নিবন্ধ

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০১৮ ইং

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

>
কানহাইলাল ও মণিপুরি থিয়েটার
এল বীরমঙ্গল সিংহ

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট একটি প্রান্তিক রাজ্য মণিপুর। কিন্তু খেলাধুলা, নৃত্য ও নাট্যচর্চায় ছোট্ট এই পার্বতী রাজ্য সবার নজর কেড়েছে। মণিপুরে নিজস্ব ঘরানায় নাট্যচর্চা সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই শুরু হলেও অনেক দেরিতে পরিচিতি ঘটেছে পশ্চিমী প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সঙ্গে। মূলত বাংলা নাটকের মাধ্যমেই এই পরিচিতি ঘটে। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা চূড়াচান্দের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজবাড়িতে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে মণিপুরি কলাকুশলীদের দ্বারা বাংলা ভাষায় ‘প্রভাস মিলন’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। বলা হয় এটিই মণিপুরে অভিনীত প্রথম আধুনিক প্রসেনিয়াম থিয়েটার। পরের বছর বাঙালি অধ্যুষিত বাবুপাড়ায় বামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাসগৃহে ‘বামাচরণ মুখোপাধ্যায় বান্ধব নাট্যশালা’ নামে একটি থিয়েটার হল তৈরি করা হয়।আর নাট্যসংস্থার নাম রাখা হয় ‘বান্ধব নাট্যসমাজ’। এই নাট্যসংস্থার মণিপুরি ও বাঙালি কলাকুশলীদের সম্মিলিত প্রয়াসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটক ‘মেবার পতন’ মঞ্চস্থ করা হয়। এরপরও বেশ কিছু বাংলা ও বাংলা থেকে অনুবাদ করা নাটক মঞ্চস্থ হয়।
১৯২৫ সালে মণিপুরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে মণিপুরি ভাষায় লেখা মৌলিক নাটক ‘নরসিংহ’ শ্রীগোবিন্দজি মণ্ডপে স্টেজ বানিয়ে মঞ্চস্থ করা হয়। এতে উৎসাহিত হয়ে অধিকাংশ নাট্যকার মণিপুরের পটভূমিকায় মণিপুরি ভাষায় নাটক লিখতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন নাট্যসংস্থাও গড়ে ওঠে এবং নাট্য আন্দোলনে প্রাণের সঞ্চার হয়। সে সময় গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য নাট্য সংস্থাগুলি হল – ১৯৩১ সালে গড়ে ওঠা মণিপুরের অন্যতম প্রাচীন নাট্যসংস্থা মণিপুর ড্রামাটিক ইঊনিয়ন (MDU), এরিয়ান থিয়েটার (১৯৩৫), চিত্রাঙ্গদা নাট্যমন্দির (১৯৩৬), সোসাইটি থিয়েটার (১৯৩৭), রূপমহল (১৯৪৩) ইত্যাদি। মণিপুরের এইসব নাট্য সংস্থাগুলি এখনও জীবিত ও সক্রিয়।
পঞ্চাশের দশকে এসে মণিপুরি নাট্য আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। শুরু হয় নাট্য উৎসব ও নাট্য প্রতিযোগিতা। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার আয়োজিত জাতীয় নাট্য উৎসবে যোগ দিয়ে সোরোখাইবম ললিত সিংহের পরিচালিত এম ডি ইঊ-এর নাটক ‘হাওবম লৈশং শাফবী’ ফোক ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। জাতীয় স্তরে মণিপুরি নাটকের স্বীকৃতি লাভের ফলে নাট্যকর্মীরা উৎসাহিত হয়ে উঠেন। সেসময় জি সি তোংব্রা, অরাম্বব সমরেন্দ্র, লাইশ্রম নেত্রজিৎ প্রমুখরা আধুনিক মণিপুরি নাটকের ক্ষেত্র তৈরি করেন।
প্রকৃত অর্থে মণিপুরি নাট্য আন্দোলনের জয়যাত্রা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে। শিক্ষিত নতুন প্রজন্মের নাট্য পরিচালকেরা বিশ্বনাট্য গতিধারার সাথে সম্যক পরিচিত হয়ে মণিপুরের পটভূমিতে নতুন আঙ্গিকে নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে কোলকাতার বিশিষ্ট্য নাট্য ব্যক্তিত্ব বাদল সরকার মণিপুরে এসে নাটকের কর্মশালায় যোগ দিয়ে নতুন আঙ্গিকের নাট্যচর্চার দ্বার খুলে দেন। এই ধারার নাট্যচর্চার হোতাদের মধ্যে অরিবম শ্যাম শর্মা, হেইস্নাম কানহাইলাল, লোকেন্দ্র অরাম্বম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে সনখ্যা ইবোতোম্বী এবং পরের বছর রতন থিয়াম নতুন দিল্লির ন্যাশেনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসে মণিপুরে এসে আধুনিক নাট্য আন্দোলনের ধারাকে আরও পরিপুষ্ট করেন।
নাট্যচর্চায় মণিপুরকে যাঁরা সামনের সারিতে তুলে এনেছেন তাঁদের মধ্যে কানহাইলাল অন্যতম। তিনি লিখেছেন পনেরোটি নাটক ও নাট্য পরিচালনা করেছেন ৩৫টির বেশি নাটক। জীবনের অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন সাফল্যের চূড়ায়। জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন বলেই তাঁর নাটকে আমরা পাই জীবনযন্ত্রণা, সংবেদনশীলতা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রতিফলন।
কানহাইলাল ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি ইম্ফলের কৈশামথোং থাংজম লৈরক-এ জন্মেছিলেন। মৃত্যু ৬ই অক্টোবর ২০১৬, দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে। পিতা হেইস্নাম পিশক ছিলেন একজন সাধারণ দিনমজদুর। মা ইবেম্মা দেবী ছিলেন মণিপুরি নটসংকীর্তনের একজন বিশিষ্ট গায়িকা। কিন্তু কানহাইলালের জন্মের তিনমাসের মাথায় তাঁর মা মারা যান। শিশু কানহাইলালকে তাঁর জ্যাঠামশাই হেইস্নাম অঙাংতোম্বী ও ঠাকুরমা অগ্নি দেবী লালনপালন করেছিলেন। গানবাজনা ও থিয়েটারপ্রেমী জ্যাঠামশাইয়ের অনুপ্রেরণায় মণিপুরের নিজস্ব নাট্যধারা ‘মোইরাং পর্ব’ ও আধুনিক থিয়েটার দুটোর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি নাট্যচর্চায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চতর শিক্কালাভের জন্য ভর্তি হন ইম্ফল কলেজে। মণিপুরের বিশিষ্ট্ নাট্যকার জি সি তোংব্রা তখন ওই কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কানহাইলাল তাঁর নিবিড় সংস্পর্শে আসেন। জি সি তোংব্রার অনুগামী হয়ে প্রায় তিন বছর তিনি সোসাইটি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এই নাট্যসংস্থার সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিয়ে স্টুডেন্টস আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশান নামে একটি নাট্যসংস্থা গঠন করেন। নিজের লেখা ‘লাইয়েং অহানবা’ নামে একটি নাটক ওই সংস্থার পক্ষ থেকে মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকে কানহাইলালের পরবর্তীকালের সহধর্মিনী সাবিত্রী দেবীও অভিনয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এই নাটকের সুবাদে দুই মহান শিল্পী কানহাইলাল ও সাবিত্রী দেবী পরিচয়ক্রমে গভীর প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং যার পরিণতিতে ১৯৬২ সালে দুজনের বিবাহবন্ধন। শুরু হয় তাঁদের নতুন জীবনসংগ্রাম। চরম আর্থিক সংকটের কারণে নতুন দম্পতিকে কিছুদিনের জন্যে তাঁদের প্রিয় থিয়েটারের জগৎ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। বাঁচার তাগিদে কানহাইলালকে বাটার জুতোর দোকানে সেলস্‌ম্যানের কাজ থেকে শুরু করে ন্যাশেনাল কনস্‌স্ট্রাকশন কোম্পানির কেরানি ও ইম্ফল থেকে দূরের এক গ্রামে শিক্ষকতার কাজও করেছিলেন। পরিশেষে মণিপুর সরকারের পরিসংখ্যান দপ্তরে তিনি প্রাইমারি ইনভেস্টিগেটর হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তারপর বেশ কয়েক বছর সরকারি চাকরি করে সংসারের অভাব মিটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রক্তে যার থিয়েটারের নেশা এবং নতুন একটা কিছু সৃষ্টি করার তাগিদ, তঁকে কী ঠুনকো চাকরি আটকে রাখতে পারে ? তাই ১৯৬৮ সালে সরকারি চাকরির মাসমাইনের লোভ ত্যাগ করে থিয়েটারের বিষয়ে আরও শিক্ষালাভের স্বপ্ন নিয়ে দিল্লি পাড়ি দেন। সেখানে ভর্তি হলেন ন্যাশেনাল স্কুল অফ ড্রামাতে। কিন্তু ছ’মাস ক্লাস করার পরই ন্যাশেনাল স্কুল অফ ড্রামা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে আবার ইম্ফলে ফিরে আসতে বাধ্য হন। আবার বেকারত্ব ও অভাবের জ্বালায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। চরম হতাশার মধ্যেই হঠাৎ পেয়ে গেলেন তাঁর পছন্দের এক চাকরি, মণিপুর সরকারের প্রচার দপ্তরের অধীনে ড্রামা ইউনিটের প্রযোজকের পদে। বেতন কম হলেও থিয়েটার পাগল এই লোকটি এবার মনের মত কাজ পেয়ে একটানা দশবছর চাকরি করে গেলেন। এরমধ্যেই পুরোদমে শুরু করলেন তাঁর নাট্য বিষয়ক কর্মকাণ্ড। সরকারি কাজের পাশাপাশি চলল তাঁর নাট্যচর্চা। ১৯৬৯ সালে গড়ে তুললেন তাঁর নিজস্ব নাট্যসংস্থা ‘কলাক্ষেত্র’। পরপর মঞ্চস্থ হতে লাগল --- তম্নলাই (১৯৭২), কবুই কেইওইবা (১৯৭৩), খোমদোন মেইরৌবী (১৯৭৩), ইম্ফল ৭৩ (১৯৭৪), পেবেৎ (১৯৭৫), নুপীলাল (১৯৭৮), লাইগী মচাশিংগা (১৯৭৮) ইত্যাদি। স্বল্পদিনের হলেও ন্যাশেনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রশিক্ষণলাভ ও বাদল সরকারের নাট্য কর্মশালায় যোগদানের ফলে কানহাইলালের নাটকের ধরন আমূল বদলে গিয়েছিল। তবে তিনি বাদল সরকারের অন্ধ-অনুকরণে না গিয়ে টা৬র কাছ থেকে শেখা নাট্যতত্ত্বকে মণিপুরের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করেন। সৃষ্টি করেন নিজস্ব এক ঘরানা। একজন পেশাদার নাট্যকর্মী হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্যে তিনি আবার ছেড়ে দিলেন সরকারি চাকরি। নাট্যপরিচালক কানহাইলাল যে স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতেন তাঁর সহধর্মিনী অভিনেত্রী সাবিত্রী দেবী। বিরল দুই প্রতিভাধরের যুগলবন্দিতে সৃষ্টি নাটকগুলি মণিপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত তথা বিশ্বের নাট্যমহলে স্থান করে নিল। এই পর্যায়ে সৃষ্ট তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল – মেমোইর্স আফ্রিকা (১৯৮৬), রশোমন (১৯৮৭), মীগী শারং (১৯৯১), কর্ণ (১৯৯৭), দ্রৌপদী (২০০০), নুপী (২০০২) ইত্যাদি।
১৯৯১ সালে কাইরোতে অনুষ্ঠিত ‘থার্ড কাইরো ইন্টারন্যাশেনাল ফেস্টিভেল অফ এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার’-এ কানহাইলালের নাট্যদল ‘কলাক্ষেত্র’ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। বিশ্বের নাট্য বিশেষজ্ঞদের বিচারে তাঁর ‘মীগী শারং’ (মানব খাঁচা) নাটকটি বিশ্বের নির্বাচিত সেরা ছ’টি নাটকের অন্যতম নাটক হিসেবে বিবেচিত হয় আর সাবিত্রী দেবী শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপা লাভ করেন। কানহাইলাল তাঁর নাট্যদল নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে তিনি শেষবারের মত ঢাকা সফরে গিয়ে তাঁর বিখ্যাত নাটক দ্রৌপদী মঞ্চস্থ করেন। ঢাকার দর্শকদের অনুরোধে একই মঞ্চে দ্রৌপদী নাটক দুবার মঞ্চস্থ করতে হয়েছিল সেদিন। ঢাকা থেকে ফেরার পথে আগরতলায় নজরুল কলাক্ষেত্র মঞ্চে দ্রৌপদী নাটক মঞ্চস্থ করে ত্রিপুরার নাট্যকর্মীদের মুগ্ধ করে রেখে গেছেন তিনি।
কানহাইলালের সব নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়নি নিবন্ধকারের। তম্নলাই, পেবেৎ, মেমোইর্স অফ আফ্রিকা, ডাকঘর ও দ্রৌপদী এ ক’টি মাত্র নাটক দেখার সুযোগ হয়েছে। তবে কানহাইলালের নাটকগুলি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘসময় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। সামান্য এ অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাটক সম্পর্কে দু-একটি কথাবার্তার লোভ সামলাতে পারিনি। কানহাইলালের বেশ কিছু নাটক মণিপুরি লোককথাকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। শুধু বিনোদনের জন্যে তিনি লোককথার কাহিনিকে মঞ্চে উপস্থাপন করেননি। লোককথার আঙ্গিকে তিনি তাঁর নাটকে বর্তমান সমাজ জীবনের বঞ্চনা, যন্ত্রণা, সংঘাতকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এমনই লোককথা ভিত্তিক নাটক ‘তম্নলাই’ যার বাংলা অর্থ অপদেবতা। এই লোককথার মূল চরিত্র হতদরিদ্র ঘরের অলস সন্তান চন্দ্রকংনান গুপ্তধন পেয়ে বাকি জীবন আয়াসে কাটিয়ে দিয়েছে। লোককথায় এমন ঘটনা ঘটলেও বাস্তব জীবন বড়ই কঠোর। জীবনের বাস্তবতাকে মনে রেখেই কানহাইলাল লোককথার কাহিনিটিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর নাটকের চন্দ্রকংনান গুপ্তধন পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারেনি, হাতছাড়া হয়ে যায়।
মণিপুরের জনপ্রিয় লোককথা ‘কবুই কেইওইবা’কে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে তাঁর ‘কবুই কেইওইবা’ নাটকটি। লোককথাটিতে বাঘের মাথা ও শরীর মানুষের এমন বিচিত্র জীব কবুই কেইওইবা। গভীর জঙ্গলে তার বাস। বনের নিকটবর্তী জনবসতিগুলো হল তার শিকারভূমি। কবুই কেইওইবার ভয়ে পার্শ্ববর্তী জনবসতিগুলো সব সময় ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল। সেই গ্রামে বাস করত সাত ভাই ও তাদের একমাত্র আদরের বোন থাবাতোন। আর গ্রামে ঢোকার মুখে বাস করত এক বুড়ি। এক নিশুতি রাতে কবুই কেইওইবা যথারীতি হানা দিল সেই গ্রামে। আর প্রথমেই গিয়ে ধরল বুড়িকে। বুড়ি নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে নির্দোষ অসহায় থাবাতোনের দিকে কবুই কেইওইবাকে লেলিয়ে দেয়। সে রাতে থাবাতোন ঘরে একা ছিল। থাবাতোনকে একা রেখে সাত ভাই অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে দূর দেশে চলে গিয়েছিল। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিরীহ সাধারণ মানুষকে যে এখনও বলি করা হচ্ছে সে কথাই বলতে চেয়েছেন কানহাইলাল তাঁর এই বিখ্যাত নাটকে।
কানহাইলালের সবচেয়ে আলোচিত নাটক ‘পেবেৎ’ অতি জনপ্রিয় একটি মণিপুরি লোককথা। পেবেৎ বাংলার টুনটুনির মতো ছোট্ট এক পাখি। গাছের গুঁড়ির কোটরে বাস করে। এক পেবেৎ পাখি তার সাত পেবেৎ ছানাকে নিয়ে বনের এক গাছের কোটরে বাস করত। ছানাগুলি তখনো ওড়তে শেখেনি। সেই বনের এক বিড়ালের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল পেবেৎ ছানাগুলির ওপর। যেকোনো ছুতোয় ছানাগুলোকে খেয়ে ফেলার মতলবে ছিল বিড়ালটি। তাই ছানাগুলোর কাছে ঘুরঘুর করত সে। বিড়ালের কুমতলব বুঝতে পেরে পেবেৎ পাখি বিড়ালকে তোষামোদ করে চলছিল। ইতিমধ্যে সে ছানাগুলোকে কী করে উড়তে হয় প্রতিদিনই শেখাচ্ছিল। তার ছানাগুলি যখন গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়তে শিখল তখন মতলববাজ বিড়ালকে তোষামোদ করা বন্ধ করে পেবেৎ সত্যি কথা বলে ফেলল। বিড়াল রেগে যেই পেবেৎ ছানাগুলোকে ধরতে গেল অমনি মায়ের ইশারা পেয়ে ছানাগুলো নিরাপদ গাছের ডালে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। সাবিত্রী দেবী পেবেৎ মায়ের অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন এ নাটকে। এই নাটকের ব্যাখ্যা নানাজন নানাভাবে করেছেন। এক দল নাট্য সমালোচকদের মতে মধ্যযুগে মণিপুরে আর্য সংস্কৃতির আগ্রাসনকে কানহাইলাল পেবেৎ লোককথার আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিড়ালকে আর্য সংস্কৃতির প্রতিভূ হিসিবে চিত্রিত করা হয়েছে। মণিপুরি জাতি মূলত সাতটি গোষ্ঠী (ক্ল্যান) –এর সংযুক্তিতে গড়ে উঠেছে। তাই মণিপুরি সংস্কৃতির প্রতোক পেবেৎ পাখির সাতটি ছানা। আর্য সংস্কৃতির প্রতীক বিড়ালের আগ্রাসন থেকে সাত পেবেৎ ছানাকে রক্ষা করার জন্য মণিপুরি সংস্কৃতিরূপী পেবেৎ পাখি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আরেক দল সমালোচকের মতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শত্রুর সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে নিজেদের শক্তিসঞ্চয় করে অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষার মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করেছেন। আফ্রিকার কালো মানুষদের উপর বর্ণবাদীদের অত্যাচারের কথা শুনে কানহাইলাল নিশ্চুপ থাকতে পারেননি। আফ্রিকার কালো মানুষদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে মণিপুরের স্বনামধন্য কবি লাইশ্রম সমরেন্দ্র-র লেখা কবিতাকে ভিত্তি করে কানহাইলাল সৃষ্টি করেন তাঁর অসাধারণ নাটক ‘মেমোইর্স আফ আফ্রিকা’। তাই তাঁর নাটকগুলোকে যথার্থভাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘Theatre for the ritual of suffering’।
সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন দমনের নামে নিরাপত্তা বাহিনীর অমানুষিত অত্যাচারের ঘটনাকে ভিত্তি করে লেখা মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প ‘দ্রৌপদী’ কানহাইলালকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি এই গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে ২০০০ সালে ইম্ফলে প্রথম দ্রৌপদী নাটক মঞ্চস্থ করেন। এ নাটকে সিনিয়র দ্রৌপদীর চরিত্রে সাবিত্রী দেবী দুর্ধর্ষ অভিনয় করেন। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বন্দি নকশাল নেত্রী দ্রৌপদী তাদের যৌন নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে গায়ের কাপড় ছুঁড়ে দিয়ে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। চরম প্রতিবাদের এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য সাবিত্রী দেবী দুঃসাহসের সঙ্গে মঞ্চে উপস্থাপন করেন। মঞ্চে এই দৃশ্য দেখে সেদিন মণিপুরের তথাকথিত নারীবাদীরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। ইম্ফলে এই নাটক আর মঞ্চস্থ করার মত অবস্থা ছিলনা সেদিন। কিন্তু থিয়েটারে উৎসর্গীত দুই মহান শিল্পী কানহাইলাল ও সাবিত্রী দেবী তাঁদের সৃষ্টিতে অবিচল ছিলেন। কোন কিছুর চাপে নত হয়ে তাঁদের শিপ্লকর্ম থেকে বিরত হননি। তাঁরা তাঁদের নাট্যদল নিয়ে কোলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দ্রৌপদী নাটক মঞ্চস্থ করেন। এ নাটক সর্বত্র উচ্চ প্রশংসিত হয়। ইতিমধ্যে ২০০৪ সালে উগ্রপন্থী দমনের নামে মণিপুরের নিষ্পাপ মেয়ে মনোরমাকে একদল আসাম রাইফেলস বাহিনীর লোক বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রাতভর যৌন নির্যাতন চালিয়ে পরদিন নির্জন স্থানে তার নিথর দেহ ফেলে দেওয়ার ঘটনায় সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিল মণিপুর। সেসময় আসাম রাইফেলস বাহিনীর হেড কোয়ার্টার কাংলার প্রধান ফটকের সামনে মণিপুরের মায়েরা নগ্ন হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। আগামদর্শী শিল্পী কানহাইলাল মণিপুরে কী ঘটতে চলেছে অনুভব করতে পেরেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে মণিপুরের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট খুঁজে পেয়েছিলেন। আগামীতে যা ঘটতে যাচ্ছে তা তিনি মঞ্চে আগাম দেখিয়েছিলেন। এখন কানহাইলালের দ্রৌপদী মণিপুরের অতি জনপ্রিয় নাটক। সাবিত্রী দেবী সমগ্র মণিপুরবাসীর ইমা (মা) –র আসনে প্রতিষ্ঠিতা।
কানহাইলাল নাটক নিয়ে সারাজীবন নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন। ইম্ফলের বিখ্যাত ইমা কেইথেল (মায়েদের বাজার)-এর একশজন সব্জি, মাছ, কাপড় বিক্রেতা ইমাকে তালিম দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন ‘নুপীলাল’ (নারীবিদ্রোহ) নাটকে। ১৯৩৯ সালে মণিপুরে সংঘটিত নারী বিদ্রোহের প্টভূমিকায় এই ‘নুপীলাল’ নাটক লেখা হয়েছে। সাবিত্রী দেবী বাজারের এক পাগলিনীর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন করেছিলেন এ নাটকে। মণিপুরের প্রত্যন্ত উমাথেল গ্রামের রাখাল বালকদের সংগঠিত করে কানহাইলাল মঞ্চস্থ করান ‘শঞ্জেন্নহা” (রাখাল বালক)। চূড়াচান্দপুর জেলার পাইতে উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামে শিবির গেড়ে তাদের নিয়ে নাট্যকর্মশালা করেন এবং তাদের লোককথাকে ভিত্তি করে তৈরি করা নাটক মঞ্চস্থ করেন। মণিপুরের বাইরে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার অন্তর্গত রাভা উপজাতি অধ্যুষিত রামপুরে ধারাবাহিকভাবে বছরের পর বছর নাট্যকর্মশালা ও নাট্য মঞ্চায়নের মাধ্যমে সেখানকার বেশ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে জাতীয়স্তরে তুলে এনেছিলেন তিনি। তাঁর ছাত্র শুক্রাচার্য রাভা বিয়ন্তী রাভা থিয়েটারে সংগীত-নাটক একাডেমির যুব পুরস্কার পেয়েছেন। এভাবে কানহাইলাল ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নাট্যকর্মশালা সম্পাদন করে অনেক নাট্যপ্রতিভাকে পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছেন। ত্রিপুরাতেও তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ কয়েকটি নাট্যকর্মশালা সংগঠিত করেছেন। তাছাড়া ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ তিন বছর ধরে ফোর্ড ফাউন্ডেশানের অর্থানুকুল্যে দীর্ঘমেয়াদী থিয়েটারের রিসার্চ প্রোজেক্ট সম্পাদন করেছেন।। সিঙ্গাপুর থিয়েটার ওয়ার্কস-এর ব্যবস্থাপনায় থিয়েটারের গবেষণার কাজে ২০০২ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সফর করেন। থিয়েটার নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা ও চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর বিখ্যাত দুই গ্রন্থ ‘Theatre for the Ritual suffering’ ও ‘Theatre of the Earth’ –এ। ২০০৭ সালে আমেরিকার Blackwell Publishing House কর্তৃক প্রকাশিত বিখ্যাত নাট্যতত্ত্ব বিষয়ক ‘Theatre in Theory 1900-2000’ সংকলন গ্রন্থে কানহাইলালের নাট্যতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ ‘Ritual Theatre’ স্থান পেয়েছে। কোন ভারতীয় নাট্য বিশেষজ্ঞের নাট্যতত্ত্ব এ গ্রন্থে স্থান পাওয়াটা সত্যিই এক বিরল সম্মান। তাছাড়া কানহাইলালের নাটক বিষয়ে বিশিষ্ট পাশ্চাত্য নাট্য সমালোচক রুস্তম বরুচা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Theatre of Kanhailal’s Pabet and Memories of Africa-এ কানহাইলালের পেবেৎ ও মেমোইর্স অফ আফ্রিকা এ দুটো নাটকের চুলচেরা ব্যাখ্যা করেছেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
থিয়েটারে তাঁর বিশেষ অবদানের জল্যে কানহাইলাল ১৯৮২ সালে লাভ করেন মণিপুর স্টেট কলা একাডেমি পুরস্কার। নাট্য নির্দেশনায় সংগীত-নাটক একাডেমির পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯৭ সালে মণিপুরি সাহত্য পরিষদ, ইম্ফাল তাঁকে নাট্যরত্ন উপাধিতে ভূষিত করেন। পেয়েছেন কমলকুমারী ন্যাশেনাল এওয়ার্ড। ২০০৪ সালে তিনি পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন। ২০১২ সালে তিনি সংগীতনাটক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ইতিপূর্বে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে মাত্র দুজন ব্যক্তি এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। তাঁরা হলেন স্বনামধন্য গীতিকার ও শিল্পী ডঃ ভূপেন হাজারিকা এবং মণিপুরের বিশিষ্ট পণ্ডিত এন খেলচন্দ্র। ২০১৬ সালে ভারত সরকার কানহাইলালকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন