জে বি এস হলডেন ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতার একটি সংবাদপত্রে মৃত্যুর স্বল্পকাল আগে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, শিথিল আইনের পৃথক বিচারবিধির দ্বারা যতদিন পর্যন্ত ছাত্রদের (কিংবা গণআন্দোলনভুক্ত যুবশক্তির) ধ্বংসাত্মক অশান্তি সৃষ্টির উদার প্রশ্রয় অব্যাহত থাকবে, অর্থাৎ অপরাধী হয়েও অন্যতর সমাপরাধীর ন্যায় শাস্তি পাবেনা, ততদিন পর্যন্ত সাধারণ ক্ষেত্রে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা, প্রতিকার সাধনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, আদর্শের বদলে হুজুগেপনা প্রচলসিদ্ধ থেকে যাবে। আমাদের দেশের জনসাধারণ, বাম কিংবা ডানপন্থী রাজনৈতিকবৃন্দ, আরক্ষা বিভাগীয় কিংবা শাসন বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ, রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার এই মনীষীর উক্তিতে কান দেননি। ফলাফল দৃশ্যেই সুস্পষ্ট। পরীক্ষা ভুন্ডল, লেবরেটরি ভাঙা, টেবিলচেয়ার ধ্বংস, শিক্ষক অবমাননা, শিক্ষালয়ে নিরবচ্ছিন্ন হরতাল, ট্রাম, বাস, স্কুটার পোড়ানো, লোকক্ষয়ী দাঙ্গা, দোকানপাট লুট ইত্যাদি অসংখ্য লোকহিংসক কার্যকলাপ তাই সর্বত্র অব্যাহত।
বক্তব্য এইমাত্র নয়, শাস্তিবিধানের অভাবেই অন্যায়গুলো ঘটছে, সর্বব্যাপী এই বিশৃঙ্খলার সূত্রগুলো খুঁজতে হবে অন্যত্রও। সেই কারণেও এই প্রতিপাদ্য নয়, শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা থাকলেই অন্যায় ঘটবেনা, তবে এটা জ্ঞাতব্য ও উপস্থাপ্য যে আইনানুগ বিচারব্যবস্থা ক্রিয়াশীল না থাকলে অন্যায় বাড়ার সুযোগ পায়, শৃঙ্খলার প্রতি সাধারণ মানুষও অবিশ্বাসী হয় এবং আইন ভঙ্গকারী ভাববার সুযোগ পায়, যে দাবী মিটানোর একমাত্র রাস্তাই অশান্তি সৃষ্টি।
সমাজদেহের ওপরকার অশান্তির ভেতরকার কারণগুলোর দিকে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা ইদানীং
স্বীকৃত হচ্ছে। ছাত্র বা যুব অশান্তির হেতু সমূহ উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে দেশজুড়ে, অধুনাতম শিক্ষা কলেজ এতদ্বিষয়ক যথোপযুক্ত তালিকাও রচনা করেছেন, উপরন্তু রোগ সম্বন্ধে স্থির নিশ্চিত হয়ে কয়েকটি সাধুপ্রস্তাবও রেখেছেন দেশবাসীর এবং শিক্ষাব্রতীর ও ব্যবসায়ীর সামনে। সেই তালিকাযুগলের ওপর নতুন আলোকপাত হয় কিনা জানিনে, এই উভয়ক্ষেত্রে বর্তমান নিবন্ধকের বক্তব্য সংক্ষেপে এইঃ
ক) গোটা সমাজটার প্রায় প্রতি অঙ্গেই দুর্নীতির ঘুণ ধরেছে। তপস্বী কিংবা মনস্বী, রাজনীতির পান্ডা কিংবা সরকারি-বেসরকারি কর্মী, শিক্ষক কিংবা অভিভাবক, শাসক কিংবা শাসিত, বিক্রেতা কিংবা ক্রেতা সর্বস্তরেই বিভিন্ন প্রকার প্রবঞ্চনাভিত্তিক অসদাচরণ অব্যাহত। বলা বাহুল্য প্রচলিত এই নীতিহীনতার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক শিকারের বিস্তৃত জনারণ্য। অন্যান্য হেতুও অবশ্য উপেক্ষণীয় নয়। ভাষা-ধর্ম-দ্বেষ রাজনৈতিক সুবিধাবাদের নিরঙ্কুশতায় আমাদের দুর্ভাগা দেশ আজ সুস্থ বসবাসের প্রায় অযোগ্য। ফলত বিপুল পরিমাণ এই বৈষম্য ও অত্যাচার, সহনশীলতা ও ক্লৈব্যের সোজা প্রতিক্রিয়া ঘটছে অনুভূতিশীল তরুণতর সমাজদেহে। স্বাধীন চিন্তার শক্তি যেখানে অপসৃত, উত্তেজনাই সেখানে উপস্থিত কর্মের নিয়ামক। তাই প্রতিবাদ মানেই হরতাল, হরতাল মানেই পুলিশের সঙ্গে কিংবা অন্য কারো সঙ্গে সংঘর্ষ এবং সংঘর্ষের প্রবাহমুক্ত হলে অগ্নিকান্ড, লুট, ভ্রাতৃহত্যা এবং তারপর এসব কে করেছে কেউ জানেনা, যারা অপরাধী তারা অধিকাংশ ধরা পড়ে না, যারা অপরাধী নয় বিশেষ কারণে কিংবা অনবধানবশত ধরা পড়ে, আর যারা অপরাধী অথচ ধরা পড়ল তাদের বিচারের কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়না, কেননা তাতে ভয়, আন্দোলন আরো প্রবল হতে পারে; কিংবা তাতে লোভ, ছেড়ে দিলে ওরা আমাদের দলে আসে।
খ) প্রতিকারের কাজ একার নয়, যেমন ধ্বংস প্রবণতা কারো একক সৃষ্টি নয়, দেশের শাসক সম্প্রদায়, চিন্তাশীল এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, অগণিত সাধারন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে হবে, অন্যায় দেখলে সাহসী হয়ে তার প্রতিরোধে দাঁড়াতে হবে, আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক মোড় দিতে হবে, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত মিত্রকেও আশ্রয় দেয়া চলবে না, নঙ্র্থক অবিশ্বাস থেকে সরে এসে বাস্তবভিত্তিক সদর্থক কর্মানুষ্ঠানে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে, সমাজবিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য সংঘবদ্ধ জনসমাজ গড়ে তুলতে হবে, সর্বোপরি, সুস্থ-সবল উদার মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য শিক্ষাকে সর্বগ্রাহী, জীবনসমীপে ও নন্দন-বিনোদন সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে।
কিন্তু সেই সোজা রাস্তায় তো আজ পথচারী দেখিনা।
HOME
এই লেখাটা শেয়ার করুন