বর্মার রাজা মণিপুর দখল করে রেখেছিল সাত বছর, ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। তখন প্রচুর মণিপুরি মণিপুর ত্যাগ করে ত্রিপুরা, বাংলাদেশ, কাছাড় এবং আসামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আগে ত্রিপুরারাজের সাথে মণিপুরের সম্পর্ক ভাল ছিল না। খ্রীষ্টাব্দ ১৫৩৩, ১৬৩৪, ১৬৯৬ এবং ১৭২৪ সালে চারবার যুদ্ধ হয়েছিল মণিপুর ও ত্রিপুরার মধ্যে। তবে প্রথম সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৬০৯ সালে যেখানে ত্রিপুরার রাজা মণিপুরের এক রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। ঐ সময় থেকেই সূচনা হয়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যে মণিপুরিদের বসবাস। [There were wars between Manipur and Tripura in 1533, 1634, 1696 and 1724. Tripura is adjacent to East Bengal. So people who migrated from Bengal to Manipur often stayed in Tripura for some time and reached Manipur. Manipur used to buy elephants from Tripura also. Elephants from Tripura often bore Sanskrit name or names derived from Sanskrit. One such elephant was Mukta (pearl). Another was Hera (diamond). Marriages between kings of Tripura and women of Manipur was not frequent. But there was one such marriage in 1609. In that year a Manipuri woman of Akoijam family married a king of Tripura.--- History of Medieval Manipur (Part-3), R.K.Jhalajit Singh]
তখন মণিপুরের রাজকন্যার সাথে বেশ কিছু মণিপুরি অনুচর রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি জায়গায় বসতিস্থাপন শুরু করেছিলেন। চারবার যুদ্ধের পর শেষপর্যন্ত সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। যার ফলে বার্মিজ আক্রমণের পর মণিপুরিদের ত্রিপুরায় বসবাস খুব সহজেই হয়ে গিয়েছিল। মণিপুরিরা মণিপুরের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার প্রায় দু’শ বছর অতিক্রান্ত হবার পর স্বাভাবিক ভাবেই মূল ভূখণ্ডের সাথে বিছিন্ন থাকার দরুন মণিপুরে যেসব উৎসব পালিত হয় তার সমস্ত হয়তো পালিত হয় না, কিন্তু পালন করার চেষ্টা করা হয়। তেমনই একটি উৎসব হল লাইহারাওবা উৎসব। তবে এই উৎসব পালনের জন্যে আচার-অনুষ্ঠানের পদ্ধতি জানা মাইবা-মাইবী ত্রিপুরাতে নেই বলে ইদানীং মণিপুর থেকে মাইবা-মাইবী এনে লাইহারাওবা উৎসব পালিত হচ্ছে। একটা সময় ত্রিপুরাতে এই উৎসব উদ্যাপন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
যখন কোন জাতি বা সম্প্রদায় কোন ধর্মীয় বা কোন ট্র্যাডিশনাল আচার-অনুষ্ঠান বা উভয় দিকটিকে একসঙ্গে উপলক্ষ করে সবাই অংশগ্রহণ করে আনন্দে মেতে উঠে, তাকেই আমরা উৎসব বলতে পারি।
আনন্দ আমাদের জীবনেরই বহিঃপ্রকাশ যা বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। স্বপ্নহীন কোন নিরানন্দ লোক পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচতে পারেনা। তাই উৎসব ব্যাপারটা সেই আদিম যুগ থেকে এখনো চলে আসছে। এর কোনদিন শেষও নেই।
মণিপুরিদের অনেকগুলি উৎসবের মধ্যে লাইহারাওবা উৎসব একটি বহূ প্রাচীন উৎসব। লাইহারাওবা একটি প্রাক্বৈষ্ণব লৌকিক দেবদেবী ভিত্তিক প্রাচীন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, তখনকার জীবনযাত্রার মিথ, লোককাহিনি, প্রাচীন মন্ত্র-তন্ত্র-স্তোত্র, নাচ-গান ইত্যাদি সবের এক ব্যাপক রূপ যা প্রাচীন মণিপুরিদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। মাইবা(পূজারী)-মাইবী(পূজারিনী)-র নানারকম আচার-অনুষ্ঠান এবং জাগোই(নাচ) আর পেনাবাদকের পেনা ও ঈশৈ(গান) লাইহারাওবার প্রধান অঙ্গ। পেনা হচ্ছে বেহালার মত একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র। তাই লাইহারাওবা উৎসব মণিপুরের এক প্রাচীন উৎসব। নৃত্য নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদেরও বক্তব্য যে লাইহারাওবা উৎসবের অঙ্গ মাইবী নৃত্যে যে মুদ্রাগুলি প্রচলিত সেগুলি খ্রীষ্টপূর্ব যুগের।
লাই শব্দের অর্থ হল দেবতা, হারাওবা শব্দের অর্থ হল আনন্দে মেতে ওঠা। এই উৎসবের মাধ্যমে আমরা মণিপুরি সমাজের এক বিবর্তনের রূপ দেখি যেখানে আমরা জানতে পারি সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মূল আহরণ অন্ন-বস্ত্র-ঘরের উপায়গুলি কীভাবে হাসিল হয়েছিল।
লাইহারাওবা নিয়ে দু রকম মতবাদ দেখা যায়। এক, মণিপুরে সর্বপ্রথম এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল কৌব্রু পাহাড়ে। সেই সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত উৎসবে নোংপোক নিংথৌ(দেব) এবং পান্থৈবী(দেবী) অনুপস্থিত ছিলেন, যার ফলে সেই উৎসব ছিল এক অসম্পূর্ণ উৎসব। দুই, আরেক মতবাদ হল এই উৎসব সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরের নোংমাইজিং পাহাড়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে বর্তমান মণিপুরি বা মৈতেই ভাষার পূর্বসূরী হচ্ছে অরিবা ভাষা। মণিপুরি ভাষায় অরিবা শব্দের অর্থ প্রাচীন। বৈষ্ণবধর্মের আগ্রাসনে মণিপুরের রাজা একসময় এইসব অরিবা ভাষায় (প্রাচীন মণিপুরি ভাষায়) লেখা পুঁথিগুলিকে পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং একদিনে প্রায় দু’শর উপর পুঁথি আগুনে নিক্ষিপ্ত করেছিলেন। এটা মণিপুরের লোককাহিনি এবং ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক ক্ষতি বলে স্বীকৃত। কিছু কিছু পুঁথি তখন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই অরিবা ভাষা বর্তমানে অপ্রচলিত এবং এখন এ ভাষায় কেউ কথা বলেনা। যেমন বাংলায় চর্যাপদের, ব্রজবুলি বা সাধু ভাষায় এখন কেউ কথা বলেন না। অরিবা ভাষায় লেখা একটা পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল যার নাম পান্থৈবী খোঙ্গুল। এই পুঁথিটাকে মোইরাংথেম চন্দ্র সিংহ আধুনিক মৈতেই ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। এই বই অনুযায়ী দ্বিতীয় মতটি প্রতিষ্ঠিত। খ্রীষ্টপূর্ব সময়ে রাজা পাখংবা আমলের আরো আগে নোংপোক নিংথৌ(দেব) এবং পান্থৈবী(দেবী) আমলে প্রথম এই উৎসবের সূচনা। পাখংবার রাজত্বকাল আনুমানিক ৩৩ খ্রীষ্টাব্দ (চৈথারেল কুম্বাবা পুঁথি)। মণিপুরের মাইথোলজি অনুযায়ী পাখংবা হচ্ছেন মানুষ ও দেবতার মিশ্রণ।
আবার স্থানের উপর ভিত্তি করে লাইহারাওবা উৎসবকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমন কংলেই হারাওবা, মোইরাং হারাওবা, চাকপা হারাওবা, সেক্মাই হারাওবা, আন্দ্রে হারাওবা, কক্চিং হারাওবা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এইসব স্থানভিত্তিক উৎসবের মূল essence-টা মোটামুটি একই রকমের।
পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে এখনো লৌকিক দেবদেবীরা পূজিত হয়ে থাকেন। লৌকিক দেবদেবীরা আসলে কোন জাতির ধর্মায়নের আগের নিজস্ব এবং আদি দেবতা। বাংলার যেমন শীতলা দেবী, ওলাওঠা দেবী, মনসা দেবী। মনসা দেবীকে নিয়ে তো আবার হিন্দু পুরাণের সাথে যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে। তবে হিন্দু মণিপুরিদের লৌকিক দেবদেবী যেভাবে প্রচুর সংখ্যায় বিরাজমান, সেভাবে সংখ্যার দিক দিয়ে অন্য কোন জাতির দেবদেবী আছে কিনা জানা নেই। মণিপুরিদের প্রধান পুরুষ লৌকিক দেবতারা হলেন অতিয়া শিদাবা, আপ্নবা, আশিবা, পাখংবা, সনামহী, নোংপোক নিংথৌ এবং মহিলা লৌকিক দেবীরা হলেন লৈমারেল শিদাবী, পান্থৈবী। এছাড়াও আরো ৩৬৪ জন লৌকিক দেবদেবী বিরাজমান।
জল মানেই জীবন
জল থেকেই প্রাণ
মায়ের গর্ভেই সুপ্ত প্রাণ
এ জগৎ মায়ের আধার
লাইহারাওবার প্রথম দিনটি শুরু হয় লাই ইকৌবা পর্ব দিয়ে। এজন্যে জলের কিনারেই (সাধারণত পুকুর বা নদীতে) উৎসবের সূচনা হয় দেবতার বন্দনা-প্রার্থনা-আহ্বানের মধ্য দিয়ে। আমার মনে হয়, এ থেকেই ধারণা নেয়া যেতে পারে মনিপুরের সীমানা একসময় সমুদ্রের তীরবর্তী পর্যন্ত ছিল।
তারপর নিয়ম-কানুন আচার-অনুষ্ঠান মেনে উৎসবের পর্ব চলতে থাকে কয়েকদিন ধরে। উৎসবের সময়সীমা সাধারণত ১ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত হয় এবং বেজোড় সংখ্যায়। লাইহারাওবার উৎসবের শুরুও হয় কোন বেজোড় তারিখের দিনে। বেজোড় সংখ্যা সাধারণত ‘অগুন্তি’ শব্দের সিম্বল। ঝাঁক, রাশি, অসংখ্য ইত্যাদি বোঝাতে কোন জোড় সংখ্যার কল্পনা করা হয় না। মনে হয় এই বেজোড় সংখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাহিদা অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়ের প্রাচুর্যের বন্দনাই করা হয়েছে। এই উৎসবে পেনাবাদকের oral literature, মাইবী জাগোইয়ের মাধ্যমে মিথের উপস্থাপনা, মুক্না লমজেল-এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাচীন খেলা, তাংখুল নুরাবী নৃত্য-ড্রামার মাধ্যমে উপজাতিদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা দিয়ে ভরপুর এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে “হোই” আওয়াজ, ফুঙ্গারেল জাগোই এবং থাং জাগোই (তরোয়াল নিয়ে নৃত্য)-এর মধ্য দিয়ে।
লাইহারাওবা উৎসবের appearance যদিও দেবতাদের বর প্রার্থনা, কিন্তু অন্তর্নিহিত ব্যাপারটা এক বিরাট Myths, legends, folklore, oral literature নিয়ে তৈরি যেখানে জগতের উৎপত্তি, প্রাণের উৎপত্তি, মানুষের বসতিস্থাপন, কৃষিকাজ, আশ্রয়স্থল তৈরি, পরিবার-সমাজ গঠন ইত্যাদি নিয়ে উপস্থাপিত এবং সর্বোপরি মৈতেই জাতির সুপ্রাচীন অস্তিত্বের এক জ্বাজল্যমান প্রমাণ।
HOME
SHARE THIS PAGE!