বন্দিপাখি
সুদীপ ঘোষাল
সুনীল টোটো চালায়। মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়ার সুযোগ পায় নি। টাকা রোজগারের জন্য বাবার মারা যাবার পর এই কাজে নেমেছে। বাবা বলতেন, কোনো কাজ ছোটো নয়। আর খেটে খাওয়া সম্মানের কাজ।
আজ টোটো নিয়ে সকালে বেরোনোর পর সুনীল চায়ের দোকানে এলো। চায়ের দোকান বন্ধ কেন? ভেবে পেলো না। অসীমকে দেখতে পেয়ে সুনীল জিজ্ঞাসা করলো, কি রে দোকান বন্ধ কেন? অসীম বললো, জানিস না, সমরবাবু মারা গেছেন। তাই তার সম্মানে, আজ দোকান বন্ধ।
সুনীল টোটো রেখে সমরবাবুর ছেলের সংগে দেখা করতে গেলো। সমরবাবু সমাজসেবক। তিনি সুনীলকে দয়া করে টোটো কিনে দিয়েছেন। সুনীলকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তার বাবাকেও ভালোবাসতেন। তাই তার ছেলের কাছে গিয়ে খোজ নেওয়া দরকার।
সুনীলের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। তাদের বাড়ির কাছে একটা পুকুর ছিলো। একটা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখাতো। কি যে খুঁজে বেরাতো পুকুর জুড়ে জানত না সে। শাপলা ফুল তুলে বাউরি বৌ একটা ফুল তার হাতে দিতো। বেশ ভালো ছিলো সেই সময়গুলো। রাস্তা পার হতে গিয়ে বেজি আর শিয়াল দেখে তার মনে আনন্দের সীমা থাকত না। লাল মোরাম রাস্তায় হারিয়ে যেতো তার মন। ছুটে চলে যেতো কদতলার মাঠ পেরিয়ে অজয়ের ধার। সেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকত। ছোটো মাছগুলো পায়ে চুমু খেয়ে চলে যেত বারে বারে। বালির চরে বালিহাঁসগুলো খেলা করত আপন খেয়ালে।
তারপর কালের পরশে কালি লাগে মনে। এখন আর তেমন করে ধরা দেয় না মন। সংসারের চাপে গড়িয়ে যায় অজয়ের বানভাসি জল। সমস্ত ভাললাগা স্বপ্নগুলো এলোমেলো হয়ে যায় জীবনে।
সুনীল ভাবে, এই সংসারে টাকার দাম সবথেকে বেশি। যার টাকা আছে লোকে বলে তার নাকি পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে আসে। সে বিশ্বাস করে না। টাকা থাকলে কি প্রকৃতি ধরা দেয়? ধনী হলেই কি কবিতা লেখা যায়? যায় না। তাহলেও সে নীল আকাশে তার মন ওড়াতে পারে না। আয়নায় প্রেমিকার মুখ দেখতে পায় না। শুধু অর্থ বাড়াবার চিন্তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লোভের সাগরে। চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে জানতে পারে নি। আজ খালিহাতে বাড়ি গেছে। মায়ের হাতে টাকা দিতে পারে নি। মা রাতে খাবারের সময় বললেন, শুনেছিস সমরবাবু মারা গেছেন।
--- হাঁ মা, শুনেছি।
--- তাদের বাড়িতে দেখা করেছিস।
--- একবার গেছিলাম। ছেলে আমাকে চেনে না। তার বাবার সাথে আমার পরিচয়ের কথা বললাম। ছেলে অত পাত্তা দিলো না। আমি তারপর মাঠে বসে খেলা দেখছিলাম।
--- দুপুরে আবার কী খেলা!
--- মা, সারা জগৎ খেলায় ব্যস্ত। শুধু দেখার মত চোখ চাই। শোনার মত কান চাই।
--- ঠিক বলেছিস। তোর বাবা যখন ছিলেন, তখন একবার চুপি পাখিরালয়ে নিয়ে গেছিলেন। কী সুন্দর তাদের চলাফেরা। ওড়া। ওদের উড়তে দেখে মন চলে গেছিলো নীল আকাশে। তোর বাবা বললেন, নামো, নামো। পড়ে যাবে। আমরা দুজনেই ছোটো হয়ে গেছিলাম। তোর বাবাও তোর মত ভাবুক ছিলেন। তাইতো ভরা চাঁদের আলোতে লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেন চাপা পড়লেন আমাদের রেখে। তখন তুই তিন বছরের ছেলে। তারপর বাড়ি বাড়ি কাজ করে তোকে বড় করেছি। চাকরি না পেলেও মন তোর ছোটো নয়। তুই বাবার মতোই বড়ো মনের মানুষ।
--- মা তোমার ছোটোবেলার কথা বলো। আমার শুনতে ভালো লাগে।
--- আমার বাবা ছিলেন পালক নরম, উদার মনের মানুষ। কিন্তু লাঠি খেলা, সড়কি খেলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিলো। দুর্গাদেবীর মূর্তি তিনি নিজেই বানাতেন। আর অই কদিন আমরা বাবার কাছেই থাকতাম। একমাটি, দুই মাটি করে রঙ করতেন মায়ের। চোখ আকার দিনে আমাদের কৌতূহল বেড়ে যেত। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। চোখ আঁকা হয়ে গেলে সাদা কাপড়ে ঢেকে দিতেন মায়ের দেহ। সেই ঢাকা খোলা হোতো পুজোর দিনে। ঢাকের বাজনার তালে তালে বেজে উঠতো আমাদের আমোদের তাল। সেই তালে তালে মন নাচত অনেকদিন পড়ার ঘরে। বাবা জোর করতেন না কোনোদিন। আমরা আবার মিশে যেতাম সহজ জীবনে।
মা বেটা গল্প করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। তারপর মা চলে গেলেন নিজের ঘরে। ছেলে নিজের ঘরে।
তার পরদিন চা খেয়ে সুনীল বেরিয়ে পড়লো নিজের কাজে। টোটো চালিয়ে যা রোজগার হয় তার একটা ভাগ তুলে রাখে অভূক্ত মানুষের জন্য। দিনের পর দিন চলে যায়। সুনীল এখন একটা অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছে তার বাড়ির পাশের জমিতে। মাটির বাড়িতে অনেক অনাথের বাস। প্রথমে একটা ছিল বাড়ি। ধীরে মানুষের সাহায্যে গড়ে উঠল আরও বাড়ি। সে বুঝলো, ইচ্ছা থাকলে টাকা পয়সা বাধা হয় না কোনদিন। আশ্রমের নাম রাখল, সমর নিবাস। সমরবাবু তাকে টোটো কিনে দিয়েছেন। আর তাই তার নামে সে আশ্রমের নাম রাখলো, সমর নিবাস। সুনীলের বন্ধু দেবু বলেছে, কে যে কখন কার আত্মীয় হয়ে যায় বোঝা কঠিন। আশ্রমের নাম সুনীল বাবার নামে রাখলো না। রাখলো তার মনের দেবতা সমরবাবুর নামে। তার নিজের ছেলেও এই কাজ করতে পারেনি।
দিকে দিকে সমর নিবাসের নাম ছড়িয়ে গেলো। দান আসতে লাগল প্রচুর। সুনীল টোটো আশ্রমে রাখে। আরো চারটি টোটো কিনে সে চারটি বেকার ছেলেকে কাজ দিয়েছে। আর সমরবাবুর দেওয়া টোটো দান করেছে তার পাড়ার একটি গরিব ছেলেকে।
সুনীলের পাড়ার ক্লাবে নেতাজি জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। সভাপতি হয়েছে সুনীল। সুনীল বলছে, নেতাজি আমাদের জন্য জীবন দিয়েছেন। সমাজের সকল মানুষের জন্য। আসুন সবাই আমরা আজ গাছ লাগাই, তার সম্মানে। প্রচুর গাছের চারা তার নির্দেশে এসেছে। সেগুলো গ্রামের চারদিকে লাগান হল। গ্রামের পথে পথে গাওয়া হোলো গাছ লাগানোর গান।
সুনীল নিজের হাতে সমর নিবাসের আশেপাশে অনেক গাছ লাগালো। অনাথ আশ্রমের সবাই হাত লাগালো।
এইসব কাজ করছে। হঠাৎ বাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে এল বাড়ির কাজের মেয়েটা। সে বলছে, সুনীলদা, তাড়াতাড়ি বাড়ি আসুন।
--- কেন রে?
--- মা কেমন করছেন।
কয়েকদিন ধরেই মায়ের শরীর খারাপ। তাই মা নিজেই কাজের মেয়ে রুমাকে রেখেছেন। রুমার কথা শুনেই সুনীল বাড়ি গেলো। তার চোখে জল। মাকে দেখে তার চিন্তা হোলো। ডাক্তার ডাকতে মানা করলেন মা। মা বললেন, আর সময় নেই। তোর বাবা ডাকছেন। এবার যাবো। তবে যাবার আগে আমি এই রুমার হাত তোর হাতে দিলাম। ও খুব ভাল মেয়ে। তোরা বিয়ে করে সুখী হলে আমি শান্তি পাবো। তুই আমাকে কথা দে।
সুনীল বললো, কথা দিলাম।
তারপর সুনীলের মা চলে গেলেন ধারাধাম থেকে। সামনে সুনীল আর রুমা। এক নতুন জীবনের পাঠ মা দিয়ে গেলেন তাকে। মায়ের পায়ে মাথা রেখে কাদতে লাগল সুনীল।
এবার মায়ের শ্রাদ্ধ মিটে গেলো। কয়েক মাস পরে রুমাকে বিয়ে করলো সুনীল। পাড়ার সবাই খুব আনন্দ করলো বিয়েতে। বাপ-মা মরা মেয়েটা খুব ভাল। সকলের প্রিয় রুমা এখন সমাজসেবকের স্ত্রী। তাকে সকলে প্রথম প্রথম কাজের মেয়ে হিসাবেই চিনত। কিন্তু সুনীলের মা জানতে পেরেছিলেন তার ভেতরের কথা। রুমা কাজ করে যা রোজগার করতো তার অনেকটাই সুনীলের দানের বাক্সে দান করতো। পাড়ার লোকেরা সুনীল মায়ের কানে কথাটা তুলেছিলো। কিন্তু সুনীল জানত না। রুমার জীবনে ছোটো থেকেই সুনীল আদর্শ পুরুষ। তার বাবা জন্মের আগে মারা গেছেন। আর মা তাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। দাইবুড়ি তাকে ছোটো থেকে মানুষ করেছেন। এই দাইবুড়ি পরে দাতাবুড়ি হয়েছিলেন। তিনি তার সবকিছু মানুষের জন্য দান করে গেছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি সমর নিবাসে দান করেছেন। তিনি রুমাকে বলতেন, কোনো কাজ ছোটো নয়। খেটে খাবি। তার সুখ আলাদা।
রুমা সুনীলকে ছোট থেকে মনেপ্রাণে ভালোবাসত। কিন্তু সে কথা কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারে নি। সে খেতে গিয়ে ভাতের থালায় সুনীলের ছবি দেখতে পেত। নীল আকাশে দেখত সুনীলের ছবি। কিন্তু সে ভারতবর্ষের মেয়ে। বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। নীরব প্রেমের শক্তি তার দেহ মনে।
তার মনের কথা দাইমা জানতেন। তাই রুমার সঙ্গে পরামর্শ করে দাতাবুড়ি মরে গেলেন। কিন্তু সুনীলের মায়ের অন্তর জানতে পেরেছিলো রুমার অন্তরের কথা। তাই তিনি তাকে কাজের মেয়ে হিসাবে বাড়িতে এনে পুত্রবধু করে নিলেন ছেড়ে যাবার আগে।
বিয়ের পরে সুনীল বললো রুমাকে, তুমি কি একটা ছেলের মা হতে চাও? আমার কিন্তু অনেক ছেলে আছে। রুমা উত্তর দিলো, আমি তোমার ছেলেমেয়ের দেখাশোনা কোরবো। তারাই আমার নিজের সন্তান।
সুনীল এই উত্তর আশা করেছিলো তার কাছ থেকে। তার অন্তরে বেশ কিছুটা জায়গা রুমা ঘিরে নিল হৃদয় জুড়ে। সে বুঝতে পারলো, তার মা তাকে সঠিক জীবনসাথী খুঁজে দিয়েছেন। মায়ের স্মৃতি জুড়ে মায়ের মাটির বারান্দাকোঠা। এখানে বাবা-মায়ের আত্মা শান্তিতে আছে। হৃদ মাঝারে, কোঠার মাঝে তাদের বন্দি করেছে রুমা আর সুনীল। তাই সেই কোঠার নাম রাখল বন্দিপাখি...
HOME
এই লেখাটা শেয়ার করুন