মুক্তগদ্য

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা
শুভংকর নিয়োগী  


টিন-এজ বয়সটা এমনি যে নতুন করে কিছু ভাল কাজ করার জন্যে আনচান করে মনটা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে গোয়ালঘর থেকে গরুছাগল বের করে তাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় বেঁধে নিম কাঠিটা মুখে নিয়ে নতুন বাড়ির দক্ষিণের খোলা বারান্দায় বসে সূর্যওঠা দেখে জিৎ। বিশেষ করে শীতের সকালবেলাটা। পুবদিকে তাকালেই ঘন সবুজ আলুর খেত, সরষের খেত, গম ও কলাইয়ের খেত। এরই ফাঁকে সূর্যদেব সারা পুবআকাশ রক্তিম আভায় রাঙিয়ে ধরিত্রীর কোলে সোনালি কিরণ ছড়িয়ে দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনায় যেন বলেন, ‘জাগো, ওঠো, প্রভাত হল!’
জিৎ প্রাতঃকাজ সেরে মুড়ি খেয়ে, ছাগলগুলোকে ও লাল্টু-কুকুরটাকে মুড়ি খাইয়ে পড়তে বসে দক্ষিণের খোলা বারন্দায়। কিন্ত আজ আর তার পড়ায় মন বসে না। লাল্টু তার পাশে পিছনের পা দুটো মুড়ে বসে আছে চুপটি করে, যেন তার মাস্টারমশাই, তাকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে। তার অন্যমনস্কতা লক্ষ করে লাল্টু কুঁই কুঁই করে এসে তার গালে ও ঠোঁটে আলতো করে জিভ বুলিয়ে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে যে পড়াশুনায় মন দিতে।
বেলা বাড়ে। জিৎ দেখে যে খড়ের চালের ছায়াটা এসেছে খুঁটির কাছে। স্নান সেরে কোন রকমে ভাত খেয়ে স্কুলে যায় বইখাতা নিয়ে।

যত সময় যায় তার মন আরো বেশি চঞ্চল হয়। টিফিন হয়। খেলাধুলোয় মন নেই। কী এক অজানা চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার মন। ক্লাসরুমে গিয়ে বসে। বিজ্ঞান-স্যার ক্লাসরুমে ঢুকলেন। তিনি বলতে লাগলেন, “আজ আমি তোমাদের পড়াব প্লবতা। প্লবতা মানে তরলের ঊর্ধ্বমুখী বল বা ঘাত। কোন বস্তুকে স্থির তরলে বা গ্যাসীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত করলে বস্তুটি একটি ঊর্ধ্বমুখী বল বা ঘাত অনুভব করে। এই বল বস্তুর ওপর লম্বভাবে প্রযুক্ত হয়। একে ওই তরল বা গ্যাসের প্লবতা বলে। প্লবতা বস্তুর তলদেশে লম্বভাবে ঊর্ধ্বমুখে ক্রিয়া করে। প্লবতা বস্তুর আয়তনের ওপর নির্ভর করে। প্লবতা তরলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে। প্লবতা নির্ভর করে তরলের ঘনত্বের ওপর। একখণ্ড লোহাকে স্থির তরলের ওপর ছেড়ে দিলে সেটি তরলের মধ্যে ডুবে যেতে দেখা যায়। আবার সেই লোহাটিকে আগুনে গনগনে করে পুড়িয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পাতলা পাত করে একটু অবতল আকার ধারণ করিয়ে তরলের ওপর ছেড়ে দিলে ভাসতে দেখা যায়। এর কারণ হল, লোহার টুকরোটির আয়তন কম, ফলে জল অপসারণ করার ক্ষমতা কম, সেজন্যে প্লবতা কম। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে লোহার পাতটির আয়তন বেশি হওয়ায় জল অপসারণ করার ক্ষমতা বেশি, সেজন্যে প্লবতা বেশি। অর্থাৎ কোন একটি বস্তু তখনই ভাসে যখন বস্তুর ওজনের থেকে প্লবতা বেশি হয়। এর বিপরীত হলে তরলে ডুবে যায় বস্তুটি। এই একই কারণে বড় বড় জাহাজ, নৌকা জলে ভাসতে পারে। যে তরলের ঘনত্ব যত বেশি সেই তরলের প্লবতা বা ঊর্ধ্বমুখী বলও তত বেশি। আবার তরলের গভীরতা যেখানে যত বেশি সেখানে তরলের প্লবতা বা ঊর্ধ্বমুখী বলও তত বেশি। সমুদ্রের জল লবণাক্ত তাই ঘনত্ব বেশি। মানে প্লবতা বেশি, সেজন্যে সমুদ্রের জলে কোন বস্তুকে ভাসাতে, নিজে ভাসতে, সাঁতার কাটতে সুবিধে হয়। সমুদ্রের জলে প্লবতা বেশি বলে বড় বড় জাহাজ, নৌকা যে পরিমান জলের ওপর ভেসে থাকে গঙ্গা বা নদীর জলে প্লবতা কম বলে তার চেয়ে কম পরিমান জলের ওপর ভেসে থাকে। একটি সাধারণ উদাহরণ দিই। একটি সূচকে তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে ধরে স্থির তরলের ওপর শুইয়ে দিলে সেটিকে ভাসতে দেখা যায়, আবার সেটিকে লম্বভাবে স্থির তরলের ওপর ছাড়লে ডুবে যেতে দেখা যায়। তোমরা বাড়িতে এটি পরীক্ষা করে দেখতে পার,” বলে তিনি থামলেন। তার সারাদিনের চাঞ্চল্য কয়েক মিনিটেই কেটে যায়। স্থির পলকহীন দৃষ্টিতে জিৎ ভাবতে থাকে, একটা সূচ জলের ওপর ভাসবে! কি করে সম্ভব! পরীক্ষা করে দেখতেই হবে! স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে বই-খাতা রেখে একটা সূচকে তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে ধরে শুইয়ে দেয় স্থির তরলের ওপর। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে দেখে যে সত্যিই ভাসছে জলের ওপর। তার বিবেক তাকে নাড়া দিয়ে বলে, একটা সূচ যদি জলের ওপর ভাসতে পারে তাহলে সে নিজে জলের ওপর ভাসতে পারবে না কেন? কিন্তু ..। একগাদা কিন্তু জিৎ-এর মাথায় জট পাকিয়ে বসে।
গ্রীষ্মকালে স্নান করার সময়ে জিৎ অতবড় তালপুকুরটাকে সাঁতরে ওপার-এপার করে। ওটা অনেকেই করে। কিন্ত কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না নেড়ে জলের ওপর ভেসে থাকা সহজ কথা নয়। তার বিবেক আমতা আমতা করে বলে, কোন কিছুই অসাধ্য নয়। সুচিন্তিত পরিকল্পনায় মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি, জেদ, পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় দ্বারা অনেক অসাধ্য কাজকে সহজে করা যায়।
তার নতুন ক্লাস শুরু হয়। সাঁতরে পুকুরের মাঝে গিয়ে জলের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। প্রথমে হাত দুটোকে শরীরের দু-পাশে জলের ওপর রেখে পা-দুটোকে নাড়াতে থাকে। কিন্ত মাথা ডুবে যায়। এবার পা-দুটোকে স্থির রেখে দু-হাত দিয়ে জল কাটতে শুরু করে, কিন্ত হাত-পা না নেড়ে ভেসে থাকা যায় না। এ-ভাবে কয়েকদিন চেষ্টা করার পর তার সব চেষ্টা বিফলে যায়। উপলব্ধি করে এভাবে করলে হবে না। চিন্তা করে প্রথমে দুটো হাত ও দুটো পায়ের যে কোন একটিকে স্থির রেখে বাকি তিনটিকে জলের ওপর নাড়াতে হবে।
পুকুরের মাঝে গিয়ে প্রথমে বাম পা’টিকে স্থির রেখে বাকি তিনটিকে নাড়াতে থাকে। দিব্বি ভেসে থাকা যায়। এভাবে কয়েকদিন করার পর বাম এবং ডান পা স্থির রেখে শুধু হাত দুটোকে নাড়াতে থাকে। দুটো পা একসঙ্গে স্থির রেখে কিছুতেই ভেসে থাকা যায় না। পা-দুটো সোজা পুকুরের গভীরের দিকে চলে যায়। অন্যভাবে হাত দুটো স্থির রেখে পা’দুটোকে একসঙ্গে নাড়াতে থাকে, কিন্তু মাথা ডুবে যায়। কিছুতেই সূচের মত ভেসে থাকা যায় না। কিছুতেই ব্যালেন্স আনতে পারে না।
দিন যায়, মাস যায়। জিৎ ভাবে তাহলে কি তার চিন্তাভাবনা ভুল! ব্যালেন্স শব্দটা মাথায় খুব ঘোরাফেরা করে। সে ঈশানকোণে তেঁতুল গাছটার তলায় উঠে আসে। একটা ঘসিম নিয়ে মানুষ আঁকে আর মনে মনে হচ্ছে না বলে কাটে ক্রস চিহ্ণ দিয়ে । আবার আঁকে, আবার কাটে। এমন সময় বিবেক বলে ওঠে, ক্রস চিহ্ণটাই তো ব্যালেন্স! সে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে আর মনে মনে বলে, বোধ হয় একটা সূত্র পাওয়া গেছে! সে পুকুরের মাঝে গিয়ে জলের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে বাম-হাত ও ডান-পা স্থির রেখে ডান-হাত ও বাম-পা নাড়াতে থাকে। ভেসে থাকতে অসুবিধা হয় না। এভাবে দিন কয়েক অভ্যাস করার পর ডানহাত ও বাম-পা স্থির রেখে বাম-হাত ও ডান-পা নাড়াতে থাকে। এবারেও ভেসে থাকতে অসুবিধা হয় না। এভাবে আরো কয়েক দিন অভ্যাস করার পর সব কিছু স্থির রেখে জলের ওপর ভেসে থাকার চেষ্টা করে। আগের থেকে ভাল বটে কিন্তু পুরোপুরি ভেসে থাকা যায় না। আশ্চর্য! এত করেও সম্ভব হয় না। সেও নাছোড়বান্দা, এর শেষ সে দেখে ছাড়বে! তার বিবেক বলে, ‘সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম চিন্তা কর আর লক্ষ্য কর।’ সে খুব হালকা করে হাত-পা নাড়ে, চিন্তা করে আর লক্ষ করে। প্রশ্বাস নেয় আর নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রাকৃতিক নিয়মে পেট ফুলে ও কমে। কিন্তু কি আশ্চর্য! সূচের মত ভেসে থাকা যায় না। বিবেক বলে, ‘আরো নিয়মের ভিতরে ঢুকে চিন্তা কর।’ এক সময় হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিতেই সে জলে ডুবে যায়। নাকে, মুখে জল ঢুকে ফ্যাচ ফ্যাচ করে একাকার কাণ্ড। প্রথমে তার মনে হয়েছিল যে কেউ বুঝি তাকে জলে ডুবিয়েছে। পরক্ষণেই সে বুঝতে পারে যে দীর্ঘ শ্বাসই তার ডুবে যাওয়ার মূল কারণ। বেশী লম্বা করে শ্বাস নেবার সময় দেখে আস্তে আস্তে শরীরটা জলে ডুবে যায়, আবার বেশী লম্বা করে শ্বাস ছাড়ার সময় শরীরটা আস্তে আস্তে একেবারে জলের উপরতলে ভাসে। তার মনে পড়ে যে বাতাসের ওজন আছে। এখানে মুখ্য ভূমিকা নেয় শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল। যাকে এক কথায় বলে, ‘প্রাণায়াম।’
জিৎ ভাবে শ্বাস নেবার সময় ও শ্বাস ছাড়ার সময় যদি একই থাকে তাহলে প্রথমে জলে ডুবে যাবে পরক্ষণেই আবার আস্তে আস্তে ভাসবে। কিন্তু এটা তার লক্ষ্য নয়। তার লক্ষ্য হল সূচের মত জলের ওপর-তলে ভাসা; একেবারে নিষ্প্রাণ দেহের মত। এমন সময় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাড়া দিয়ে বলে, ‘তুমি প্রশ্বাসের থেকে নিঃশ্বাসের সময়টা বাড়াও। আরে এ যে ইউরেকা। সত্যিই তো। শ্বাস নেবার থেকে শ্বাস ছাড়ার সময়টা বাড়াতেই একেবারে জলের ওপর-তলে সূচের মত ভাসতে থাকে।
এসমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল সাক্ষী শোনে। সে তার থেকে পাঁচ-ছ বছরের ছোট। কিন্তু জিৎ-এর পিছনে সে আঠার মত লেগে থাকে, তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। পুকুরের মাঝে গিয়ে আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা শবাশনে শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে অসুবিধে হয় না। মৎস্যাসন অনায়াসে করে। এইসমস্ত কর্মকাণ্ড দেখে কয়েকজনের মনে নানা কৌতূহলী প্রশ্ন দেখা দেয়। শবাশনে শুয়ে শ্বাস নেবার সময় পেট সামান্য হলেও ওঠানামা করে। নিষ্প্রাণ দেহের মত ভাসতে হলে ওটা করা চলবে না। অর্থাৎ আরো সচেতন হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। জিৎ তার পরিকল্পনা মত কাজটি চালিয়ে যায়। কিন্তু কাজটি সফল কতখানি?
আরতিদি ও কবিতা-ভাইঝি প্রতিদিন জিৎ-এর স্নান করার আগে স্নানের ঘাটে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে খোসগল্প করে আর জলের ওপর তার বিভিন্ন কার্যকলাপ লক্ষ করে তাকে বলে, “তোর মধ্যে একটা কিছু আছে।”
পরের দিন সবার অলক্ষ্যে জিৎ তালপুকুরের মাঝে গিয়ে একেবারে শোলার মত ভাসতে থাকে। প্রতিদিনকার মত আরতিদি ও কবিতা-ভাইঝি স্নানের ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে খোসগল্প করে। শোনেকে আসতে দেখে আরতিদি জিজ্ঞেস করে, “জিৎ কই রে?” শোনে বলে, “জানি না, বাড়ির লোকেরা বলল যে সে অনেকক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে।” একটু থেমে পুকুরের মাঝের দিকে আঙুল তুলে বলে, “ঐ তো পুকুরের মাঝে ভাসছে।” আরতিদি ও কবিতা-ভাইঝি একসঙ্গে বলে ওঠে, “ওভাবে তো কোনদিন ভাসতে দেখিনি!” শোনেরও কেমন যেন সন্দেহ হয়। ইতিমধ্যে মনোজদা এসে হাজির, সে বলে, ছেলেটাকে আমিও খুঁজছি, কখন যে কোথায় কী করে, বোঝা মুশকিল! “জিৎ,” বলে, একটা ডাক দেয় মনোজদা। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে শোনেকে বলে, “শোনে, সাঁতরে গিয়ে দেখে আয়!”
শোনে সাঁতরে গিয়ে হাত পাঁচেক দূর থেকে লক্ষ করে জিৎকে। একটু পরে ভয়ে ভয়ে বলে, “বোধ হয় মারা গেছে!” মনোজদা স্নানের ঘাট থেকে চেঁচিয়ে বলে, “দুহাতে করে ঢেউ তুলে চোখে-মুখে দে।” শোনে তাই করতে থাকে। কিন্তু তাতে জিৎ-এর কোন অসুবিধাই হয় না। মনোজদা আবার বলে, “ওর হাত চেপে ধরে ডোবা!” শোনে তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে একটুখানি ডুবিয়ে রেখে তারপর ছেড়ে দেয়। শ্বাসের ঘাটতি হেতু জিৎকে জোর করে শ্বাস নিতে হয়, ফলে পেটটা ফুলে ওঠে। শোনে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বলে, “ বেঁচে আছে!” বেঁচে আছে শুনে জিৎ তাড়াতাড়ি তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করে নিতেই শোনে বলে, “না, সত্যিই মারা গেছে!”
জিৎদের বাড়িতে দুঃসংবাদ দেওয়া হয়েছে। তার ঠাম্মা বলেন, “তোদের মাথা খারাপ, তাই তোরা ওরকম ভাবছিস। খোকার কিছু হলে আমি আগে জানতে পারবো।”ইতিমধ্যে স্নানের ঘাট থেকে বেশ কয়েকজনের কান্নার স্বর জিৎ শুনতে পায়, কিন্তু তার হাসা, নড়াচড়া করা, জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া সবই বারণ।
মাঝপুকুর পর্যন্ত সাঁতরে এসে খানিকক্ষণ সাঁতরে থাকা, তারপর নিজের ভর সামলে আরেকজনকে ডোবান সহজ কথা নয়। শোনেরও কেমন যেন ভয় ভয় করে! মুখ দিয়ে তার আর কথা বের হয় না। তবু একরকম জোর করে চেঁচিয়ে বলে, “ডো – ডো – ডোবান যাচ্ছে না!” মনোজদা জোর করে চেঁচিয়ে বলে, “ওর বুকে চেপে বস।” শোনে একরকম সাহসে ভর করে জিৎ-এর বুকে চেপে বসে। জিৎ পুরোপুরি জলে নিমজ্জিত। তার বুকে বসতে পেরে শোনের বেশ আরাম লাগে। মনে মনে বলে, ‘এবার যায় কোথায়!’
জিৎ এর আর দম নেই। তেড়েমেড়ে উঠে শোনেকে ধরে জলে ডুবিয়ে রেখে ছেড়ে দেয়। শোনে আর্তনাদ করে বলে ওঠে, “ওরে – বাবা – রে খেয়ে ফেললে রে! ওরে – বাবা – রে খেয়ে ফেললে রে! জিৎ জীবদান পেয়েছে রে!” বলে যত জোরে পারে স্নানঘাটের দিকে ফিরে যেতে থাকে। জিৎ পিছনে পিছনে তাকে তাড়া করে নিয়ে আসে। শোনে স্নানের ঘাটের মেঝেতে উঠেই মাটিতে পড়ে বেঁহুশ! সবাই জিৎকে দোষারোপ করে বলে, “তোর জন্যে শোনের এই অবস্থা! ওর কিছু হলে তুই দায়ী থাকবি!” বুঝুন অবস্থাখানি। কি করতে কি হয়ে গেল! মনোজদা শোনের চোখে-মুখে জল দিতেই শোনে চোখ খুলে সামনে জিৎকে দেখেই আবার অজ্ঞান। মনোজদা শোনের সম্মুখ থেকে জিৎকে সরিয়ে নেয়। খানিক পরে শোনের জ্ঞান ফেরে। জিৎ দেখে যে দু’একজন বাদে বাকি সবারই চোখে জল। কবিতা ভাইঝির চোখে জল! অথচ মুখে একগাল হাসি নিয়ে বলে, “আয় তোকে একটা প্রণাম করি।” জিৎ মনে মনে বলে, ‘তাহলে এটা সফল। হেসে মুখে বলে, “আর একটা মতলব মাথায় এসেছে।” বলেই শোনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে বলে, “তুই বেঁচে আছিস?”

ক’দিন ধরেই একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খায়। তখন বাড়িতে ভাত-রান্না, ধান-সেদ্ধ, গরুর-ঘাঁটা ইত্যাদি সম্পন্ন হত মাটির হাঁড়িতে। ভাত সমেত মাটির হাঁড়ি কতবার তার চোখের সামনে ভেঙেছে! সেই ভাঙ্গা অবতল খোলামকুচি জলের ওপরতলে ছুড়ে দিলে কেমন নেচে নেচে তাতা–থৈ, তাতা–থৈ করতে করতে পুকুরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু একখণ্ড ইটের টুকরো বা শক্ত স্টোন চিপসের বেলায় তো হয় না! পরে চিন্তা করে বুঝতে পারে যে খোলামকুচিটি অবতল ও আয়তনে বেশি থাকায় গতিবেগ, পৃথিবীর অভিকর্ষ বল, জলের প্লবতা এবং নিউটনের তৃতীয় সূত্রের জন্যে খোলামকুচটি বেমালুম পুকুর পেরিয়ে যায়। অথচ সেই খোলামকুচটি জলের ওপরতলে ছেড়ে দিলে আন্দোলিত হয়ে হেলে দুলে ডুবে যায়। এইসব দেখে ও চিন্তা-ভাবনা করে তার মনে হয়েছে তাহলে সে জলের ওপর দিয়ে দৌড়াতে পারবে না কেন? মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি, জেদ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও সুচিন্তিত পরিকল্পনায় তার মনে জেগে ওঠে অদম্য কৌতূহল!

পরের দিন স্নানের ঘাটে এসে হাজির হয়। শ্বাস নেওয়ার থেকে শ্বাস ছাড়ার সময়টা বেশি করতে হবে। প্রাণায়ামের এই কৌশলটিই মুখ্য অস্ত্র। ডাঙা থেকে প্রথমে জলে নামার সময় প্লবতা পাওয়া যাবে না। কাজেই দ্রূত গতিবেগে পুকুরের জলের ওপর আলতো পা ছুঁইয়ে যেতে হবে। এই সময় নিজের মনের ভাবনাটিকে ঊর্ধ্বমুখী করে রাখতে হবে। পরিকল্পনামত শ্বাস সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে খানিকটা দূর থেকে খুব জোরে ছুটে আট-দশ পা যেতেই ভারসাম্য হারিয়ে জলে পড়ে যায়। স্নানের ঘাট থেকে হাঁ করে তার খেলা দেখে কয়েকজন। মনোজদা কখন এসেছে খেয়াল করেনি। সে বলে, “জিৎ ওঠে আয়!” জিৎ সাঁতার দিয়ে উঠে আসে পুকুর পাড়ে। আবার একই ভাবে এক থেকে দুই পদক্ষেপে শ্বাস নিয়ে তিন-চার পদক্ষেপে ছাড়তে ছাড়তে জলের ওপর দিয়ে দৌড়ে মাঝপুকুর পেরিয়ে যায়। আবার একইভাবে অভ্যাস করতে করতে উপলব্ধি করে যে প্লবতার কী দারুণ ক্ষমতা এবং এর একটি বৃহৎ জগৎ আছে। প্লবতা ও প্রাণায়ামের সাহায্যে জলের ওপর দিয়ে দৌড়ান সম্ভব, অতি অবশ্যই সম্ভব। একটি অন্যটির সম্পূর্ণ পরিপূরক। ঘটনাটি একটি অত্যাশ্চর্য বাস্তব। দুটির মিলিত প্রয়োগে সৃষ্টি হয় এক দারুণ অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা!
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন