ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৮ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

বাদুড় কেল্টু শ্যামু ভূপেশ এবং অণিমা
সদানন্দ সিংহ  


এক দুই তিন চার পাঁচ। পাঁচটা বাদুড়। সারি বেঁধে খোলা ইলেকট্রিক তারে স্থির ঝুলে রয়েছে। সাতসকালে ভূপেশ মাথার ওপর হাতদুটো রেখে দৃশ্যটা দেখে। মুখগুলো যেন অনেকটা বেড়ালের মতো। মনে পড়ে ভূপেশের, বহূ-বহুদিন আগে যখন সে অনেক ছোট ছিল তখন মামার বাড়িতে বেড়াতে গেলে একটা ছোট্ট বাদুড় তার আঙুল কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। সেই বিষ বছরের পর বছর তাকে আক্রমণ করে চলেছে। হয়তো অন্যকেও।

সকালে উঠতে গেলেই ভূপেশের চোখে এক জ্বালাপোড়া হয়। ওঠার সময় ভূপেশের পৃথিবীটাকে বর্তুলাকারের মতো মনে হয়। কোনো কোনো দিন তো লম্বাটেও। মাথায় থাকে একটা যন্ত্রণা। সারারাত মেলট্রেনের হুইশেল। নীল আলোর ঝিলিক। কাল আবার একটা অজগর হিংস্র বাঘটাকে প্যাঁচিয়ে ধরেছিল। তারপর কখন যে বাঘটা কামড় লাগিয়েছিল অজগরের মাথায়। অজগরটা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেও মরে না।

রাস্তায় অনেকগুলি কাচ্চা-বাচ্চা জড়ো হয়ে গেছে। বাদুড়গুলোকে দেখে ওরা খুশিতে চেঁচামেচি করছে। কয়েকজন তো আবার ছড়া কাটাও শুরু করেছে। বাতাস এলে পাঁচটা বাদুড় একসঙ্গে দোল খাচ্ছে। তাতে বাচ্চাগুলি আরো চেঁচেয়ে উঠছে।

এরপর তিন-তিনটা সপ্তাহ ভূপেশ পার করে দেয় যেখানে প্রথম সপ্তাহে সে শুধু বৃষ্টির মাঝে হেঁটে গেছে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় সপ্তাহে সে কাঁচা রোদ এবং কাঁচা বৃষ্টির মাঝখান দিয়ে হেঁটেছে। তার ওপর ধূতি-পাঞ্জাবি পরা ফিনফিনে একজন মোটালোক চোখ বন্ধ করে সিগারেট ধরাবার পর পোড়া ম্যাচের কাঠিটা যখন ভূপেশের ওপর ফেলে দেয় তখন রাগে সে সেই মোটালোকটার পাছায় একটা লাথি কষে দেয়। লোকটা হতচকিত হয়ে পালিয়ে যেতে যেতে শাসায়, কেল্টুকে দিয়ে এর একটা শোধ না তুলছি তো আমার নাম শ্যামু নয়।

অতঃপর ভূপেশ যখন বাড়ি ঢুকতে যায় তখন তার মাথায়, গলায়, জামায়, হাতে কয়েক ফোঁটা তৈলাক্ত পদার্থ টপ টপ করে এসে পড়তে থাকে। ওপর দিকে তাকাতেই ইলেকট্রিক তারে ঝোলা বাদুড় পাঁচটাকে দেখতে পায়। সে দেখে, শরীরে পড়া তৈলাক্ত পদার্থগুলিতে ছোট ছোট কয়েকটা পোকাও কিলবিল করছে। হঠাৎ একটা বিশ্রী পচা গন্ধে জায়গাটা ভরে যায়। ভূপেশ স্পষ্টই বুঝতে পারে তৈলাক্ত পদার্থগুলি বাদুড়গুলি থেকে খসে পড়া কীটযুক্ত পচা মাংস ছাড়া আর কিছুই নয়। তার শরীরটা ঘিন ঘিন করে ওঠে। লাফ মেরে সরে এসে আবার ওপরের দিকে তাকায়। হাজার হাজার কীটে বাদুড়্গুলির দেহ কিলবিল করছে। বাদুড়্গুলির দেহে পোকাগুলি এবড়োখেবড়ো নড়ছে। আর পাঁচজোড়া শীতল চোখ বারবার তাকে ভ্রূকুটি করতে থাকে।
ভূপেশ একবার ঝুলন্ত বাদুড়গুলিকে আরেকবার তার শরীরের দিকে চায়। ঘৃণায় তার শরীরটা কেমন যেন করতে থাকে। জামাটাকে সে শরীর থেকে খুলে ফেলে। গেঞ্জিটাও খুলে ফেলে। ঘরে ঢুকে এককোণে সেগুলিকে রেখে দেয়। কিন্তু ঘরেও সে ঠিকভাবে বসতে পারেনা। সারাশরীরময় সারাঘরময় পচা বাদুড়ের দুর্গন্ধ। এরি মাঝে সে কোনোরকমে দুর্গন্ধটা সহ্য করে জামা আর গেঞ্জিটা কেচে নেয়। ভালো করে শরীরে সাবান মেখে স্নান করে। স্নান ছেড়ে দুর্গন্ধময় ঘরের ভেতরে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে সে ভালোভাবেই টের পায় দুর্গন্ধটা জলের মধ্য দিয়ে ক্রমশ তার শরীরে ঢুকে গেছে। ভাত খেতে গিয়েও আর খাওয়া হয়না। বমি আসতে থাকে। পরে কোত্থেকে একটা বাঁশ সংগ্রহ করে সে বাদুড়গুলিকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে ওঠেনা।
ঘর থেকে বেরিয়ে ভূপেন অসীমদের বাড়ি যায়। অসীম আড়িতে ছিল না। তাই অসীমের ভাইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ক্যারাম খেলে। এরপর সে সুবলদের বাড়ি যায়। সুবলও বাড়ি ছিল না, তাই সে সুবলের বাবার সঙ্গে কয়েক চাল দাবা খেলতে বসে যায়। সুবলদের বাড়ি থেকে ভুবনদের বাড়ি। ভুবনটা ঘ্যানর ঘ্যানর করে কয়েকটা বাচ্চা-কাচ্চাকে গান শেখাচ্ছে। বেরিয়ে আসে সে।
আপন মনে রাস্তায় হাঁটতে থাকে ভূপেশ। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটে। হঠাৎ সে দেখে এক ভয়ংকর চেহেরার লোক তার দিকে বিশ্রীভাবে চাইতে চাইতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। লোকটা কেল্টু নাকি? মোটালোকটা যেমন বলছিল, কেল্টুকে দিয়ে এর একটা শোধ না তুলছি তো আমার নাম শ্যামু নয়।
আচ্ছা কেল্টুই যদি হয় তাহলে? তাহলে সে কী কেল্টুকে মাল্টু করে দিতে পারবে না? তার নিজেরই তো শক্তি আছে, সাহস আছে। কিন্তু কেল্টু কি তার সামনে খালি হাতে লড়তে আসবে? নিশ্চয়ই নয়। ভাবতে ভাবতে ভূপেশ তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে একটা হোঁচট খায় আর পড়ে যেতে থাকে। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।

একসময় ভূপেশের জ্ঞান আস্তে আস্তে ফিরে আসতে থাকে। মাথার একটা দপ দপ যন্ত্রণা ক্রমশ ছোট হতে হতে একসময় সে টের পায় অণিমা তার দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আসে। চোখ খুলে ভূপেশকে তাকাতে দেখে অণিমা মৃদু হাসে, বাব্বা, কী চিন্তাই না ঢুকিয়ে দিয়েছিলে!
চারিদিকে তাকিয়ে ভূপেশ বুঝতে পারে সে অন্য কারুর ঘরে শুয়ে আছে। অণিমাই উত্তর দেয়, এটা বিমলবাবুদের ঘর। আমি আর বিমলবাবু দুজনে মিলেই তোমাকে তুলে এনেছি।
ভূপেশের সবকিছু মনে পড়ে যায় --- তৈলাক্ত পদার্থ, বাদুড় পচার দুর্গন্ধ, শ্যামু, কেল্টু।
অণিমা বলতে থাকে, তোমাকে কী খোঁজাটাই না খুঁজেছি; তোমার বাড়ি থেকে অসীমদের বাড়ি। অসীমদের বাড়ি থেকে সুবলদের বাড়ি, সুবলদের বাড়ি থেকে ভুবনের ওখানে, তারপর ভুবনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তোমাকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু ওভাবে পড়ে যেতে তুমি কবে থেকে শিখলে?
অণিমা হাসে। ভূপেশ উঠে বসে, তাহলে তুমি সারাক্ষণ টিকটিকির মতো আমার পেছনে পেছনে ছিলে।
--- ঠিক তাই।
--- আমি এখন ঠিক আছি। চলো যাওয়া যাক। বিমলবাবু কোথায়?
--- তিনি বোধহয় ডাক্তারের খুঁজে বেরিয়েছেন।
--- পরে আরেকদিন উনার সঙ্গে দেখা করবো। এখন চলো। আমাকে এক্ষুনি এ এলাকা ছাড়তে হবে। ভূপেশ উঠে পড়ে। দরজার কাছে গিয়ে একটু দাঁড়ায়। অণিমাকে বলে, দেখো তো, বাইরে কোন গুন্ডাজাতীয় লোক দাঁড়িয়ে আছে কিনা। শ্যামু লোকটা আমাকে শাসিয়েছে, কেল্টুকে পাঠিয়ে নাকি শোধ নেবে।
অণিমা সোজা হয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, তুমি আমার পেছনে পেছনে এসো। কোনো ভয় নেই। এই দেখো। বলেই অণিমা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকচকে কালো পদার্থ বের করে দেখায়।
ভূপেশ অবাক হয়, পিস্তল! কোত্থেকে পেলে তুমি!
অণিমা হাসে, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি। থানায় জমা দেবো বলে রেখেছিলাম। এখন দেখছি কাজে লাগছে। এসো, আমার পেছন পেছন। অণিমা আবার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর পিস্তলটা ঢুকিয়ে দেয়।
--- তোমার ব্যাগটা আমার কাছে দাও। বলেই ভূপেশ অণিমার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝোলায়। রাস্তায় বেরিয়ে এসে ভূপেশ বলে, চলো তাড়তাড়ি। পাঁচটা বাদুড়কে আগে গুলি করে নামাতে হবে।
অণিমা বলে, বুঝেছি। চলো।
যেতে যেতে ওরা স্পষ্ট টের পায়, ওদের চারিদিক ঘিরে একটা ঝড় ক্রমাগত প্যাঁচ খাচ্ছে আর খাচ্ছে।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন