অণুগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন বইমেলা সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

জমিন 
যুগান্তর মিত্র

-- এট্টা কতা কবো? 
-- বল্, শুনি।
-- কইকি, তোমার শইলটা একন ভালো যাতিছে না। সবদিন কামকাজে যাতি পারো না। কামও পাও না। অ্যামতে আর কদ্দিন চলবে ?
-- তুই কী কইতে চাস ক'তো!
-- আমি যদি মণ্ডলবাড়ি ধানঝাড়ার কাজ নিই এক বেলা, তয় …
কথাটা শেষ করতে দেয় না পতিত। কাজ থেকে ফিরে তার সত্যিই শরীরটা আর বইছিল না। ক'দিন ধরেই এমন হচ্ছে। হাঁপ ধরে যায়। তাই বিকেলে কোনোরকমে গা ধুয়ে এসে দুটি ভাত খায়। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সেইসময় বউ ময়না এসে মাথার কাছে বসে। পতিত তখন মাথাটা বালিশের থেকে টেনে এসে ময়নার কোলে রাখে। আর বউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
আজও তেমনই চলছিল। এমন সময় ময়নার কাজে যাওয়ার কথা শুনে মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠে গেলো পতিতের। প্রথমে চোখ বন্ধ করে ছিল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
-- তরে আমি ঠিকমতো ভাতকাপড় দিতি পারি না। তা'বলি পরের ঠেনে কামে পাঠামু? তুই এ কী কস ময়না ?
-- তয় হইছে কি শুনি? আমি তো আর মলি বউয়ের মতোন ইজ্জত বেচি দিতিছি না!
-- চুপ যা ময়না। একদম বেশি কথা কবি না ক'লাম।

ময়না জানে এরপর আর কথা বাড়ালে স্বামীর হাতে চড়চাপড় খেতে হবে। গালমন্দ তো আছেই। তাই চুপ করে যায়।
পতিত বউয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে খোলা দরজার আলো এফোঁড়ওফোঁড় করে উঠোনে তাকায়। উদাস সেই চাউনি নিয়ে একমনে বলে যায় কথা। যেন ময়না নয়, সে নিজেকেই বলছে।
-- কী সব উন্নতিফুন্নতি হইব বলি জমিজিরেত যেটুকুন ছেল নে নিল। ট্যাহাপয়সা যা দেল সে আর কত্টুকু? তার মদ্যি কিচু নেলো পাণ্ডারা। কিচু ট্যাহায় চাঁচড়ের ঘর ভাঙি কিচুটা ইটের দালান উটালাম। বাকি ট্যাহা কেমতে কেমতে ফুরায়ে গেলো। একন রাজমিস্ত্রির জোগালি খাটি। পইশ্রম হলিও আমি দেকি দুবেলা য্যান খাওন জোটে। কিন্তুক আমি ভাবি নাই তরে কামে পাটামু। এর মইধ্যে যদি পোলাপাইন কিচু থাকত তয় আরও আতান্তরে পড়তাম।

দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো জামার পকেট থেকে বিড়ি দেশলাই বের করে ধরায় আর উঠোনে নেমে আসে। 

ময়না আতঙ্কিত হয়। স্বামী তার ভালোমন্দ কিছু করে ফেলবে না তো ! বোঝে সে স্বামীর মনের উপর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গোলাভরা না-হলেও ধান কম উঠত না ঘরে। আর আজ কিচ্ছু নেই তাদের।
-- ঘরে আসো। আমি আর কুনুদিন কামকাজের কতা কবো না ক'লাম। আমার মাতা খাও। ঘরে আসো।
কিছু একটা ভেবে আধখাওয়া বিড়ি ছুঁড়ে ঘরে ঢোকে পতিত। মণ্ডলবাড়ির বাবু বড়ো ভালোমানুষ। জানে পতিত। তবু মন মানে না।

অনেক রাতে বিছানা ছেড়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় পতিত। কিন্তু ময়নার চোখেও যে ঘুম নেই সেকথা জানে শুধু ময়নাই। পা টিপে টিপে পিছু নেয় সে। পিছন পিছন পাঁচিল দেওয়া মাঠের মধ্যে ঢুকে যাওয়া পতিতকে অনুসরণ করে। অন্ধকার চিরে দুজনেই তফাতে এগোতে এগোতে মাঝমাঠে এসে দাঁড়ায়।
-- আমারে ক্ষমা করিস ময়না। আমি তর ভালো সোয়ামী হতি পারি নাই রে ময়না। ওহ্ ভগমান, আমারে উঠায়ে নাও। আমি ময়নার কাম করা দেকতি চাই না …

আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে পতিত। ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা পতিতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ময়না।

দুই ছায়ার সেই আকুল কান্না শুনতে পায় মাটি, যা ছিল তাদের একসময়ের চাষের জমি। শুনতে পায় আকাশের তারা, অন্ধকার চরাচর। বাতাস সেই হাহাকার বহন করে চলে আপন খেয়ালে।

পিছনে পড়ে থাকে শূন্য ঘরগেরস্থালি।
                                                                                                                                     HOME

SHARE THIS PAGE!