ছোটোগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন বইমেলা সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

জেলিফিশ 
সদানন্দ সিংহ

সামনে সফেন সমুদ্র। বালির ওপর সৌ খেলা করছিল। বৃতা ছোট ছোট ঝিনুক কুড়োচ্ছিল। বালি এখনো তপ্ত হয়ে ওঠেনি। গর্জনরত সমুদ্রের ঢেউগুলি ছোট হতে হতে তীরে আছড়ে পড়ছে। পমা আর আমি কাছাকাছি বসে সৌ আর বৃতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলাম। ঢেউয়ের জল আমাদের স্পর্শ করতে পারছিল না। অথচ গতকাল বিকেলে সমুদ্রের জল আমাদের এই জায়গা ছাড়িয়ে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিল।
বৃতাকে আরো এগিয়ে যেতে দেখে পমা চেঁচিয়ে বলল, বৃতা, আর দূরে যাস না।

বাবা কিন্তু বলেছিলেন, কি হবে আর সুমুদ্র দেখে ! আমি উত্তর দিয়েছিলাম, অনেক কিছু। এই অনেক কিছু যে কি সেটা বাবা আমাকে আর জিজ্ঞেস করেন নি বা আমিও বলি নি। আমি জানি বাবা কোনদিন সমুদ্র দেখেন নি এবং হয়ত বৃদ্ধ বয়সে সমুদ্র দেখার আর সাধও নেই।
আমিও একজন ছাপোষা মানুষ। কিন্তু স্বপ্ন দেখি অনেক। স্বপ্নের সমুদ্র আমাকে অনেকবার ভাসিয়েছে। সমুদ্র যেন আমাকে নেশার মত টানতো। সমুদ্রের ঢেউ, ঢেউয়ের গর্জন, বালুকারাশি, বালুকারশির ওপর ঢেউয়ের আসা যাওয়া ইত্যাদি সব আমাকে আকর্ষণ করে যেত।
হয়তো অদেখা সব কিছুর ওপর আকর্ষণটা সবারই। বিশেষ করে সমুদ্রের। সমুদ্রের কথা বলতেই পমা এক পায়ে খাড়া। তারপর একদিন পরিকল্পনা মত এক বছরের ছেলে সৌ আর পাঁচ বছরের মেয়ে বৃতাকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম।

সৌ বসে খেলছিল। এবার সে উঠে দাঁড়াল। আর বালির ওপর দৌড়োতে দৌড়োতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিদির দিকে দৌড়ে গেল।
পমা আবার চেঁচাল, বৃতা, ভাইকে ধরে রাখিস। ছাড়িস না।
সমুদ্রের তীরে অনেক মানুষ একা বা সঙ্গীসহ বসে রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই সাদা চামড়ার বিদেশী মানুষ। পুরীর চক্রতীর্থ রোডের এই সমুদ্র সৈকতে হৈ-হল্লোড় নেই স্বর্গোদ্বার সমুদ্র সৈকতের মত। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে নির্জনতাসহ বসা যায়।
এসেছিলাম ভুবনেশ্বর হয়ে। ওখানে একদিন থেকে উদয়গিরি,খণ্ডগিরি,নন্দনকানন ইত্যাদি জায়গাগুলি দেখে নিয়ে পুরীতে এসে চক্রতীর্থ রোডের এক হোটেলে দশদিনের জন্য একটা ঘর নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল প্রাণভরে সমুদ্র দেখবো, সমুদ্রস্নান করবো, বালির ওপর অনেকদূর হেঁটে যাবো। এর মধ্যে একদিন গেলাম কোণারক, আরেকদিন পুরী দর্শন। তারপর শুধু সমুদ্র আর সমুদ্র। প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত। বালির ওপর ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বারবার দৌড়ে গেছি আমরা। প্রতিদিন সমুদ্রস্নান করেছি এক উচ্ছ্বাস নিয়ে। সমুদ্রের তীরে তীরে বালির ওপর দিয়ে হেঁটে গেছি অনেক দূরে। কিন্তু চার-পাঁচদিন পর মনে হল হাঁটতে হাঁটতে আমরা যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আরো এক-দুদিন যাবার পর বুঝতে পারলাম আমরা সত্যিই এখন ক্লান্ত। সমুদ্র যেন ধীরে ধীরে আমাদের গ্রাস করছিল। ক্রমে ক্রমে একসময় আমার মনে হল ঢেউয়ের গর্জন যেন ঝড়ের হুঙ্কার। বুঝতে পারলাম কাছে থাকতে থাকতে একসময় সবকিছুর গুরুত্ব একদিন কমে যায়। বিশাল কোন জিনিষকেও ক্ষুদ্র বলে মনে হয়।
হাতে কোন কাজ নেই তাই প্রাতরাশ সেরে হোটেল থেকে বের হয়ে সমুদ্রের দিকে আবার চলেছি। সমুদ্রের তীরে বসাই এখন আমাদের কাজ। হোটেলের আমাদের পাশের রুমের জার্মান ভদ্রমহিলা গুড মর্ণিং বলে এগিয়ে চলে গেলেন।
বালির ওপর বসে পড়লাম। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পমাও ঝিনুক কুড়োতে লেগে গেছে। বাইনোকুলার বের করে আমি চারিদিক দেখতে লাগলাম। এক জায়গায় দেখতে পেলাম বিকিনি পরে এক বিদেশিনী শুয়ে আছে। বিদেশিনীর শরীরের খোলা অংশগুলি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বাইনোকুলার থেকে চোখ সরাতেই দেখি পমা আমাকে লক্ষ করছে। আমি আবার অন্যদিকে দেখতে লাগলাম। এইসময় আমি দেখলাম একটা বিদেশী লোক সমুদ্রে নামছে। আস্তে আস্তে লোকটা হাঁটুজল, তারপর কোমরজল, শেষে বুকজলে নেমে একটা ঝাঁপ দিয়ে সমুদ্রের দিকে সাঁতরে এগোতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ডুব মেরে ঢেউ কাটিয়ে লোকটা সমুদ্রের অনেক মাঝে চলে গেছে। একসময় সমুদ্রের মাঝে আমি তাকে হারিয়ে ফেললাম। বাইনোকুলার দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে দেখতে পেলামনা। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম লোকটি কিছুক্ষণ বাদেই তীরে ফিরে আসবে। আগেও আমি দেখেছি কয়েকজন বিদেশী লোককে সাঁতার কেটে এগিয়ে গেছে এবং পরে আবার ফিরে এসেছে। লোকগুলির কাছে এটা একটা খেলার মতন।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম লোকটি কখন ফিরে আসবে। এবার কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল, লোকটি ফিরেই আসছে না। মাঠায় চিন্তা এল, ডুবে যায় নি তো ? এইসময় আমি দেখলাম লোকটা ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে ফিরে আসছে। তীরে এসেই ও বালির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।

আগামীকাল চলে যাবো। যাবার আগে বিদেশী লোকগুলির মত একবার ওভাবে সাঁতার কাটার নেশায় আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসল। বাইনোকুলারে দেখে দেখে আমি ওদের টেকনিকটা শিখে ফেলেছি। তাছাড়া আমি ভালোই সাঁতার জানি। ডুব দিয়ে দিয়ে ঢেউ কাটিয়ে সমুদ্রের মাঝে চলে যাবো, তারপর ঢেউয়ের মাথায় নাচতে নাচতে আবার তীরে ফিরে আসবো। কোন অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়।
স্নানের জন্যে প্রস্তুত হয়েই বেরিয়েছিলাম। জামাকাপড় খুলে ফেললাম। গায়ে আমার শুধুমাত্র একটা সর্ট প্যান্ট। আমার দিকে চেয়ে পমা বলল, বেশি দূরে যেও না কিন্তু।
আমাকে সমুদ্রের দিকে এগোতে দেখে বৃতা ভাইকে নিয়ে দৌড়ে এসে বলল, বাবা আমিও যাবো।
বললাম, তোরা এখন মায়ের কাছে বস। আমি কিছুক্ষণ পরে নিয়ে যাবো তোদের।
আমি ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলে নামতে লাগলাম। ছোট ছোট ঢেউগুলি লাফ মেরে পার হলাম। একটা বড় ঢেউ এলে আমি ডুব দিয়ে কাটিয়ে গেলাম। আবার আরেকটা ঢেউ এলে আগের মত ডুব দিয়ে কাটিয়ে গেলাম। এইভাবে ঢেউ কাটিয়ে কাটিয়ে আমি সমুদ্রের দিকে যেতে থাকলাম। একটা খেলার নেশায় যেন আমাকে পেয়ে বসল। মনে হল, কত সহজ এই খেলা। আমি সমুদ্রের দিকে যেতেই থাকলাম।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল, আমার চারিদিক ঘিরে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। রাশি রাশি ঢেউ। সমুদ্রের পার আর আমার নজরে এলো না। পারটা যে কোনদিকে আমি বুঝতেই পারলাম না। চারিদিকে সমুদ্রের ভয়ংকর গর্জন। এরি মাঝে একটা ক্ষীণ কণ্ঠ কানে আসে, বা-বা। আওয়াজটা যে কোনদিক থেকে আসছে বুঝতেই পারলাম না। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। সমুদ্রের বিশালতার মাঝে এক খড়কুটোর মত খাবি খেতে লাগলাম। যেন এক মৃত্যু গহ্বরে আটকে গেছি। সাহায্য করার কেউ নেই। ঢেউয়ের মাঝে আমি ভাসছি আর ডুব দিচ্ছি। আবার ভাসছি। আবার ক্ষীণ কণ্ঠ কানে এলো, বা-বা। বুঝতে পারলাম, বৃতা আমাকে ডাকছে। ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মত আমার দম আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছিল।
এইসময় একটা জেলিফিশ যেন আমার দিকে তেড়ে এলো। আমি তাই হঠাৎ ঢেউয়ের মাথায় একটা লাফ দিলাম। ঢেউ আমাকে আছড়ে ফেলল। কিছু নোনা জল আমার পেটে চলে গেল। আরেকটা ঢেউ এল। আবার আমি ঢেউয়ের মাথায় লাফ দিলাম। আমি আবার আছড়ে পড়লাম। এইভাবে চলার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রের তীর আমার নজরে এল। আমি আবার ঢেউয়ের মাথায় লাফ দিলাম।
শেষে আমি বালির ওপর আছড়ে পড়লাম। আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। পমা,বৃতা আর সৌ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওদের কাছে গিয়ে বালির ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। পমার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। পমা রাগত স্বরে বলল, তোমাকে আর দেখাই যাচ্ছিল না; আমাদের যে কি চিন্তা হচ্ছিল। কেন তুমি এতো দূরে গেলে ? তোমার কিছু হলে আমরা কি করতে পারতাম ? আমাদের অবস্থা কি হত তখন ?
আমি উঠে বসলাম। সৌ আর বৃতাকে একটু আদর করলাম। তারপর একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, জান পমা, আমি এতক্ষণ একটা পাগলামির খেলায় মেতে উঠেছিলাম। আর যে খেলাতে হার-জিৎ নেই সে খেলার কোন মূল্যও নেই। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়া। এভাবে আমি কোনদিন সমুদ্রে নামব না, তুমি দেখো।
বৃতা এইসময় হঠাৎ একটু চেঁচিয়ে উঠলো, বাবা তোমার পিঠে একটা স্টার লেগে আছে !
সঙ্গে সঙ্গেই পমা বলল, দেখি দেখি। তাই তো, একটা জেলিফিশ মনে হচ্ছে। তবে মৃত।
আমি বেশ অবাক হলাম, মৃত জেলিফিশ !
আমি ঠিক বুঝে উঠতেই পারলাম না ওটা কোত্থেকে এল। আমার পিঠে একটা মরা জেলিফিশ ! আমার গা-টা ঘিন ঘিন করে উঠল। কোথায় যেন পড়েছিলাম, জেলিফিশ নাকি বিষাক্ত। এই বিষ কি এখন আমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে ? উঠে দাঁড়িয়ে আমি দৌড়ে আবার সমুদ্রে ঝাঁপ দিলাম।
                                                                                                                                     HOME

SHARE THIS PAGE!