প্রিয় রাজলক্ষ্মী
বেশ কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোকে একটা ফোন করব,
নয়ত লালকলমে এক চিঠির পাতায় কিছু কষ্ট ভরব;
কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি রে!
দেখতে দেখতে একান্নবছর পার হল,
কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধ্যক্য গড়াল;
ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে একলা একলা নিশিযাপন,
যাক সেসব কথা; যত্তসব দু:খের কাহন।
আগে বল, কেমন আছিস ? চিনতে পারলি ?
রোগামত দেখতে, একসাথে মিশন স্কুলে পড়তাম,
স্কুলভ্যানে পাশাপাশি বসে তোকে লক্ষ্মীপাগলী বলে ডাকতাম।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস। নক্ষত্র দত্ত, ১৮/১ আলিপুর, ফরিদপুর।
বলছি, ঐ আগের মতো নাক দিয়ে জল পড়ে তোর?
এখনো বকুলফুল কানে গুঁজে আয়না দেখিস?
এখনো কি ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে,
চুল টানলে ভ্যাঁদভেঁদিয়ে কাঁদতে থাকিস?
রাগ করলি? ঠিক আছে আর বলবো না।
জানিস, সৈকতের সাথে হঠাৎ সেদিন নাগপুরে দেখা হল,
সুন্দর ফর্সা মুখখানি দেখলাম ঢাকা পরেছে চাপদাড়িতে।
বিশাল হোটেল ব্যবসা, এখন সেটেল করেছে ঐ তালসারিতেই।
গগনটা এখন স্কুল টীচার, স্বপন পালিয়েছে বিলেতে,
তারেক একটা ক্লিনিক খুলেছে, ব্যস্ত থাকে ডাক্তারিতে।
পৌলমীটাই পোড়াকপালী, স্বামী খুইয়েছে কালরাতিতেই
ভাবলাম দেখে আসি, শেষে সান্ত্বনা পাঠিয়েছি খোলা চিঠিতেই।
অলক, মৈনাক, তনিমারা সব ভালোই আছে, তোর কথা প্রায়ই বলে
ভালোটা শুধু আমিই নেই রে, অন্ধকারের অন্তরালে।
বুঝলি লক্ষ্মী, আজ বাবার কথাটা খুব মনে পড়ছে
সুগার মিলে চাকরি করত, দেড়শো টাকা বেতন পেত।
আমাদের মুখে খাবার দিয়ে লোকটা শুতো আধপেটে।
টাকার দায়ে দিনের শেষেও ঘাম ঝরাতো রাত্রিতে।
তারপর এলো এক কালরাতি, কালব্যাধির কি প্রবাহ!
প্রবল জ্বরে বাপটা গেলো। শোকে গেলেন মাও।
তারপর আর বলবো কিরে, দিদিই হল জীবনখনি,
মায়ের মতোই করল বড়, সম্বল বলতে দু’শতাংশের ভিটেখানি।
হঠাৎ একদিন দিদির বুকে যৌবনের ঢেউ আসলো ধেয়ে,
বিয়ে দিয়ে করলেম বিদায়, ঐ দুই শতাংশের বিনিময়ে।
তারপর? তারপর থেকে ভালোই আছি রে লক্ষ্মী,
সম্পর্কের সংজ্ঞা ভুললাম, স্বাধীন করলাম রক্ত।
ঝিনুকের খোলে বন্দী হয়েও মুক্তা যেমন মুক্ত।
তারপর যখন কলেজে পড়ি, মেসে থাকতাম কলকাতাতে,
হঠাৎ একদিন দিদির চিঠি, দিদি কাঁদছেন কবিতাতে।
"কিরে ভাই, আছিস কেমন? মনে পড়ে তোর দিদির কথা?
অনেক কথা জমে আছে রে, আয়না একদিন, করনা দেখা।
জানিস তোর কথা খুব মনে পড়ে রে যখন বৃষ্টি পড়ে পুকুর পাড়ে,
ঐ শালুক যখন শরীর ভেজায় রেললাইন এর দুধার ধরে।
আঁধার রাতে মেঘের নাদে যখন মুখ গুঁজতিস বুকের ভাঁজে,
ভাইরে, জানিস তোর ঐ দিদি ডাকটা আজও বাজে কানের মাঝে।
আজও শিম-বেগুনটা রাঁধতে গেলে চোখে আসে যে জল
মনে পড়ে? শিমের বীচি খাওয়ার কত বায়না করতিস বল?
ভাই, তোর একটা ভাগ্নে হয়েছে, নাম রেখেছি অন্তু
শীতের ছুটিতে না এলেও মামাভাতে আসিস কিন্তু!
ইচ্ছে করেরে ভাইরে আজও তোকে চোখের কাছে রেখে
আলুপোস্ত, লাউচিংড়ি, ছ্যাঁচড়া খাওয়াব রেঁধে”।
না, আর দেখা হয়নি দিদির সাথে, খাওয়া হয়নি পোস্তবাটা
দুর্ভাগ্য আর অভিমানে কতবার যে পড়েছি বাঁধা।
শেফালির চলে যাওয়ার পর দুবার টেলিগ্রাম পেয়েছি অন্তুর
একটা দিদির বৈধব্যের, আরেকটা মৃত্যুর।
ততদিনে শুকিয়ে গেছে চোখের জল, বাঁধন পড়েছে পথ চলায়,
একে একে সকল স্মৃতি দাফন পড়েছে বুকের তলায়।
লক্ষ্মী, জানিস আমার আবার ঐ ছোট্টবেলায় ফিরে যেতে বড্ড ইচ্ছে করে,
ইচ্ছে করে ছেঁড়া ডায়েরির পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখি
নতুন করে গহীন রাতে পুরনো দিনের চিত্রগুলি আঁকি।
মনে পড়ে ঐ পদ্মানদী, ঐ ফড়িং ধরার বিকেলবেলা?
সেথায় আজও বাতাস বয়, হাসিখুশি আর প্রাণখোলা?
এখনো আছে ঐ বটগাছটা? ঐ স্কুলের পাশের দোকানটাতে?
টিফিন-ফাঁকে আচার খেতাম, তুই আর আমি আট আনাতে?
আজও তোর বাড়িরই উঠোনটাতে, জোনাকি নাচে সন্ধ্যাবেলা?
আজও তোদের চাল ধুয়ে যায়, পূর্ণিমার ঐ জ্যোৎস্নামালা?
এখনো কি শীতের মেলায় গরুর গাড়ি চেপেই যাস?
এখনো কি বৃষ্টি হলে কাঁচা মাটির গন্ধ পাস?
জানিস আজ খুব মনে পড়ছে তাদের কথা, শৈশবের যত মালাগাঁথা,
খাঁ পাড়ার মাঠ, আয়নাল চাচার ফুলুরি, প্রতিমদের আমপোড়া,
কীভাবে সেথায় যাবো বল? ওটা তো আজ বাংলাদেশ, কাঁটাবেড়ায় মোড়া।
একটা কাজ করতে পারবি? পাঠাতে পারবি স্মৃতিগুলো?
পাঠাতে পারবি মাটির গন্ধ, জোনাকি মাখা সন্ধ্যাগুলো?
পাঠাতে পারবি আমের ভেঁপু, শিশিরকণার চকমকানি?
পাঠাতে পারবি, কুয়াশা রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ঘ্যানঘ্যানানি?
আরও আছে কনকচাঁপা, মাধবীলতার সুরভিটা?
পারলে পাঠাস নদীর বুকে সুর্যোদয়ের আদিখ্যেতা।
মনে করে পাঠাস কিন্তু।
বেলা হয়েছে, যেতে হবে, রইল শুধু আবদারটুকু।
ইতি - নক্ষত্র দত্ত ওরফে নীতু।
SHARE THIS PAGE!