ছোটোগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন বইমেলা সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

অযান্ত্রিক রিলোডেড
বৈদূর্য্য সরকার

ফ্লপি ড্রাইভের যুগ থেকে আজকের ওয়াইফাই বিবর্তনের পুরোটাই নিজের চোখে দেখেছে তুষার। যথেষ্ট ডিগ্রি না থাকলেও লম্বা অভিজ্ঞতার জোরে আজ ও প্রজেক্ট ম্যানেজার। এখন জয়েন করা ইঞ্জিনিয়ারদের আন্দাজে ওর মাইনে তেমন কিছু না হলেও দিব্যি চলে যায়। মফস্বলের ছেলে বলে নিজস্ব গাড়িবাড়ির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। ও বিশ্বাস করে মরে যাওয়াটা খুব সাধারণ একটা ইভেন্ট হবে – কোনও পিছুটান নেই, শুধু একটা অখ্যাত কোম্পানির ডেটাবেসে বা ডিজাইনে থেকে যাবে ওর নাম। ওর প্রথম বসের কাছে শেখা একটা কথা ও সবসময় মনে রাখে – “টেকনোক্র্যাটের কোনও ছলচাতুরির ক্ষমতা নেই... সব সত্যি থেকে যায় যন্ত্রের পেটে”। শেষের দিকে উনি বলতেন, “বেশ কিছুদিনের পর যন্ত্ররাও একটু করে কম্যুনিকেট করবে... তোমাকে বুঝবে, তুমিও ওদের বুঝতে পারবে”।
শুনে তখন সবাই হাসাহাসি করলেও এখন তুষারের মনে হয় যন্ত্রকে সত্যিই ও একটু একটু করে বুঝতে পারে আজকাল। সার্ভারে একটা এন্টার দিতে দেরী হলে মেশিনও যেন একটু স্লো হয়ে যায়। অভিমানী প্রেমিকার মতো খুনসুটি করে। যদিও সেসব কাউকে বলা যায় না। এমনিতে ওকে সবাই আড়ালে পাগল ছাগল বলে। কারণ প্রজেক্টের সময় রাত একটা দু’টো অব্দি অফিসে থেকে আবার পরদিন আটটায় চেম্বারে ঢোকে। এর’ম ম্যানেজার মাথার ওপর থাকলে যা হয় - সবার সুতো বেরিয়ে যায়। অথচ তুষারের কোনও ক্লান্তি নেই। ঠান্ডা চেম্বারটাকে ওর সবথেকে কমফোর্টেবল জায়গা বলে মনে হয়। টপ ম্যানেজমেন্ট পেছনে হাসাহাসি করলেও তারা জানে গত দশ বছর যাবতীয় প্রজেক্ট উতরে দেওয়া লোককে চটিয়ে লাভ নেই।
তুষার যখন কোম্পানিতে জয়েন করেছিল, এটা একটা সাদামাটা মেক্যানিকাল ইন্সট্রুমেন্টের কোম্পানি ছিল। কিন্তু সময়ের পালস্ বুঝেছিলেন মিঃ সেন। তখনকার ম্যানেজিং ডিরেক্টার। তুষারদের মতো ছ’জনকে নিয়ে আইটি ইউনিট চালু হয়। ওনারই উৎসাহে ও চাকরির সাথে চাটার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে। তখনও অবশ্য অন্যান্য ইউনিট হেডরা তুষারদের গুরুত্ব দিত না – মালিকের খেয়াল বলে উড়িয়ে দিত।
নতুন সহস্রাব্দে দেশ জুড়ে শুরু হওয়া আইটি রমরমার যুগে দু’হাজার সাল থেকে আইটি-র আলাদা সেটআপ তৈরি হয়। সেখান থেকেই এ কোম্পানি। প্রথম থেকে আছে বলেই নেটওয়ার্কের আইপি থেকে শুরু করে পুরো টেকনিক্যাল ব্যাপারটা তুষারের ব্রেনে ম্যাপ করা আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বার্থপরের মতো ও কিছু ট্রিকস অন্যদের জানাতে চায়নি। মিঃ সেনের পর ওনার ছেলে এমডি হয়ে তুষারকে কখনও ঘাঁটানোর চেষ্টা করেনি। তার একটা কারণ ছিল – তুষার ওর বাবার মনোনীত। দ্বিতীয়ত, একটু একটু করে বড় হওয়া কোম্পানির ফ্লোরে একটা বড় সময় কাটানোর পরেও ও লয়্যাল। উইকএন্ডে সামান্য মদ, কাজের নেশা আর প্রথম যৌবনের অবশেসন রূপসা – এর বাইরে তুষারের চরিত্রে কোনও অদলবদল নেই। এর’ম লোক বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এক জায়গায় থেকে যেতে পছন্দ করে। ফলে ওকে কোম্পানি যেমন অনেক কিছু দিয়েছে, তুষারও তার সবটা দিয়ে দিয়েছে কোম্পানিকে।

মফস্বলের ছেলে তুষারের কলকাতায় পড়তে আসাটা কোনও বিশেষ ব্যাপার না হলেও থার্ড ইয়ারে বাবা মারা যাওয়া, সদ্যবিবাহিত দিদির শ্বশুর বাড়িতে লোক লৌকিকতা বা মাকে টাকা পাঠিয়ে কলকাতায় টিকে থাকা খুব সহজ ছিল না তুষারের পক্ষে। সেই কঠিন লড়াইটা ক’বছর লড়তে হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক শখ আহ্লাদগুলো বাকী পড়ে গেছে। তবু তারই মধ্যে রূপসার সাহচর্য অমুল্য ছিল ওর কাছে। যে কারণেই হোক রূপসা ওকে পছন্দ করত। কলেজে পড়ার সময় নাইন্টিন ফর্টিটু লাভ স্টোরির গান শুনিয়ে তুষার ওকে বলেছিল ‘আইস্তা আইস্তা বাড়তা নেশা ...’। রূপসা হেসে উত্তর দিত, “তুই ভুল জায়গায় ভুল কথাটা বলিস”। এখানে সিকোয়েন্সটা হবে- “মুঝকো পাতা হ্যায়, তুমকো পাতা হ্যায়”। তুষারের ব্যস এক রূপসা ছিল। কিন্তু দুজনেই জানতো এই আটপৌরে সম্পর্কের কোনও পরিণতি নেই। সব দিক থেকে সাধারণ তুষার তখন চাকরির চেষ্টা করছে, রূপসাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়তে হল সরকারি অফিসার বিকাশবাবুর সাথে। পরে ওনার সাথে তুষারের দু’চারবার কথা হয়েছিল। যদিও ততদিনে তুষার স্বাভাবিক নিয়মে সবকিছু মেনে নিয়েছে। কেননা ওর কাছে ভদ্রভাবে বাঁচার লড়াইটাই ছিল প্রধান।
প্রায় পাঁচ বছর বাদে হঠাৎ রূপসার সাথে দেখা হয়েছিল ধর্মতলায়। দু’জনেই চোখ মুখের উত্তেজনা চেপে ফোন নম্বর বিনিময় করে। আস্তে আস্তে পুরনো ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে যদিও দুজনেরই মধ্য তিরিশ। রূপসা বারবার তুষারকে সেটল করতে বলতো। তুষার বুঝতে পারতো রূপসা ওর জীবনটা কল্পনামাফিক রাস্তায় হাঁটতে পারেনি। তখন জীবনে কিছুটা স্থিরতা, দুএকটা চুলে পাক...শরীরে চর্বির ছোঁয়া। রূপসারও শীতল দাম্পত্যে বা দায়দায়িত্বে দ্রুত বয়স বেড়েছে। কলেজজীবনের মতো না হলেও, একটা মায়া যেন চাগাড় দিয়ে উঠেছিল দু’জনের। শারীরিক তৃপ্তি থেকে পালানো আবার ধরা পড়া ... তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল একটা দীর্ঘকালীন মায়া। একটা বয়সের পর যে কারণে পুরুষের দরকার হয়।
সস্তা বারে মদ খাওয়ার পর তুষারের আজকাল রূপসাকে দরকার হয় খুব। কখনও পায় কখনও পায় না। এ বয়সে শুধু যে শরীরের টান – মানতে চায় না তুষার। রানটাইম এররের মতো একটা ব্যাপার যেন, ধরা না গেলেও যন্ত্রণা থেকে যায়। রূপসার দিক থেকেও সংসারে জড়িয়ে পড়ার পর সম্পর্কের জন্য সবকিছু ছেড়ে আসা সহজ নয়। কিন্তু নিজেকে বিকাশের নিস্ফল আলিঙ্গনে ধরে রাখতে পারেনি। অক্ষমতার কারণে ন্যুব্জ বিকাশ না বোঝার ভান করে থাকে আজকাল।

প্রজেক্ট হেড হওয়ার পর চেম্বার ছাড়া একটা সর্বক্ষণের গাড়িও পেয়েছিল তুষার। গাড়িটা পাঁচ বছরের পুরনো, ড্রাইভারও একই। কারণ ড্রাইভার সুবল তুষারের গতিবিধি খুব ভাল করে জানে । শনিবার সন্ধেয় বারে যায় ও। ওয়েটাররা সব চেনা, তুষারের ব্র্যান্ডও জানে ওরা। এটাও জানে কোণের একটা টেবিলে বসে, কাঁচা ছেলেপুলের ভিড় এড়িয়ে চলে। রূপসাকে নিয়ে যদিও দু’চারবার বড় জায়গায় গেছিল, কিন্তু নিজের জন্য বেশী খরচ করতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া এখানে মাঝবয়সী লোকেরাই বেশী আসে।
যদিও এই তুষার একটু একটু করে বদলেছে। রূপসা বুঝতে পারতো পুরুষ হয়ে ওঠা তুষারকে কলেজের ছেলেটার সাথে মেলানোর চেষ্টা বৃথা। তুষারের মা মারা যাওয়ার পর দিদি বা আত্মীয়স্বজনের সাথে ক্রমশ যোগাযোগ কমে যাওয়ার কারণ ছিল ব্যবসায়িক। সামান্য চাকরি করা তুষার অনেকটা আনওয়ান্টেড ছিল সবার কাছেই। সেটাই মেনটেন করেছে ও। অবস্থা ফিরলেও কারুর সাথে যোগাযোগ রাখেনি। রূপসার ক্ষেত্রেও সের’ম হওয়ার সম্ভবনা ছিল। তুষার কোনোদিনই দিওয়ানা টাইপের ছেলে ছিল না । জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তাকে মেলোড্রামা থেকে দূরে রাখলেও রূপসার ক্ষেত্রেই তুষার যেন অস্বাভাবিকভাবেই আবেগপ্রবণ।

চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে ঈষৎ পৃথুলা রূপসা তাই থেকে গেছে। তুষার উত্তেজিত হয়নি আবার নিঃস্পৃহও ছিল না। সময় কাটাচ্ছে একটু একটু করে। এখন ও বরং বুঝতে পারে রূপসার থেকেও মেশিন, সার্ভাররুমে তারের জঙ্গল, সুইচের কনফিগারেশান আর কোডের সমুদ্রে তুষার যেন বেশী সাবলীল। শেষের কয়েকবার রূপসার সাথে অসফল মিলনে কাতর হয়ে দেখত ওর সার্ভার যেন বেগরবাই শুরু করেছে। অন্য কেউ সামলাতে পারতো না। ওকে ছুটতে হত। অথচ পরদিন থেকেই ‘কেমন দিলাম’ মার্কা মুখে সব ঠিকঠাক ফাংশানিং।
তুষারের মাঝে মাঝে মনে হত - ও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে! নির্ধারিত সময়মতো এন্টারের অদৃশ্য চাপে লোড হতে থাকা কোডের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতো। মনে হত, মেশিনের ভাষা যেন ওর কাছে সহজ হয়ে আসছে। স্পষ্ট বুঝতে পারতো, সার্ভার বলছে – আমি তোমার মা, প্রেমিকা, তোমার সন্তান ...সবকিছু। তুষার পাগলের মতো বলত –“আমি ধারণ করে আছি এই সিস্টেম”।
*
এ গল্প যেভাবে শেষ হয় – এক্ষেত্রে কিন্তু সের’ম কিছু হল না। তুষার রিহ্যাবে যায়নি। কোনও প্রয়োজন হয়নি। দেখলেও কেউ তাকে চিনতে পারবে না। সেক্টর ফাইভ থেকে বেরনো লড়ঝড়ে গাড়িতে তাকে বসে থাকা দেখা যেতে পারে। মেট্রোয় আপনার পাশে বসে যে হোয়াটসঅ্যাপ করছে – তার নামও তুষার হতে পারে। হে পাঠক! চাঁদনির ছোটখাটো সার্ভিস সেন্টারে ওর খোঁজ আপনি না পেলেও পাইরেটেড ভার্সান নিশ্চিত খুঁজে পাবেন।


                                                                                                                                     HOME

SHARE THIS PAGE!