অনুগল্প

ঈশানকোণ একটি বাংলা সাহিত্যের ওয়েবব্জিন জুলাই-আগস্ট সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা

বাস্তব
লোপামুদ্রা সিংহদেব

দরমার দরজা ঠেলে মিন্টু দৌড়ে ঘরে ঢোকে, চোখে মুখে ভয়। এতো সকালে ছেলেকে দেখতে পেয়ে মার মনেও প্রশ্ন ভিড় করে আসে, আশঙ্কাও। ছেলের কপালের কাটা দাগটা আশঙ্কাটা বাড়িয়ে দেয়। কি হলো প্রশ্নটার সঙ্গে সঙ্গে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মিন্টু, বলে “মা সনাতন কাকা তোমারে মিথ্যে বলে নিয়ে গেছে আমারে। বাড়ির সব কাজ করায় আমারে দিয়ে, তারপর রাতের বেলা ব্লাউজের হুক লাগানোর কাজ। একটু চোখের পাতা লেগে এলেই জোটে মার। আমি পালিয়ে এসেছি মা -- কাল রাতের বেলা আমারে খুব মেরেছে -- আজ সকালে জল ভরবার বাহানায় বালতি নিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে এসেছি। মা, মাগো আমি আর যাবনা মা--।"
তেরো বছরের মিন্টুর কথা শুনতে শুনতে চোখের জলে বুক ভাসে মানদার, সঙ্গে সঙ্গে ভয়টাও চাগাড় দেয়। গ্রামের ছেলে সনাতন ঠিক আসবে মিন্টুর খুঁজে। মিন্টুর বাবা মারা যাবার পর সনাতন দর্জি এসে কতো ভালো ভালো কথা বলে ছিল, 'তোমার ছেলেকে আমাকে দাও, ওকে আমি আমার মতন বড়ো দর্জি বানাবো মানদা। দেখবে তোমার পয়সার অভাব থাকবে না"। কত আশা করে পাঠিয়েছিল ছেলেটাকে ― এই তার পরিণতি। ছেলের চোখের জল মুছিয়ে আদর করে মানদা। কিন্তু না, ছোট ছেলে মেয়ে দুটো ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখে ফেলার আগেই মিন্টুকে পাঠিয়ে দিতে হবে দূরে -- ওই পিশাচটার নাগালের বাইরে। মিন্টুকে রাতের বাসি রুটি গুড় আর দুটো টাকা দিয়ে মানদা বলে -- "পালা মিন্টু, সবার চোখ এড়িয়ে তুই পালা, নাহলে রাক্ষসটা তোরে আস্ত রাখবে না। তোরে খুঁজতে ঠিক আসবে এখানে ― তুই পালা"। ভয় গ্রাস করে মিন্টুকেও। মাকে একবার জড়িয়ে ধরে, তারপর দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে যায় নাম না জানা গন্তব্যে। দৌড়োতে দৌড়োতে স্টেশনে এসে চেপে বসে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের কামরায়। জীবনে এই প্রথম তার ট্রেনে চড়া। হুইসল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়লে শ্বাস টানে বুক ভরে – কটা স্টেশন পার হয়ে যাবার পর টিকিট চেকারের নজরে পড়ে সে। "কিরে টিকিট কোথায়"? ভ‍্যাবলার মত চেয়ে থাকে অজ্ঞ মিন্টু। টিকিট বাবুর একটু দয়া হয়, বলে "বাড়ি থেকে পালিয়েছিস বুঝি ― সামনের স্টেশনে নেমে যাবি"।
নাম না জানা শহরে এসে পড়ে মিন্টু। মার দেওয়া রুটিটা খায়, জল খায় পেট ভরে। রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে পড়ে, অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকে সারি সারি খাবারের দোকান, মনোহারী, খেলনা, জামাকাপড় আর ও কত কিছু সাজানো দোকান। তাদের গ্রামে তো সে এত দোকান কোন দিন দেখেনি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়, ক্ষিধে তেষ্টায় ক্লান্ত মিন্টু পকেটের দুটো টাকা সম্বল করে একটা খাবারের দোকানে এসে দাঁড়ায়। শুনতে পায় দোকানদারের বিলাপ―'ছোটু হতভাগাটা জ্বর বাধিয়ে বসল এখন এই বাসনের কাঁড়ি ধোবে কে, কি যে করি'। মিন্টু যেন হাতে চাঁদ পায়, দৌড়ে গিয়ে দোকানিকে বলে "কর্তা, আমারে দেন না, আমি বাসন কটা মেজে দি"। দোকানি ক্লান্ত, অবসন্ন মিন্টুকে জরিপ করে খানিকক্ষণ, বলে "কোথা থেকে উদয় হলে বাবা? চুরি-টুরি ক‍রে ভাগবে না তো"? মিন্টু র পেটে ক্ষিধে মোচড় দেয়, সে বলে- "আজ্ঞে কর্তা, আমারে বিশ্বেস করেন, বড্ড ক্ষিধে লেগেছে, পয়সা পেলে একটু কিছু খেতে পাই"।
দোকানি সুযোগ হাতছাড়া হতে না দিয়ে মিন্টুকে বসিয়ে দেয় বাসন ধুতে। বাসন মাজতে মাজতে ক্লান্ত মিন্টু দেখতে পায়, রাস্তা দিয়ে চলেছে এক বিরাট মিছিল, ছোট-বড়, মাঝারি কত মাপের মানুষ হাতে কী সব লেখা বোর্ড নিয়ে চলেছে। মুখে তাদের স্লোগান--'বাল শ্রমিক প্রথা বন্ধ কর, বন্ধ কর, শিশুদের ওপর অত‍্যাচার চলবে না, চলবে না, শিশুদের শিক্ষার অধিকার দিতে হবে দিতে হবে......।' অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মিন্টু ― পেটটা ক্ষিধেয় মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসহায় মা আর ভাই-বোন দুটোর মুখ। সে রোজগার না করলে কি করে চলবে? থেমে যাওয়া হাতটা হঠাৎ দ্বিগুণ জোরে কড়াইটা ঘষতে থাকে ― শহরের বাবুরা অমন বলেই থাকে ― সে কথা শুনলে মিন্টুর চলবে কেন!

 
                                                                HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন