মুক্তগদ্য

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন বইমেলা সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

কবির কাছে আছে
নকুল রায়

কবির কাছে খুচরো পয়সার মতো শব্দ থাকে যা প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। কবিতা একেকটি আস্ত নোট যা খুচরো করলে অনেকগুলো মুদ্রা পাওয়া যায় যা ব্যবহার করে তার জীবনীশক্তির পরিচয় দেন।
শব্দকে নিয়মিত চিনতে এবং জানতে কবিকে বহুপথ হাঁটতে হয়; সব পথেই বাধা-কাঁটা-অমসৃণতা থাকে এবং বিশ্বের সকল মানুষের ক্ষেত্রেই সেটা থাকে – বাধা অতিক্রম করার যে-লড়াই সাধনার সঙ্গে যুক্ত তা মানব প্রজাতিরই। সাধনা বাদ দিলে বাকি যে লড়াই তা সকল প্রাণীজগতেরই আছে; শুধু দেখতে হবে শব্দ ও বাক্যবন্ধনে কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে তা বিভিন্ন কবির বিভিন্নতা আছে বলেই – মানুষই একমাত্র ভাষাকে ব্যবহার করে কবিতা এবং কণ্ঠকে ব্যবহার করে গান গেয়ে উঠতে পারে – এ-বস্তু সাধনাব্যতীত সম্ভব নয়। কবিকে কবিতার মর্মমূল ভেদ করে তাকে নিজের মতো করে লালনপালন করতে হয় বলেই পৃথিবীর সব কবিতাই স্বতন্ত্র। এমনকি বিভিন্ন দুর্বল কবিতার ক্ষেত্রেও তা খাটে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়, দেখা যায় কবির মৃত্যুর পর সেসব কবিতা কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে তুললো; তখন মনে হয় জীবিত সময়কালীন কবিকে আমরা চিনতে ভুল করেছি; আবার দেখা গেছে যেসব জীবিত সময়ের কবিতা নিয়ে অব্যাখ্যাত ও দুর্বল কবিতাগুলি তখন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে বিবেচনাধীন; আবার সেইসব কবিদের নিয়ে নাচানাচি হয়েছে – কালের ইতিহাসে পরবর্তী সময়ে তা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে, ইতিহাস এভাবেও পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের আভাস দিয়ে তাদের সাবধান করে দেয়; অর্থাৎ কবিতা যদি কাল অতিবাহিত হয়ে অন্যকালেও তা আধুনিক থেকে যায়, মননশীলতার পরীক্ষায় সেসব উত্তীর্ণ হয় যদি; তাহলে বলবো সেই সৃষ্টির কবিরা বহুদর্শী। সমকালীন সময় বিচারে এসব শ্রেষ্ঠ কবিদের মনে আশা জাগিয়ে তোলে, তাদের নিজেদের সৃষ্ট কবিতাগুলির মধ্যে দু-একটি কবিতাও যদি কালের গর্ভে বেঁচে যায়, সেই আশা তারা মনে মনে শতকরা দুইভাগ হয়তো পোষণ করেন মাত্র; কিন্তু কবিতার সৃষ্টিতে যারা বিভোর, মানসিক বিভাব নিয়ে যারা জীবনের অপূর্ব মূল্যবান সময় তারা কাটিয়ে দেন শুধু কবিতা সাধনা করেই – তাদের বাস্তব জীবনে তো সর্বক্ষণ কাঁটা ছড়ানো থাকে, সেইসব বাধা সরিয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে উঠতে চান বলেই সেইসব মহৎ কবিরা কঠোর সংগ্রামে জ্বলন্ত চুল্লির পাশে বসবাস করেন। সার্থক অন্তত গোটা কয়েক কবিতার জন্য কালকে, সময়কে বাজি ধরে বসবাস করেন; আর অপমানিত-লাঞ্ছিত-নিগৃহীত দারিদ্র্যে ভোগা সাধারণ মানুষের মতোই বেঁচে থাকতে চান কবিরা; শ্রেষ্ঠ কবিদের জীবনযাত্রায় সাধুতার পরীক্ষা নিশিদিন দিতে হয় বলে—যারা কবিতা বোঝেন না পড়েন না একটি লাইনও সেই ভুখা দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট, অশিক্ষিত কোটি কোটি বিশ্বমানবতার পক্ষে বেঁচে থাকেন শ্রেষ্ঠ কবিরা, যাদেরকে অনেকেই আবার জীবিতকালে খুবই নগণ্য-তাৎপর্যহীন সাধারণ্যের স্তরে টেনে এনে কবিতার কুব্যাখ্যায় জর্জরিত করে তোলেন বহু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী সমালোচক, এমনকি সমকালীন রাজনৈতিক তাবেদারে পুষ্ট বিশিষ্টজনেরাও।
কবিতা লিখতে গিয়ে নিজস্বতা, নিজস্ব প্রকরণের রহস্য সকল কবিরা সবসময় খুঁজে পান না। সমালোচক যদি পণ্ডিত হয়, যিনি কবি চিনে ফেলবেন, তা নাও হতে পারে। কবিরা পণ্ডিত হতে পারেন; বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিক হতে পারেন; হতে পারেন বিপ্লবের গর্ভাশয় থেকে উৎসারিত মানুষ – কিন্তু পণ্ডিত-সমালোচকরাই কবি হবেন, কে বললো। যেকোনো সমালোচনায় যদি সৃষ্টির আভাস থাকে, যদি সমালোচনা পড়ে কবি নিজেকে চিনে নিতে পারেন, তেমন সেই লেখার দাবি চিরকালের জন্য সত্য। সেই সত্য পাঠকের মতোই তৃষ্ণা নিয়ে বারবার কবিরা পড়েন, আত্মসমালোচনা করেন। তারপরেও কবিদেরই কবিতা সৃষ্টির অধিকার জন্মায়।

                                                                                                                                     HOME

SHARE THIS PAGE!