ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি বাংলা সাহিত্যের ওয়েবব্জিন জুলাই-আগস্ট সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা

উদ্ধার
নকুল রায়

   বিজয়াদশমীর রাত বারোটা-সাড়ে বারোটা। দূর থেকে তখনো শোনা যাচ্ছিল প্রতিমা বিসর্জনের কর্কশ কোলাহল। দশমীঘাটের সমস্ত প্রতিমার ‘শবদেহ’ ভেসে চলছে পশ্চিম বাঁকে। হাওড়া নদীর ওপর ব্রীজ, এক ফার্লং দূরেই দশমীঘাট। আধা-আলোঅন্ধকারে, কাছিমের পিঠের মতো ভেসে আছে জওহর ব্রীজটি। তার তলা থেকে স্নানের শব্দ ভেসে আসছে। বিসর্জনকারীদের শেষ দলটিও চলে যাচ্ছে। আগরতলা শহর যেন রণক্লান্ত অথবা ব্যথাতুর।
দশমীঘাটের পূর্বপান্তে মহাশ্মশান। কে যেনো চেঁচিয়ে বললে – ‘ভালা দিন্অই মরছে’। অদূরে, চিতা জ্বলছে একটা চুল্লিতে। ছায়ার মতো শববাহকেরা এদিকওদিক নড়ে-চড়ে হাঁটছে। কেউ আগুনটা উস্কে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে দুয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটু ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া। দশমীঘাট বাঁধের ওপর উঠে, সোজা পশ্চিমদিকে কিছুটা গিয়ে আবার বাঁকা মোড় নিয়ে ময়াল সাপের মতো চলে গেছে ইটের পথটি রাজনগর গ্রামের দিকে। অধিকাংশ দিন-মজুর, হতদরিদ্র ছেঁড়া তোষকের সব মানুষ তুলোর মতো উড়তে উড়তে, এই রাজনগর নদীর চরে বসবাস করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে থেকে গেলো। শুধু থাকলো না, বছরের পর বছর ধরে, নদীর চরে, নদীর বুক থেকে মাটি তুলে উঁচু ভিটে বানিয়ে, বাঁশের খুঁটি লাগিয়ে ফেললো প্রায় আধ মাইল জুড়ে। ছিন্নমূলেরা এভাবেই এক জায়গায় জমা হয় আস্তে আস্তে। এদের সমাজ হয়। নামও হয় একটা, চরায় লোক। চর-বাসিন্দে। এইরকম চর-বাসিন্দের দুয়েকটা সংসারের কথা আমি আজ আপনাদের শোনাতে চাই, যাদের অতীত এখন ম্লান, বর্তমান ভঙ্গুর আর ভবিষ্যতের সীমা কতদূর তাদের জন্যে ফলপ্রসূ, আমার জানা নেই।

বুক চাপড়ে, এক বৃদ্ধ ৫৫ থেকে ৬০ হবে হয়তো বয়েস, যাকে গৌরাঙ্গদা বলে সবাই ডাকে, কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, তার খুঁট-প্রান্তভাগ দুপায়ের নিচে গলে পেছনের দিকে চলে গেছে, জল-মাটি-কাদায় একাকার বৃদ্ধের শরীর, দীর্ঘ পাতলা শরীরটা ঝুঁকে পড়ছে, সকালের দিকে তার হাফ সার্টটির রং ছিলো আকাশি, এখন কাদা ছাড়া কোন রং নেই, মুখ গোল ভাঙা, চোখ দুটো খুবই ছোট হতে হতে বোতামের মতো হয়ে গেছে, মুখের ভেতরটা বিশাল হাঁ নিয়ে চিৎকার করে গাইতে গাইতে চলেছে—
“আমি ডাকি মা মা
মায়তো কানে শুনে না
ছাইড়া যাইতে পরানডারে
কী দিয়া তুই বান্দলি তারে,
কইয়া যা না একবার আইয়্যা
অই অবলা…”
বৃদ্ধের উদাত্ত প্যাথোজ, ঘর-বাড়ির প্রতিটি জানলা দরজায় যেন আছড়ে পড়ছে। ৪-৫টা বালক জল-কাদা মাখা, তার পিছু পিছু অতি নিঃশব্দে বিহ্বল হয়ে ছায়াপথের মতো হেঁটে-থেমে, আবার দাঁড়িয়ে পড়ে, বৃদ্ধের পিছু চলতেও থাকে।
বৃদ্ধ পড়ে যেতেই, বাচ্চাগুলি হুমড়ি খেয়ে পড়লো বৃদ্ধের পাশে। কান্নায় ভেঙে পড়া ছোট ছোট হাতে অতি আদরে শ্রদ্ধায় মেশানোতে উঠিয়ে বসলো।
বৃদ্ধ ওদের কোলে নিয়ে এবার সত্যি সত্যি নিম্নস্বরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।


জনৈক একনিষ্ঠ সাংবাদিকের ডায়েরি থেকেঃ
বিষয়টা যখন আমি নামধামসহখবরের কাগজে পরপর দু’দিন প্রকাশ করে ফেলি, তৃতীয় দিন সকালের দিকে বলতে গেলে আমি ভয়ংকর এক মৃত্যুর মুখোমুখি হই।
প্রথমে ঘুম ভাঙে দরজা ভাঙার শব্দে। ডান দিকের শিয়রের পাশে গ্রীল দেয়া জানালা ফাঁক হয়ে একটি শাবল ঢুকে পড়ে। টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হয়েছে।
কী করবো, আগেই দরজার পাল্লা ভেঙে পড়ে গেলো ভেতরে, প্রায় আমার পায়ের কাছে।
গোটা পাঁচেক তরূণ। প্রত্যেকের হাতে কিছু না কিছু অস্ত্র। সামনের মোটা মতোন বয়েস ২৫-২৬র ছেলেটির শরীরে একটি খয়েরি গেঞ্জি। ব্রাউন রঙের প্যান্ট। স্থানীয়র’দের একজন। তার ছবিটাই কাগজে দিয়েছি। আসল কালপ্রিট।
-- শুয়োরের বাচ্চা! তুই সাংবাদিক না? আমরা রাজনগরের মুকুটহীন সম্রাট, আর শালা তুই আমার পেছনে লাগছিস!
আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। প্রচণ্ডভাবে মার যে খেয়েছি তা সাত দিন বাদে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে টের পেয়েছি।


রাজনগর গ্রামের চর-বাসিন্দে গৌরাঙ্গ সরকারের বয়েস ষাটের কাছাকাছি। রোজগার বলতে বসে ঠোঙা বানানো, কম দরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাগজ কেনা। আরেকটি রোজগার, যে রোজগারে তার মাসাধিককাল চলে যায়, তার নিজস্ব চিন্তার ফসল, সেটা হলো প্রতিবছর দশমীঘাটে জলে নেমে বিসর্জনের প্রতিমার কাপড়চোপড় সংগ্রহ করা, প্রতিমার অস্ত্র-শস্ত্র অক্ষত অবস্থায় এনে পরে রং করে খেলনা হিসেবে সেগুলি বিক্রি করা কোন মেলায়-টেলায়, আর বাঁশের কাঠামো ও কাঠ সংগ্রহ করা। বাঁশগুলো জ্বালানো ও ঘরের মেরামতি চলে। কাপড়-চোপড় ধোলাই করে এমন নতুন করা হয় যে, সেগুলি প্রতিমা-সাজার দোকানে কম দামে বিক্রি করা যায়, ধুতিটুতি নিজের ব্যবহারে লাগে।
গৌরাঙ্গ সরকারের দুই মেয়ে, নিজে ও স্ত্রী – এই নিয়ে সংসার। বড় মেয়ের নাম দুর্গা। অবিকল দুর্গার মুখ। ফর্সা এবং নাক-চোখ ঠোঁট ও দাঁত এসবের যদি যত্ন করতে পারতো, আর ৫ম শ্রেণীতে না হয়ে কলেজের ছাত্রী হতো, আমার মনে হয় রাজনগর কেন, গোটা শহরে এমন সুন্দরী কমই পাওয়া যেত। তার মনটা খুব উদার, খুব কম কথা বলতে অভ্যস্ত। ঘরের কাজ এবং বাবার সঙ্গে বসে মায়ের হাত ধরে ধরে ঠোঙা বানানোটা তার দৈনিক কাজ।
দুবছরের ছোট বোন একা। সে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নিজের বাড়ির কাছেই এক বালোয়ারি স্কুলে পড়ায়। বড় বোনের মতো এমন শারীরিক সৌন্দর্য তার নেই, বরং শরীরের রং একটু শ্যামলা, একটু খাটো, কিন্তু মানানসই; সবচেয়ে বড় কথা, তার কণ্ঠস্বরে এমন এক জাদু আছে যে নাটকের উপযুক্ত গলা মনে হয়। যাকে দেখলাম না কিন্তু তার কণ্ঠস্বর চিনি, তেমন।
একার সঙ্গে ঘটনাচক্রে পরিচয়। একদিন;
-- ভেতরে আসতে পারি?
খবরের কাগজের অফিস, সন্ধের দিকে সে এসেছিলো।
-- বসুন।
-- আমাকে একটা উপকার করবেন? আমি রাজনগরে থাকি। আপনি তো জয়নগরে, কাছেই।
তার দিকে তাকালাম। মেটাবলিক সাউন্ড। কণ্ঠস্বরে এমন ব্যক্তিত্ব, স্পষ্ট দ্বিধাহীন বাচনভঙ্গি আমাকে আকৃষ্ট করে।
দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বললাম, চা খাবেন তো?
--- হ্যাঁ। খাবো।
মেয়েটি যা বলেছিলো, তা পুরোটা এখানে বলবো না কিন্তু আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যেই একা কিংবা একার বোন আক্রান্ত হতে পারে। একজন নেতা গোছের গুন্ডা যার দৌরাত্ব্যে চর-বাসিন্দেরা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। একটি মারুতি আর গোটা চারেক শিষ্য নিয়ে সে বাংলাদেশে যুবতি পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে মিড্ল-ইস্টে সেই যুবতিরা ক্রমপর্যায়ে বিক্রি হতে হতে একসময় ত্রিপুরা নামক রাজ্য থেকে তাদের নামই মুছে যায়।
এর মধ্যে দুবার তার থাবা বিস্তার করার সুযোগ খুঁজেছে। সুতরাং আমাকে ব্যবস্থা নিতেই হলো। খোঁজ খবর নিলাম। তার ফটো তুললাম গোপনে। তার গাড়ি ও সাকরেদদের বাই দ্য রেকর্ড করলাম, আর লক্ষ্য রাখলাম কোন এলিবাই হাত-ছাড়া হয়ে যায় কিনা।
ক্রমশ একার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হলো আমার। গোটা পরিবারটা আমার নিজস্ব ভুবন মনে হলো। আমি ভয়ংকর রকমের ঝুঁকি নিয়ে চললাম।
সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে নিলাম। তিনি জানালেন এগিয়ে যেতে। পুলিশের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলি, কারণ ঘটনাটা আমাকে শেষপর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে চলছিলো। আমি নেশাগ্রস্ত বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। জানি এটা হিন্দি সিনেমার ফিক্সান নয়, আমাকে বাস্তবিক মৃত্যুর দূতের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।

ঠোঙাতে আঠা লাগাতে ব্যস্ত দুর্গা। সন্ধেবেলায় একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির একটি বাচ্চা এসে খবর দিলো, ‘দিদি তুমারে ডাকতাছে’।
-- কেডা রে?
-- চিনি না। তুমি আইতা, একটা মাইয়া লুক ডাকতাছে।
দুর্গা একটা ন্যাকড়ায় হাতের আঙুল মুছে বাইরে আসে। একা, ওদের বাবা ও মা পাশের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানে গেছে। দুর্গা ভাবলো সেই বাড়ির কেউ। বাইরে, অন্ধকার ঠেলে চার কদম যেতেই – দেখে, মারুতির ভেতর থেকে বেরিয়ে সেই গুন্ডা দলবল সহ তার দিকে দৌড়ে আসছে। দুর্গার গলা বসে যায়। এমনিতেই তার কণ্ঠস্বর কোমল। সে দৌড়ে চলে গেলো অনুষ্ঠান বাড়িতে। সেখানে আলোর ঝলকানিতে পড়ে সামনেই পেয়ে গেল পাড়ার এক কিশোরকে। তার কাছে গিয়ে ভেঙে পড়লো সে।
ঘটনাটি আর এগোয় নি। মারুতি চলে গেল।
পরদিন একার মুখে সব শুনলাম।
-- তোমাকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে আমি ব্যবস্থা নেবো। একা আঙুলে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে।
-- কী ব্যবস্থা?
-- গুলি করে মেরে ফেলো।
-- এটা সিনেমা নয়, আবেগের প্রশ্ন নয়। আমি নিজেই শেষ করে দিতে পারি, সে ব্যবস্থা ও সাহস আমার আছে। কিন্তু এর পরে তো বাঁচতে হবে। কাজেই, আরেকটু সময়, আমি তাকে জালে আটকাবো।

বিজয়াদশমীর বিকেল থেকেই চার-পাঁচটা চরের শিশু ও কিশোর নিয়ে, গৌরাঙ্গ আবার দশমীঘাটে হাজির। প্রতিমা তখনো বিসর্জনে আসছে না, শুধু পাড়ার ছোটদের বানানো দেড় হাত বাই চার হাতের কাঠামো বিসর্জন করে ওরা নাচতে নাচতে চলে গেলো। গৌরাঙ্গদের কেউ ওদিকে গেলো না, শুধু তার বাচ্চা শিষ্যরা হাততালি দিয়ে ‘দুগ্‌গা মাই কি, জয়’। বলে উল্লাস দেখালো।
-- কাহা, মূর্তি আইতাছে মন্‌অ হয়। কিশোরটি দূরে আঙুল তুলে দেখালো।
-- আইওক্, তরা রেডি অইয়া থাক। এইবার নাকি কাডাম বাড়ছে শুনলাম। গৌরাঙ্গ তৃপ্তির সঙ্গে ঢোক গিলে, কাঁধের গামছাটা কোমরে বেঁধে একটা বিড়ি ধরায়।
-- আম্রাও শুনতাছি। একশ চল্লিশটা। গতবার আছিল একশ কুরিডা।
হঠাৎ তার কথা ডুবে গেলো। রাজ আমল থেকেই বিসর্জনের মিছিলের প্রথম দুর্গা প্রতিমা থাকবে স্থানীয় দুর্গাবাড়ির প্রতিমা। ব্যান্ড বাজিয়ে, সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত বাদ্যকর প্রতিমার সামনে বাজাতে বাজাতে শহর পরিক্রমা করে দশমীঘাটে এল। বাজির শব্দ ও ব্যান্ডপার্টির কোরাসে, বাদ্যযন্ত্র-সুর আকাশেবাতাসে ভেসে যাচ্ছিলো। গোটা দশমীঘাটে তখন হাজার হাজার মানুষের স্রোত। বিসর্জনের এমন দৃশ্য আগরতলা শহরে আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। আবালবৃদ্ধবনিতার স্রোতের তোড়ে দুর্গা প্রতিমা হাওড়ার জলে ধরাধরি করে নামানো হল গাড়ি থেকে।
দুর্গাবাড়ির মূল প্রতিমা মন্দিরেই থাকে। শুধু প্রতিবছর নতুন মূর্তি প্রতিমা বানিয়ে পুজা করা হয়। অষ্টমীতে মোষ বলি দেওয়া হয়। এই রীতি এখনো আছে।
আমি একার সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। দুর্গা আমার বাঁহাতের কনুইয়ের সঙ্গেই আছে। সামনে উত্তাল হাওড়ার জল। জলের তলের বালিতে স্রোতের বালিতে পা ডুবিয়ে, কখন সাঁতরে একটার একটা প্রতিমার শরীর খুলে নেংটো করে, পোশাক-আশাক খুলে চলছে গৌরাঙ্গ ও তার শিষ্যরা। প্রচুর মানুষ তখন জলে। শতাধিক মানুষের জটলা, ঢাকের আওয়াজ, শত শত ঢাকি বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে চলছে।
কোনো শব্দ কানে কানে বললেও ভালো শোনা যায়না। হঠাৎ হঠাৎ বলতে হয় কাউকে কিছু। হঠাৎ নীরবতার ফাঁক গুনতে হয়।
গৌরাঙ্গ মাঝ নদীতে চলে যায়, যেখানে ডুবজলের গভীরতা। সেখানে ডুব দিয়ে জলের তলা থেকে টেনে তুলে, বাচ্চাদের সাহায্যে সে হাঁটু জলের কাছে নিয়ে আসে কাঠামোগুলি, কাঠামোর বাঁশ কাঠ জড়ো করে সোজা শুকনো জায়গায় একটু দূরে সাজিয়ে রাখছে একটি বাচ্চা। সে পাহারা দিচ্ছে, আবার জলে ঝাঁপও দিচ্ছে।
গৌরাঙ্গ প্রতিমার অস্ত্র-শস্ত্রগুলি জড়ো করে প্রতিমার কাপড়েই পুঁটলি বেঁধে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে জমানো স্তূপে।
আমি ক্যামেরা নিয়ে জলে নামলাম। কারণ খুব কাছ থেকে প্রতিমার বিসর্জনের পেথোজ থাকলে তা তুলে নেবো। প্রচণ্ড হৈহৈ-ভেতর কেউ কোথাও নেই। আমি বেপরোয়া হয়ে পড়লাম। যখন যে-কাজটি করি একমুখিতার স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে যায়।
হাওড়ার দক্ষিণ পাড়ের বসতবাড়ি গাছগুলিতে দিনের আলোর মতোন সার্চলাইট পড়েছে। আর ছোট ছোট পাখিগুলি তাদের আশ্রয় ছেড়ে আলোর মধ্যে যেন উড়ছে আর শব্দের বান ছড়াচ্ছে। এমন রাতের নিসর্গে পাখিরা আমাকে উদাস করে দিল।
কিশোরটি মাঝ নদীতে কোমর পর্যন্ত নেমে একটি কাঠামো ছুঁতে যেতেই পায়ের কাছে আরেকটি কাঠামো পেলো। কিন্তু সে পা দিয়ে ছুঁয়ে বুঝলো প্রতিমার কাপড়ে পা জড়িয়ে গেছে।
-- ও কাহা, ইহানে সিঙ্গেল আছে গো। কিশোরটির কথাটার অর্থ হলো, প্রতিমাটি আলাদা।
-- তুই খুইল্যা নে। আমি ডুব দিব ইহানে। খুডিটা আটকাইয়া গেছে বালুতে। গৌরাঙ্গ মুখ খিঁচিয়ে তাকে বলে।
কিশোরটি জলের নিচে কাপড় খুলছে কোমর থেকে। এবং অনায়াসে। সে অবচেতনেই অবাক হলো। প্রতিমার পা ঊরু যৌনাঙ্গে পা লাগিয়ে তার ব্লাউজ খুলছে, ব্লাউজ খুলে স্তনে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরতেই সে লাফ মেরে ওঠে। কাপড়-চোপড় পুঁটলি করে, সাঁতরে মাঝ নদীতে গিয়ে গৌরাঙ্গকে বলে – ‘কাহা ইডা মানুষ গো, মূর্তি না’।
গৌরাঙ্গ টানা-হ্যাঁচড়া করে বহু কষ্টে কাঠামোর বাঁশটি সরালো। তারপর নিচ থেকে দেবী দুর্গার কাপড় খুলতে পেরে যেন, এতক্ষণ পরে তার মুখে হাসি ফুটলো। বললে, ‘আইতাছি, তুই যা’।
গৌরাঙ্গ এলো। বহু পুণ্যার্থীর জলের ছিটায় ধাক্কায় ওরা দূরে সরে যায়, আবার আসে। বাচ্চাগুলিকে ডাকলো গৌরাঙ্গ। ওরা চারটা শিশু একটা কিশোর মিলে, জলের তলা থেকে নগ্ন প্রতিমাটি জলের ওপর তুলে ধরল।
-- ভাতিজারে, ইডা দেহি দুগ্গারে! আম্রার দুগ্গমা মা-রে, কেডা হেরে মারলোরে এএএ হেহেহে…’
এরপর আর কোন দৃশ্য নেই। কোন শব্দ নেই। চতুর্দিকে এত কোলাহল, এত উল্লাস এত আলোকোজ্জ্বল পাখি, ছড়ানো ঢাকের আওয়াজ, কোন কিছুই গৌরাঙ্গকে বিদ্ধ করতে পারলো না।
চারটে শিশু, একটি কিশোর ও একজন অক্ষম পিতার ক্রন্দনে কোন ঈশ্বর এগিয়ে এলো না।
                                                                                 HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন