ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি বাংলা সাহিত্যের ওয়েবব্জিন জুলাই-আগস্ট সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা

সংকেত
বিজয়া দেব

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে যে লোকটা তাকে দেখে চমকে উঠলাম। মুখে একরাশ শুকনো দাড়ি, মাথায় লম্বা হয়ে যাওয়া একরাশ চুল, চোখদুটো প্রখর, তেজি। দীর্ঘদিন অযত্নে যাপিত জীবন এমনটা হয়ে থাকে। আমার ভয় করে উঠল।
-- আপনার বাড়িতে একটু আশ্রয় চাই।
মানে ? কোথাকার লোক, চেনা নেই, জানা নেই। পাগল হবে নিশ্চিত।
-- আমার কোনও ঠাঁই নেই কোথাও। নিরাশ্রয়ের কষ্ট বোঝেন ? বেশ, একটু বসতে দেবেন ? দুটো কথা ত বলা যায় ?
বলে লোকটা ঘরে যে ঢুকেই পড়ল! এই ভর সন্ধ্যেবেলা, ঘরের ভেতর জড়ো হওয়া অস্পষ্ট আধার...লোকটি জাঁকিয়ে বসেছে সোফায়। এই অচেনা লোকটি আমার ঘরে ঢুকেই পড়ল , কীভাবে ? মানে ঢুকতে পারল আমি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম বলেই, না হলে ও ঢুকতে পারবে কেন ? কিন্তু কেন ঢুকতে দিলাম ? এই তো দিন চারেক আগে এ শহরেই এক বাড়িতে এক বৃদ্ধা মহিলা খুন হয়েছেন। তাছাড়া, চুরি হছছে খুব। এই ত পাশের গলিতে দিনদুপুরে চুরি হয়ে গেল। চুরি না বলে ডাকাতি বলাই ভাল। দিনে চুরি মানে ত ডাকাতি। এই লোকটা যদি দরজাটা লাগিয়ে দেয়! খুব জোরে আমার শ্বাসনালী চেপে ধরে! যদি ...
-- আচ্ছা, দেবতাদের কোনও কষ্ট নেই, কি বলেন ?
আমি ফের চমকিত।
-- একগ্লাস জল খাওয়াবেন ? ফ্রিজে পুরনো মিষ্টি ফিস্টি আছে ?
এখন বাড়িতে কেউ নেই। মিমি স্যারের বাড়ি, টিউশানিতে। সুজন অফিস থেকে ফেরার পথে মিমিকে নিয়ে আসবে। তবু কিসের অশেষ টানে আমি একগ্লাস জল, মিষ্টি ও বিস্কুট প্লেটে সাজিয়ে লোকটার সামনে রাখলাম কে জানে ! আমার মনে হচ্ছে এসব কাজ আমি নিজে করছি মোটেই তা নয়, কেউ যেন আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে।
-- বুঝলেন, আজকাল দিনরাত দেবতাদের নিয়ে ভাবি। স্বর্গরাজ্য, আহা ! জ্যোৎস্নার মত সারাক্ষণ পেলব আলো, খিদে, তৃষ্ণা সব মিটিয়ে দিচ্ছে অমৃত। পারিজাত কুসুম ফুটে আছে থরে থরে ...অপ্সরা নৃত্য করছে ...সুখ সুখ ঢালাও অপরিমেয় সুখ। জন্ম নেই জরা নেই মৃত্যু নেই ...কত ভাগ্য হলে যে ভগবান হওয়া যায়!
লোকটি জল খেল, এমন জল খাওয়ার ধরনও কখনও দেখি নি, যেন শুষে নিল। এবার বিস্কুট খাচ্ছে ...ধীরে ধীরে...
-- সত্যি কি ভগবান আছে ? নাকি কুঁচবরণ কন্যা তার মেঘবরণ চুলের মত ব্যাপার ? -- বলে একটু ভ্রূ কুঁচকে তর্জনি তুলে বলে,
-- আছে আছে। ভগবান আছে। খুব মজাতেই আছে। মেঘবরণ চুল নিয়ে কুঁচবরণ কন্যা ত আছেই।
এবার লোকটি মিষ্টিগুলো দাঁতে কাটছে। দাঁতগুলো সরু, ইঁদুরের মত ছুঁচলো।
-- বুঝলেন, আমি জেলে ছিলাম। আজ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। বেরিয়েই সোজা এখানে। অনেকদিন পর বরাকনদী দেখলাম। কী নদী, বাব্বা! একেবারে রূপের রানি।
-- জেলে ? জেলে কেন ? আমি আঁতকে উঠেছি।
-- না না, খুনটুন করিনি। ভয় পাবেন না। নৌকোতে করে যেন ভেসে ভেসে এসেছিলাম, ওপার থেকে এপারে। কবে এসেছিলাম মনে করতে পারি না। এ জন্মে, নাকি পূর্বজন্মে ?
-- ওপারে মানে ?
-- ওপারে গো। বাড়ি ছিল সুরমা নদীর পারে / দমকা একটা ঝড় আসিয়া রে / ভাইঙ্গা নিল তারে ...। মাছভরা পুকুর, গোলাভরা ধান ... ইতিহাস বটে, ত সেই দোষেই জেলে গেলাম।
-- ছাড়া পেলেন কি করে ?
-- ছাড়া পেয়েছি ? পাই নি ত! এই যে হাতপায়ে বেড়ি। লোকটা নিজের হাত পা দেখায়।
-- অনেক বয়েস আমার। একশ’ পেরিয়েছে কবে!
-- একশ ?
-- তাই হবে। বুঝুন, গাছপাথর আছে কি বয়েসের ? আরও বেশি হতেও পারে। যতদিন চন্দ্রসূর্য ততদিন আমি। যতদিন আলোবাতাস ততদিন আমি। এই দেখুন, আমি ঐ গানটা জানি ...পদ্মার ঢেউ রে / মোর শূন্য হৃদয়পদ্ম দিয়ে যা ...যা রে ... আবার এটাও জানি , ওরে বরাক নদী , তুই যে রূপের রানি / তোর রূপ দেখে মোর মন ভরে যায় / হারাই যে পরাণী / ওরে বরাক নদী ...তবে নদী বড় নিষ্ঠুর গো, বলে তুই সুরমা গাঙ্গের মানুষ, সে যে আমার বিমাতার মেয়ে ...এখানে তোর ঠাঁই নেই ...
এখন সুজন ও মিমি এসে ঢুকল। এই লোকটির নোংরা পোশাক, তার জ্বলন্ত চোখ, তার উস্কো চুল, তার চড়া সুরে ভাটিয়ালি ...সুজন থমকে দাঁড়িয়েছে। লোকটা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।
মিমির কাঁপা গলা -- কে গো মা ? তুমি বুঝি চেনো ?
কি বলব বুঝে পাই না। লোকটি জ্বলন্ত চোখে সুজন ও মিমিকে দেখে। তারপর বেগে বেরিয়ে যায়। আমি দরজায় ছুটে যাই। কেউ নেই কোথাও। একরাশ আঁধার রহস্যের মত পড়ে আছে। সুজন বলছে -- কে এই লোকটা ? চেনো তুমি ?
ভেতর থেকে কেউ বলে -- হ্যাঁ, অনেকদিনের চেনা।
মুখে বলি -- কি জানি!
                                                                                 HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন