ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি বাংলা সাহিত্যের ওয়েবব্জিন জুলাই-আগস্ট সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা

নষ্ট বীজের প্রভু
সদানন্দ সিংহ

   দুপুরের অলস ঘুম অলসতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আর সেই ঘুম যদি বিকেল পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, তাহলে শরীরটা বিগড়ে যাওয়া মেসিনের মতো হয়ে যায়। কোনও সিস্টেমিটি বজায় থাকে না। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এক-একটা দেশের মতো হয়ে যায়। এমনই এক অবস্থার মধ্যে সামন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা সোঁ সোঁ আওয়াজ প্রথমে শুনতে পায়। তারপর সে দেখে ঘরে রাখা পত্রিকার কাগজ, চিঠি, টুকরো কাগজ, পলিথিনের পাতলা ব্যাগ ইত্যাদি সব ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল। তারপর এক প্রচন্ড হাওয়া এসে ঘরের অনেক কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। জলের প্লাস্টিকের জগটাকে নিচে ফেলে দেয়। ঘরটা জলে ভরে যায়। কাচের ফুলদানিটা নিচে পড়ে ভেঙে যায়। ফুলদানির প্লাস্টিকের ফুলগুলি কোথায় কোথা জানি ছিটকে পড়ে। ঘরের ঝুলিয়ে রাখা কাপড় চোপড় পাগলের মতো এলোমেলো উড়তে থাকে। তখনই সামন্ত বুঝতে পারে তার ঘরের ভেতরে একটা প্রচন্ড ঝড় পাঁক খাচ্ছে। প্রথমে সে ঝড়ের মাত্রাটা বোঝার চেষ্টা করে শুয়ে শুয়েই। তার চুল, লুঙ্গি সব সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবে – দেখি ঝড়টা একটু কমে কিনা। এইসব চিন্তার মাঝেই সে দেখে ঝড়টা জানালা দিয়ে কোথায় জানি সরে যাচ্ছে। কিছু কাগজের টুকরোও ঝড়ের সাথে উড়ে চলে যায়। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামন্ত। ঝড়টা একদম চলে গেলে সামন্ত দেয়াল ঘড়িটা দেখে, সাড়ে চারটা বেজে গেছে। এই রে, রুনার আপিস ছুটির সময় হয়ে এল যে। সামন্ত বিছানা থেকে তড়াক করে নেমে দাঁড়ায়। খালি গা ওর। লুঙ্গিটা কষে গিঁট দেয়। তারপর ভাঙা ফুলদানির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে একটা পুরনো পত্রিকার ওপর রাখতে থাকে। কুড়োনো শেষ হলে সে কাচের টুকরোগুলোকে পত্রিকাটা দিয়ে মুড়ে খাটের নিচে রেখে দেয়। সে দেখে, ফুলদানির প্লাস্টিকের ফুলগুলো ঘরের এদিক ওদিক পড়ে আছে। সেগুলিকে সে কুড়িয়ে এনে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখে। তারপর একটা ন্যাকড়া আর বালতি এনে ঘরের মেঝে থেকে জল পরিষ্কার করতে থাকে। মেঝের জল পরিষ্কার করার পর বালতি এবং ন্যাকড়াটাকে আগের জায়গায় রাখতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। একটু পরে ঘরে ঢুকে এলোমেলো সমস্ত কাপড়গুলি গুছিয়ে রাখার পর ছিটিয়ে থাকা কাগজ, ম্যাগাজিন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গোছায়। তারপর বিছানাটা ঝেড়ে সাজাবার পর ঝাড়ু মেরে ঘরটা পরিষ্কার করে। শেষে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধোয়। গামছা দিয়ে জল মোছে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মুখে এবং শরীরে একটু পাউডার মেখে চুল আঁচড়িয়ে নিয়ে গায়ের ওপর একটা সাদা পাঞ্জাবি চাপিয়ে দেয়। সবকিছু ফিটফাট থাকলে রুনার মনটা খুশিতে একটু ভরপুর থাকে।
সামন্ত আবার ঘড়ি দেখে। পাঁচটা বেজে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুনা এসে পড়বে। রুনার আসার সময় হিলের জুতোর একটা খটখট শব্দ হবে। ঐ শব্দ শুনে সামন্ত চোখ বুজেই বলে দিতে পারে কে আসছে। সামন্ত জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে চায়। আকাশটা এখন পরিষ্কার। আকাশের দিক থেকে সে এবার তার দৃষ্টি রাস্তার দিকে ঘোরায়। এই সময়েই সে দেখে ভটভট শব্দ করতে করতে একটা মোটর সাইকেল ছুটে এসে হঠাৎ রাস্তায় থেমে গেছে। ওটার চালকের পেছনে রুনাকে দেখে সে একটু চমকে যায়। বাইক থেকে নেমে চালকটির সঙ্গে রুনা হেসে কিছু কথাবার্তা বলে। সে কথবার্তা সে শুনতে পায় না দূর থেকে। তারপর সে দেখে ভটভট করতে করতে মোটর সাইকেলটা চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রুনাও দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
ক্লান্ত মুখে রুনা গটগট করে ঘরে চলে আসে। তারপর শাড়ি পাল্টিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। সামন্ত জানে বাথরুম থেকে বেরুতে রুনার প্রায় আধঘন্টার মতো সময় লাগবে। বেরিয়েই সে চা খেতে চাইবে। সামন্তই চা করে প্রতিদিন। শুধু চা কেন, বাজার করা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সহ ঘরের সমস্ত কাজই সামন্ত করে থাকে। দশ বছর যাবৎ এভাবেই চলে আসছে। বেকার মানুষ সে, ঘর সামলানোর কাজটা সে স্বেচ্ছায় নিয়েছে। বহু চেষ্টা করেও আর্টসের গ্র্যাজুয়েট সামন্তর চাকরি আর হয়নি। বিয়ের আগেই অবশ্য রুনার চাকরি হয়ে গেছিল ক্লার্ক গ্রেড পরীক্ষায় পাস করে। ভালোবাসার বিয়ে তাদের। একসময় সামন্ত ছিল রুনার গৃহশিক্ষক। ধীরে ধীরে ভালবাসা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে।
চানঘরে রুনার গুনগুন গান শোনা যাচ্ছে। আজ সামন্তর কিছুই ভালো লাগছে না। চা করতে ইচ্ছে হয় না আর। মোটর সাইকেল চালকটির কথা তার মনে বারবার ভেসে আসতে থাকে। লোকটার মুখটা হেলমেটে ঢাকা ছিল। আর রুনাও লোকটার পেছনে প্রায় গায়ে লেগেই বসে ছিল। কে লোকটা ? রুনা লোকটার সঙ্গে যেভাবে হেসে কথা বলছিল, সেভাবে অনেকদিন তার সঙ্গে কথা বলে না। সামন্ত ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। কপালের রগ বেয়ে টপটপ ঘাম ঝরে।

রুনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সামন্ত ঝিম মেরে বিছানার এক কোণে বসে রয়েছে। তাদের ঘর একটাই। এখানেই শোবার ঘর, বসার ঘর এবং খাওয়ার ঘর। রান্নাঘরটা অবশ্য আলাদা। তবু ঘর ভাড়া মেটাতে রুনার বেতনের বেশ একটা অংশ খরচ হয়ে যায়। সামন্তের দিকে তাকিয়ে রুনা বলে, চা কই?
-- করিনি। ভালো লাগছে না।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। আমিই করছি।
রুনা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। সামন্ত একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে মন বসাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বারবার হেলিমেটে ঢাকা একটা মুখ তার সামনে ভেসে উঠতে থাকে। তার কাছে সব কিছুই বিস্বাদ মনে হতে থাকে। ঐ হেলেমেটে ঢাকা লোকটা তার বন্ধু নিশ্চয়ই নয়। হয়তো শত্রুই। কত নাম্বার শত্রু তা অবশ্য সে জানেনা। ইদানীং তার শত্রু-সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। রিটায়ার্ড গভর্ণমেন্ট অফিসার গজেন্দ্রবাবুও বর্তমানে তার একজন শত্রু। দেখা হলেই তাকে অনবরত জ্ঞান দিয়ে চলেন যেন সে দুগ্ধ-শিশু। পাড়ারই কিছু চ্যাংড়া ছেলে তার এখন এক নাম্বার শত্রু। তাকে দেখলেই ওরা বলাবলি করে, রুনাদির বৌ। একবার তো সে রাগে চ্যাংড়া ছেলেগুলোর সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, এসব কী ইয়ার্কি হচ্ছে। তাকে ঐ অবস্থায় দেখে একটা ছেলে জবাব দিয়েছিল, আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছি আর ইনি এসেছেন আমাদের কাছে জবাব চাইতে। যান যান মশাই, আপনার কাজে যান। সামন্ত চুপচাপ চলে এসেছিলো। পরে ঘটনাটা শুনে রুনা বলেছিল, অন্য পাড়াতে বাড়ি পাল্টাতে হবে। আর শোনো, তুমি কিন্তু ঐ অসভ্য ছেলেগুলোর সামনে আর যেয়ো না।
রুনার পরামর্শ মানার চেষ্টা করেছে সে। চ্যাংড়া এড়িয়ে চলাফেরা করে সে। তবু ওরা তাকে দূর থেকে দেখলে বলে ওঠে, ঐ দেখ্‌, রুনাদির বৌ যাচ্ছে।

রুনা দুহাতে দু কাপ চা নিয়ে ঢোকে। এক কাপ চা সামন্তের দিকে বাড়িয়ে দেয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সামন্ত চায়ের কাপ নেয়। ম্যাগাজিনের দিকে যেন গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে সামন্ত। কোনও কথা বলেনা। কিন্তু বলার সুযোগ খোঁজে।
চেয়ারে বসে রুনা চায়ে চুমুক দেয়, তারপর বলে ওঠে, দিনের পর দিন এক ধরনের জীবন আমার আর ভালো লাগেনা। বৈচিত্র্য নেই এক্টুকুও।
সুযোগ পেয়ে সামন্ত বলে বসে, কী ধরনের জীবন চাও তুমি? বাঁধনহারা জীবন?
সামন্তের দিকে চেয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করে রুনা বলে, আমি কিন্তু চেয়েছিলাম বন্ধনযুক্ত জীবন। একটামাত্র সন্তান এলে মনে হয় আমাদের জীবনটা স্বর্গের মতো লাগতো।
সামন্ত ফস করে বলে ওঠে, সন্তান এলেই যে স্বর্গের মতো লাগবে তার কোন মানে নেই। আর সেজন্যও আমি দায়ী নই। ডাক্তারি পরীক্ষায় আমার কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি।
রুনাও জবাব দেয়, সে তো ডাক্তার আমাকেও রিপোর্ট দিয়েছে, আমারও কোন ত্রুটি নেই।
-- তাহলে দোষটা কার? আমার নয়।
-- দোষ তোমারই। কারণ-কারণ তুমি হচ্ছ নষ্ট বীজের প্রভু।
-- আমি নষ্ট বীজের প্রভু! তাহলে তুমি কী? তুমি হচ্ছ একটা অনুর্বর জমি। মরুদ্যানহীন মরুভূমি।
-- নষ্ট বীজের প্রভুর কাছে মরুভূমিই বা কি, পলিমাটিই বা কি! সবই সমান। মূল্যহীন।
-- ঠিক বলেছ। তোমার কাছে আমি এখন মূল্যহীনই। তাই তোমার কাছে আমি এখন নষ্ট বীজের প্রভু ছাড়া আর কিছই নয়। এভাবে থাকতে আমারও ভালো লাগে না। সত্যিই আমি একদিন চলে যাব, যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে। দরকারে মুটেগিরি করব, ভিক্ষে করব। এভাবে জীবনটা কাটাতে আমার অসহ্য লাগছে। বলতে বলতে সামন্ত টের পায় তার মাথার ভেতরটাতে একটা ভীষণ উত্তাপ ঘুরপাক খাচ্ছে।
-- বেশ হয় তুমি যদি চলে যাও। কবে যাবে? বলতে বলতে রুনা হঠাৎ হাতের চায়ের কাপটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে সামন্তের কাছে উঠে আসে। সামন্তের তখন রাগে এবং অপমানে চোখে জল প্রায় আসছে। রুনা হঠাৎ সামন্তের পেছনে বসে পেছন দিক থেকে সামন্তকে জড়িয়ে ধরে ধীরে ধীরে বলে, তুমি যখন চলে যাবে, তখন আমিও তোমার সঙ্গে যাব। খুব মজা হবে।
সামন্ত একটু অবাক হয়। রুনাকে এক রহস্যময়ীর মতো লাগে। রুনা যেন এক রহস্যময়ী নারী, যার অবগুণ্ঠন সামন্ত হয়তো কোনোদিনই খুলতে পারবে না। রুনার গাল সামন্তের গালে এসে লাগে। সামন্ত রুনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তবু তার সব রাগ আস্তে আস্তে জল হতে থাকে। রুনার কিশোরীর মতো উচ্ছ্বাসটুকু দেখে তার খুব ভালো লাগে এখন। আর তখনই তার চোখের সামনে হেলমেটে ঢাকা একটা মুখ আবার ভেসে ওঠে। সে চোখ বুজে ফেলে। চোখ বুজতেই সে স্পষ্ট দেখে একটা মোটর সাইকেল গর্জন করতে করতে ছুটে এসে তাকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। লোকটা কি রুনার কলিগ্‌? নাকি কোনও অন্তরঙ্গ বন্ধু? কে লোকটা ? সামন্ত কিন্তু কিছুই প্রশ্ন করে না রুনাকে। ভবিষ্যতেও কোনোদিন করবে না। রুনার ইচ্ছে হলে নিজে এসে বলুক।
                                                                                 HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন