প্রবীণের বাড়ির সামনে বাইকটা স্ট্যান্ড করে রেখে যখন সামনে এগোয় তখন দেখে উঠোনে বিভিন্ন বয়সের প্রচুর লোকে গিজগিজ করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারে সূশান্ত। প্রবীণ ডাক্তার মানুষ। পাড়ার অনেকেই অসুখে-বিসুখে তার কাছে চিকিৎসার জন্যে আসে বলে ডাক্তারবাবুর মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে পাড়ার মানুষেরা ছূটে এসেছে। এছাড়াও প্রবীণদের আত্মীয়-স্বজনও অনেক।
সুশান্তকে দেখে সীমান্ত এগিয়ে আসে। বলে, এই রাতে তোকে ছাড়া অন্য বন্ধুদের ফোন করিনি। সকালে সবাইকে জানিয়ে দেব। এখনকার মত শ্মশানের যাবতীয় কাজ তুই আর আমি মিলে চালিয়ে দেব। আমি শববাহী গাড়ির জন্যে ফোন করে দিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা এসে যাবে।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করে, প্রবীণ কোথায়?
--- এখানেই কোথাও আছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়ার লোক সবাইকেই সামলাতে হচ্ছে কিনা।
একটা ব্যাপার সুশান্ত লক্ষ করে, আগত কারুর মুখেই শোকের চিহ্ন প্রায় একদম নেই। কেউ কেউ আবার নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে গল্পগুজবও করছে। ঘরের ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ-টাওয়াজও শোনা যাচ্ছেনা। হয়ত এই অসুস্থ বৃদ্ধা মহিলার মৃত্যু সবার মনে আগেই হয়ে গেছিল।
মৃতদেহ এখন উঠোনে। এক নতুন চাদর দিয়ে ঢাকা এক সাজানো খাটে শোয়ানো। এক দামি কম্বল দিয়ে মৃতদেহের মুখ ছাড়া বাকি অংশ ঢাকা। কম্বলের ওপর চারিদিকে ফুল ছড়ানো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবীণ ওদের সামনে আসে। বলে, তোদেরকে অনেক কিছু সামলাতে হবে। আপাতত হাজার দশেক টাকা রাখ। বলেই প্রবীণ সীমান্তের পকেটে এক গোছা নোট জোর করে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর আবার বলে, টুকিটাকি যা খরচ হবে এখান থেকে করিস। আমি এখন ঘরের ভেতরে যাচ্ছি। আত্মীয়স্বজনদেরকেও সামলাতে হচ্ছে।
প্রবীণ ঘরে ঢুকে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শববাহী গাড়ি এসে প্রবীণদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। পাড়ার কিছু ছেলে গাড়িটাকে জল দিয়ে ধুয়ে ফুল দিয়ে সাজায়।
একসময় মৃতদেহটাকে গাড়িতে উঠানো হয়। প্রচুর ধূপ-ধুনো সহ গাড়িটা একসময় এগোতে শুরু করে। হরি হরি বোল, বোল হরি বলে ধ্বনি দিতে দিতে পাড়ার ছেলেগুলিও গাড়ির পেছন পেছন এগোতে থাকে। প্রবীণ, সীমান্ত, সুশান্ত এবং প্রবীণদের বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনও গাড়ির পেছন পেছন এগোতে থাকে।
সুশান্ত লক্ষ করে শ্মশানযাত্রীর সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। যুবকদের সংখ্যাই বেশি এবং এরা নাকি পাড়ার ক্লাবের ছেলে। গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। কেউ গাড়ির আগে, কেউ পিছে। সুশান্তরা সবার শেষে।
এগোতে এগোতে প্রবীণ হাতে ধরা একটি কাপড়ের থলি থেকে খুচরো পয়সা মুঠো ভরে বের করে গাড়িটাকে লক্ষ্য করে ছিটিয়ে দিতে থাকে। টুংটাং করে পয়সাগুলি রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরপর প্রবীণ একাজটা করতে থাকে। একসময় থলির পয়সা শেষ হলে প্রবীণ থলিটাকে নালায় ফেলে দেয়।
এই রাতে রাস্তায় অন্য লোকজনের দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দু-একটা বাইক বা গাড়ি খুব দ্রুত গতিতে হুস্ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে পাঁচজনের এক পুলিশের দলকে ওরা দেখতে পায় রাস্তায় ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে সারিবদ্ধদাবে।
শেষে একসময় ওদের গাড়িটা মহাশ্মশানে এসে পৌঁছোয়। ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে গাড়িটা থামে। গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে ডোমের খুঁজে বেরিয়ে যায়। বেশ বোঝা যায় এসব কাজে ড্রাইভারটি অভ্যস্ত। প্রায়দিনই তাকে বোধহয় একাজ করতে হয়। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার লোকটি ফিরে এসে জানায় ডোমের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সৎকারের জন্যে কেউ আসেনি বলে ও কোথায় জানি বেরিয়ে গেছে। এবার ড্রাইভার মহাশ্মশানের গেইট পেরিয়ে ডোমের খোঁজে বাইরে বেরিয়ে যায়। বোধহয় সে জানে ডোমকে কোথায় পাওয়া যাবে।
সুশান্তরা গাড়িটার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। এইসময় বছর ত্রিশের এক যুবক ওদের সামনে এসে প্রবীণকে বলে, স্যার কিছু খরচপাতির দরকার আছে। কিছু টাকা লাগবে।
প্রবীণ সীমান্তকে দেখিয়ে দেয়। সীমান্ত যুবকটিকে জিজ্ঞেস করে, কীসের?
পাল্টা প্রশ্ন শুনে যুবকটি একটু অখুশি হয়। নিরাসক্ত গলায় সে উত্তর দেয়, সৎকারের জন্যে অনেক কিছুই করতে হয়। এসব কাজে আমি অভ্যস্ত। আমাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিন। নিশ্চিন্ত থাকুন। সৎকারের সব কাজ হয়ে যাবে।
সীমান্ত প্রবীণের দিকে চায়। প্রবীণ বলে, দিয়ে দে।
সীমান্ত টাকাটা দিয়ে দেয়। যাবার সময় যুবকটি বলে যায়, ডোমকে আমি ধরে আনছি। আপনারা ওদিকে কোথাও বসুন। কোন চিন্তা করবেন না।
যুবকটি চলে যায়।
প্রবীণ জানায়, পাড়ার বেকার ছেলে। সবাই ওকে জুন্টা বলে ডাকে। পাড়ার সব সৎকারেই ও থাকে। ওকে ডাকতে হয় না, ও নিজে থেকেই এসে হাজির হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুশান্তরা দেখে জুন্টা তার কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ সহ ডোমকে নিয়ে সামনে এসে হাজির হয়েছে।
জুন্টা হাসে, ওকে নিয়ে এলাম। তারপরের কাজগুলি ওই সব করে নেবে। আচ্ছা, আমরা একটু আসছি।
জুন্টারা কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে যায়।
ডোমের জ্ঞানবুদ্ধি বেশ প্রখর। ঠিক সে প্রবীণের সামনে এসে দাঁড়ায়, শবদেহটির দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করে, ইনি আপনার কে হন?
প্রবীণ উত্তর দেয়, আমার মা।
ডোম শবদেহের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটা প্রণাম জানায়। বলে, আপনাদের ভাগ্য খুব ভাল। সৎকারের জন্যে কোনো-কোনোদিন লম্বা লাইন পড়ে যায়। একটা চুল্লিই কাজ করছে এখন। সে যাকগে, আপনি আমাকে পাঁচশ টাকা দিন। কিছু বাঁশ এনে মৃতদেহটাকে ঠিক ঠিক ভাবে চুল্লির ভেতর রাখার জন্যে একটা কাই তৈরি করতে হবে।
সীমান্ত কোন কথা না বলে পাঁচশ টাকা দিয়ে দেয়। ডোম লোকটা মুহূর্তের মধ্যেই কিছু বাঁশ এবং একটা দা নিয়ে চুল্লির সামনে বসেই কাজে লেগে যায়।
সুশান্ত এই শ্মশানে আগে কখনো আসেনি। এখানে অনেক জায়গায় আলো জ্বলছে, আবার অনেক জায়গা অন্ধকার। রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। সুশান্ত দেখে, শ্মশানযাত্রীদের বসার জন্য কাছাকাছি দুটো দেয়ালহীন ঘর আছে।
সীমান্তই বলে, ওখানে বসার জায়গা আছে। চল্‌।
ওরা বসার উদ্দেশ্যে এগোয়। সিঁড়ি বেয়ে বসার জায়গায় যাবার পর ওরা দেখে বেশ কিছু লোক এদিকওদিক মশারি টাঙিয়ে ঘুমোচ্ছে। কিছু লোকের আবার মশারি নেই, চাদরে মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছে। শ্মশানের এই খোলা বিশ্রামাগারে যে এতো লোক ঘুমিয়ে থাকবে সুশান্তরা ভাবতেই পারেনি।
ওরা সিঁড়িতেই বসে পড়ে।
সীমান্ত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে হাতের তালুতে একটু নাচায়। তারপর সুশান্তের দিকে চেয়ে বলে, এখানে বসে খাব একটা?
সিগারেটের ধোঁয়ায় সুশান্তের ভীষণ অ্যালার্জি। দম আটকে আসতে চায়। সীমান্ত সেটা জানে। তাই মাঝে মাঝে খাবার অনুমতি চায়। তবে প্রায়সময়েই অনুমতির তোয়াক্কা করে না। দুম করে সিগারেট ধরিয়ে সুখটান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে চলে। তাতে সুশান্ত নিজেই একটু অন্যদিকে সরে যায়। সিগারেট যে ক্ষতিকারক সেটা সীমান্ত মানতে চায় না একদম। বরং উদ্ভট সব উদাহারণ এনে হাজির করে বলে অমুক লোকটা কোনদিনই সিগারেট খায়নি, অথচ ফুসফুসের ক্যান্সারে কেন মারা গেল?
সীমান্তের দিকে চেয়ে সুশান্ত বলে, সিগারেট বের করেই ফেললি, আবার কেন মেকি ভদ্রতা দেখাচ্ছিস! সুশান্ত একটু দূরে সরে বসে।
--- থ্যাঙ্কয়ু। বলে সিগারেট ধরিয়েই সীমান্ত টানতে থাকে।
শেষরাতের দিকে এখন একটু শীত জমতে শুরু করেছে। সুশান্তের গায়ের হাফ স্যুয়েটার ভেদ করে শীত সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এইসময় প্রবীণ বলে ওঠে, জানিস, আমাদের আত্মীয়স্বজনদের কাউকেই মায়ের জন্য দুঃখবোধ দেখলাম না। মনে হচ্ছে সবার কাছেই মা যেন বহু আগেই মৃত। শুধু দেহটাকে এখন সৎকারের জন্যেই আনা হয়েছে। আমি নিজেকেও এদের থেকে আলাদা বলে ভাবছিনা। কিন্তু সত্যি বলছি, আমার এখন মায়ের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। ছোটবেলার কথা আমার এখন খুব মনে পড়ছে।
প্রবীণ হু হু করে কাঁদতে থাকে। প্রবীণের দুঃখবোধ সুশান্তরা ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। ওদের মা এখনো জীবিত।
সুশান্ত সান্ত্বনার সুরে বলে, তুই আমি সবাই একদিন এভাবেই যাবো। দুঃখ করে লাভ নেই। আর--। সুশান্তের কথা আর শেষ হয় না। হঠাৎ অঃ অঃ করে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ শুনে ওরা চমকে উঠে। ওরা দেখে মশারিহীন যে কয়েকজন লোক ঘুমিয়ে আছে, এদের মধ্যে একজন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই হাত-পা কেঁপে কেঁপে গোঙাচ্ছে। লোকটার গায়ের চাদরটা তার শরীর থেকে খসে পড়ে গেছে। পাশে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের এ ব্যাপারে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সুশান্তরা লোকটার একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
সীমান্ত বলে, দুঃস্বপ্ন দেখছে নাকি! জাগিয়ে দেবো?
প্রবীণ ডাক্তারি দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে বলে, মৃগী মনে হচ্ছে। প্রবীণ আরেকটু ঝুঁকে দেখে আবার মন্তব্য করে, শ্বাস এখন স্বাভাবিক। ওর এখন কিছু হবে না। চল্‌।
ওরা আগের জায়গায় ফিরে এসে আবার বসে।
সীমান্ত শেষ একটা সুখটান দিয়ে সিগারেটের শেষাংশটাকে সিঁড়িতে নিভিয়ে দেয়।
ওরা দেখে শববাহী গাড়ির ড্রাইভার ওদের দিকেই আসছে। সামনে এসে ড্রাইভার লোকটি বলে, আমি আপনাদেরকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। ডেডবডিটাকে নিচে নামাতে হবে। আমার আরেকটা কল এসেছে। এখুনি আমাকে বেরুতে হবে। কাইণ্ডলি ভাড়াটা একটু মিটিয়ে দিন। রসিদ দিয়ে দিচ্ছি। একটু তাড়াতাড়ি করুন স্যার।
সুশান্তরা উঠে দাঁড়ায়। গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। জুন্টাদের দরকার এখন। সীমান্ত জুন্টাদের উদ্দেশ্যে এদিকওদিক দেখতে থাকে। তবে বেশিক্ষণ আর দেখতে হয় না। অন্ধকার ফুঁড়ে জুন্টারা বেরিয়ে আসে। ওদের চোখগুলো ঢুলু ঢুলু লাল লাল। ওদেরকে কিছুই বলার দরকার হয় না। জুন্টারা মৃতদেহটাকে খুব সাবধানে নামিয়ে এনে কাছের এক শান বাধানো গাছতলায় রাখে। গাড়ির ভেতরে রাখা কাপড়চোপড় সহ সমস্ত জিনিসপত্র এনে মৃতদেহের কিনারে রাখে। তারপর জুন্টারা আবার অদৃশ্য কয়ে যায়।
গাড়ির ড্রাইভার সীমান্তের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রসিদ দেয়। গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
ডোম তার কাজ নিয়ে তখনও ব্যস্ত। সুশান্ত বলে, প্রবীণ তুই এখানে পাহারা দে। আমরা একটু এদিকসেদিক ঘুরে আসছি। চল্‌ সীমান্ত।
শ্মশানের ভেতর সুশান্ত আর সীমান্ত আলো এবং আধো অন্ধকারের মাঝে এদিকসেদিক ঘুরে বেড়ায়। তবে ঘন অন্ধকারের ভেতরে ঢোকে না। সুশান্ত দেখে শ্মশানের একটা জায়গায় অনেকগুলো সিমেন্টের ফলক তৈরি করা আছে। সেই ফলকগুলো কিছু খ্যাত ও অল্প-খ্যাত ব্যক্তিদের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা। অমুক সালে জন্ম, অমুক সালে মৃত্যু ইত্যাদি ইত্যাদি।
শ্মশানের পাশেই হাওড়া নদী বয়ে চলেছে। এই অন্ধকারে ওটাকে ঠিক নদীর মত মনে হচ্ছে না।
শ্মশানের এক পাশে একটা মন্দির আছে। দূর থেকে সুশান্তরা দেখে ওদিকে একটা বাল্ব জ্বলছে এবং ওখানে ওদের সঙ্গেই আসা বেশ কিছু যুবক বয়সের ছেলে বসে আছে। তবে জুন্টাদের ওখানে দেখা যাছে না। গাঁজার গন্ধে চারিদিক ম ম করছে।
এবার সুশান্তরা ফিরে যেতে গিয়েও একটু চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। অন্ধকার ভেদ করে কংকালের মত একটা কালো ছায়া ওদের দিকে আসছে। ছায়াটা আস্তে আস্তে আলোর ভেতরে এলে ওরা দেখে ওটা একটা ছ’ফীটের মত লম্বা কৌপীন পরা একটা কংকালময় বয়স্ক শরীর। শরীরটা একসময় ওদের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যায়।
সুশান্তরা যখন প্রবীণের কাছে ফিরে আসে তখন ওরা দেখে জুন্টা এবং তার দলবল বাঁশের টুকরো, গাছের শুকনো ডাল ইত্যাদি দিয়ে আগুন ধরিয়ে তাপ পোহাচ্ছে। সেই কৌপীন পরা লোকটিও জুন্টাদের সঙ্গে আগুনের সামনে বসে তাপ পোহাচ্ছে। সুশান্ত এবার লোকটিকে ভাল করে দেখে। লোকটার মস্তক মুণ্ডিত এবং বৃদ্ধ। বয়স সত্তরের কাছাকাছি মনে হয়। জুন্টারা ওর সঙ্গে বেশ মস্করা করছে আর লোকটিও হি হি করে হাসছে। হাসার সময় ওর দন্তহীন মুখ দেখা যাচ্ছে।
ডোম এইসময় বলে ওঠে, আমার কাজ শেষ। ডেডবডির কাপড়চোপড় খুলে গাছের নিচে সরিয়ে রাখুন, তারপর শুধু বডিটাকে এই বাঁশের মাচার ওপরে রাখুন।
জুন্টা উঠে দাঁড়ায়। সে তখন মাল-গাঁজার নেশায় টলছে। সে জড়ানো গলায় চেঁচায়, এ্যাই তোরা এখনো বসে আছিস ? কয়েকজন আয় আমার সঙ্গে।
জুন্টা এবং তার কয়েকজন ছেলে মৃতদেহের সব কম্বল, চাদর এবং অন্যান্য সব কাপড় একপাশে গাছের নিচে সরিয়ে রাখতে থাকে। কাপড়চোপড়ও নেহাৎ কম নয়। প্রবীণ শেষবারের মত মাকে সাজিয়ে এনেছে।
শেষে ডোম এবং জুন্টারা প্রবীণের মাকে প্রায় নগ্ন অবস্থায় বাঁশের তৈরি কাইয়ের ওপর রেখে বাঁশসুদ্ধ দেহটাকে চুল্লির ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
ডোম তার কাজে লেগে যায়। ইলেকট্রিক চুল্লি জ্বলতে শুরু করে।
জুন্টারা ফিরে এসে আবার আবার আগের জায়গায় আগুনের তাপ পোহাতে থাকে।
তখন আরো দুটো শববাহী গাড়ি মাইকে “হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ” কীর্তনের রেকর্ডিং গাইতে গাইতে শ্মাশানে পরপর প্রবেশ করে প্রবীণদের থেকে একটু দূরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে যায়।
জুন্টার বোধহয় বেশ নেশা হয়ে গেছে। জড়ানো গলায় সে চেঁচায়, শালা রেশনের দোকানেও লাইন, শ্মশানেও ডেডবডির লাইন। দেশটার কী হাল হল রে!
গ্যাস-চুল্লির আগুন এখন দাঊ দাঊ জ্বলে উঠেছে। জুন্টার মাথাতেও বোধহয় তার হাওয়া এসে লাগে। সে হঠাৎ কৌপীন পরা বৃদ্ধলোকটিকে ঠেলা মেরে নিচে ফেলে দেয়। কংকালময় বৃদ্ধ শরীরটা মাটিতে গড়ায় আর ‘ও মাগো’ বলে কাঁদে। জুন্টার সঙ্গীরা হি হি করে হাসে।
হঠাৎ ব্যাপারটা দেখে সুশান্তরা একটু থতমত খেয়ে যায়। এখন কী করা উচিৎ ভেবে পায় না। এর মধ্যেই জুন্টা টলতে টলতে উঠে বৃদ্ধলোকটির কাছে যায়। মাটি থেকে বৃদ্ধলোকটিকে উঠিয়ে আবার আগুনের সামনে বসায়, জিজ্ঞেস করে, শীত লাগছে ?
বৃদ্ধলোকটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।
জুন্টা মৃতদেহের সঙ্গে আসা একটা কম্বল এনে বৃদ্ধলোকটির গায়ে জড়িয়ে দেয়। এবার বৃদ্ধলোকটির মুখে একটু হাসি দেখা যায়।
এসব ব্যাপারগুলো ডোমের চোখের সামনেই ঘটছে।
হঠাৎ ডোম তার সৎকারের কাজ ফেলে তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে এসে মৃতদেহের সঙ্গে আসা সমস্ত কাপড়চোপড় এবং অন্যান্য জিনিসগুলো নিয়ে কোথায় জানি রেখে আসে। তারপর আবার সে সৎকারের কাজে নেমে পড়ে। হাতে একটা বাঁশ নিয়ে চুল্লির ভেতর খোঁচায়।
জুন্টা তখন জড়ানো গলায় বৃদ্ধলোকটিকে জিজ্ঞেস করছে, তোমার বাড়ি কোথায়?
উত্তর আসে, নেই।
জুন্টা যেন রেগে যায়, নেই মানে ? তাহলে বলো, আমার বাড়ি দিল্লি।
বৃদ্ধলোকটি এবার হাসে। বলে, আমার বাড়ি দিল্লি।
জুন্টাও একটু খুশি হয়, হ্যাঁ, এই তো ঠিক আছে। এবার বলো, তোমার বৌ আছে? তোমার বৌ কোথায়?
বৃদ্ধলোকটি বলে, তোমার বৌ আছে ? তোমার বৌ কোথায় ?
--- এ্যাই চ্যাংড়ামি হচ্ছে ? বলেই জুন্টা বৃদ্ধলোকটিকে আবার ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়। আবার বৃদ্ধলোকটি ‘ও মাগো’ বলে কাতরায়, মাটিতেই পড়ে থাকে। জুন্টা হো হো করে হাসে। সঙ্গে হাসে তার কিছু সাগরেদ।
এইসময়েই সুশান্ত দেখে জুন্টাদের সঙ্গেরই একটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধলোকটিকে টেনে মাটি থেকে তুলে বসিয়ে দিয়েছে।
ব্যাপারটি লক্ষ করে জুন্টা যেন ক্ষেপে যায়, এ্যাই ফুচকা, তোর গায়েই দেখি এসব বিঁধছে! লোকটা কি তোর বাপের বাপ?
ফুচকা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দেয়, বাপ তুলে কথা বলবেনা জুন্টাদা বলে দিলাম।
--- শালা কালকের ফুচকে একটা ছেলে, আমাকে আবার ধমকাচ্ছে ?
--- না, মোটেই ধমকাচ্ছিনা। আমি বলতে চাই, তুমি যা করবে সব আমরা মেনে নেবো না।
--- শালা তোকে আগেও দেখেছি আমার ব্যাপারে অযথা নাক গলিয়ে যাচ্ছিস। আমাকে নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে? বলতে বলতে জুন্টা এগিয়ে এসে ফুচকাকে বেশ জোরে ধাক্কা মারে। ফুচকা মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ফুচকা লাফ মেরে উঠে আসে। তারপর সেও জুন্টাকে বেশ জোরেই ধাক্কা দেয়। ধাক্কা খেয়ে জুন্টা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। মাটিতে বসেই জুন্টা চিৎকার করে বলতে থাকে, শালাকে মার। মার।
সঙ্গে সঙ্গেই তিনটি ছেলে ফুচকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, চড়, ঘুষি, লাথি চালাতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই ফুচকার দলের কয়েকজন উঠে পাল্টা মার চালাতে থাকে।
এক নিমেষেই জায়গাটা এক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের রূপ যেন ধারণ করে। এই যুদ্ধের মধ্যেই অশ্রাব্য ভাষায় মুখে যা আসে তা দিয়ে গালিগালাজ চলতে থাকে। দুটো শববাহী গাড়ির লোক যারা এতক্ষণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তারাও দৌড়ে যে যার গাড়ির কাছে চলে যায়।
প্রবীণ হঠাৎ আতঙ্কিত গলায় বলতে শুরু করে, আমার মায়ের অন্তোষ্ঠিক্রিয়ার মাঝে এ কী শুরু হলো! প্রবীণ যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে থাকে, থামো থামো। থামো সব।
প্রবীণের দেখাদেখি সুশান্ত, সীমান্ত এবং প্রবীণদের বেশ কিছু আত্মীয় বয়স্কলোক মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারপিটরত দু’দলকে থামাবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। কেউ কাউকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। থামাতে গিয়ে সুশান্তের গায়েও একটা ঘুষি জোরে এসে লাগে। সুশান্ত লাফ দিয়ে একটু দূরে সরে যায়। এমন সময় হঠাৎ সুশান্তের মোবাইলটার রিংটোন বেজে ওঠে, মুকালা মুকাব্‌লা লায়লা...। সুশান্ত বেশ বুঝতে পারে এখন এই মুহূর্তে ওটা মালবিকারই ফোন। ওর কল্‌ ছাড়া আর কারুরই কল্‌ আসার কথা না। তাই সে আর এই পরিস্থিতে ফোন আর রিসিভ করে না। রিংটোনটা বেজেই যায়, মুকালা মুকাব্‌লা লায়লা...। সামনের এই মহাশ্মশানের যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে গানটা শুনতে শুনতে সুশান্তের একসময় মনে হয় শ্মশানক্ষেত্রে প্রভু দেবার শরীরহীন টুপি, কোট, প্যান্ট, জুতার এক দারুণ নাচ গানের তালে তালে নেচেই চলেছে।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন