মুক্তগদ্য

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

বিষণ্ণ চোখের ভাষা
নকুল রায়  


স্তন্যপানের সময় অধিক মনোযোগে নিশ্চিত কোলের শিশুটি তার মায়ের মুখমণ্ডলের ভাষা বুঝতে পারে; অথবা, তার নিজের মা না-হলেও শিশুটি যখন কোনো স্তন্যদায়িনীর স্তন আঁকড়ে দুধ পান করে যায়, অথবা, স্তন দুধহীন থাকলেও শিশুটি যখন স্তনের আকর্ষণের সময়কালীন সজাগ চোখে তাঁকে দেখে দেখে সমগ্র অধিকারে মিশিয়ে ধীরে ধীরে একদিন কোল ছেড়ে দু-পায়ে হেঁটে প্রথমে ঘরের খাট বা শয্যা, তারপর মেঝে, তারপর উঠোন, উঠোন পেরিয়ে বাসার বাইরে প্রথম পা রাখে সড়কে – একদিন রাজপথ ধরে পৃথিবীর নানাপথ ঘুরতে চায়; কবির কাছে কবিতার শব্দের পরিচয় তেমনি।
প্রিয় মানুষের মধ্যে জন্মদাত্রী, জন্মদাতা কালক্রমে অমর হয়ে বেঁচে থাকে মানবসমাজে। সমাজে বসবাস করে মানুষ। যেকোনো মহৎ কবিকে মানুষের সংসারে নিজেকে মিশিয়ে বাঁচতে পছন্দ করেনা। বেঁচে থাকার সময় এই বিশ্বসংসারে যে-পরিচয় তিনি পান, তার মূল্যবিচার করার সময় তিনি সামাজিক অস্থিরতার ভেতর থেকেও খুঁজে পান নিজের সঙ্গে সংসারের মূলসংযোগটি। এই সংযোগ যাঁরা ধরে রাখতে পারেন না, তাঁরা কবি হতে আসেন নি – এসেছেন নিজের ব্যর্থতা অন্যের কাঁধে অর্পণ করে দার্শনিক মেজাজে কচকচি করে বেলা কাটানো, যাকে ইংরেজিতে তারা বলেন time pass; সংগ্রামী চেতনার মানুষ নিজের ব্যর্থতাকে অকপটে স্বীকার করার সময়ও কখনও বলেন না ‘আমি সংসারের জন্য খেটে মরলাম, কিন্তু লোকে আমাকে বুঝলো না’।
এসব কথা আসে তাদেরই যারা নিজের কৃতকর্মের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে বসেছেন। যদি তারা কোনো মানুষের শুধু মুখমণ্ডলটিও বিচার করতে বসেন, ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তাদের মনের খাতায় note করে রাখেন, তখন একসময় আয়না ছাড়াই নিজের মুখদর্শন করা সম্ভব। তখন তারা বুঝবেন যে, অসহায় মানুষদের মধ্যে সেইসব নারী কিংবা পুরুষ, শিশু-কিশোর-কিশোরীদের বিষণ্ণ চোখের ভেতর তাদেরই বুকে জমে-থাকা দুঃখের সামুদ্রিক ঢেউ খুব আস্তে করে জলছবির প্রলেপ দিয়ে গেছে তাদেরই একদা সংগ্রামী-সময়।
মানুষের সমস্যা নিজের সমস্যার সঙ্গে তুলনা করে যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব। কারণ আনন্দের ভাষা একেকজন সন্ত্রাসীর মধ্যে থাকে, অকারণে মানুষ করে আনন্দ পায়; কিন্তু তারা কখনই বিষণ্ণ চোখের ভাষা বুঝতে পারেনা, কারণ তাদের কোনো দুঃখের গভীরতা নেই; তাদের অনুশোচনা নেই, মানবপ্রীতি নেই, তারা আসুরিক-জিন অধিগ্রহণ করে এই পৃথিবীতে এসেছে, এবং তাদের মৃত্যু ঘটে তাদের মতো অসুরেরই হাতে।(শাব্দিকঃসেপ্টেম্বর২০১৬)
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন