গল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন হেমন্ত সংখ্যা নভেম্বর ২০১৬ ইং 


[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]
নির্মোসী
শ্যামল ভট্টাচার্য

আচ্ছা বাবা, নির্মোসী কি বিশল্যকরণী ? সেন্ট্রাল স্কুলের ক্লাশ থ্রি-র ছাত্রীর মুখে এই প্রশ্ন রঞ্জনকে চমকে দেয় । --- বিশল্যকরণী কী জানিস তুই ? ও মাথা নেড়ে গম্ভীর আওয়াজে বলে, মৃতসঞ্জীবনী, ঠাম্মা বলেছিল । 
রঞ্জনের খুব ভাল লাগে । টিয়ার মুখের গড়ন ওর ঠাম্মারই মতন । ঘুমিয়ে থাকলে মনে হয় মায়ের ছোটবেলা দেখছে বুঝি ! এখন ওর চেহেরায় ভোরের দীপ্তি । ট্যাক্সি-ট্র্যাক রানওয়ের এই অংশটার দু’পাশে ঘন অরণ্য । দোতলা তিনতলা সমান উচ্চতার শাল, শিমূল, দেবদারু, আকাশছোঁয়া অশ্বত্থ আর মোটা ঝুরি নামানো বট । পাতায় পাতায় সবুজের রকমফের । আমলকি, আমড়া, কামরাঙা, বয়ড়া জাতীয় চেনা গাছ ও অসংখ্য গুল্মলতার ফাঁকে ফাঁকে কৃষ্ণচূড়ার লাল, রাধাচূড়ার হলুদ কিংবা বেগুনী । নিম ও কাঁঠালগাছে ভিন্ন আকৃতির মৌচাক ফুল ও ফলের রসে টস্‌টসে । মধুময় ।
---ওই কালো কালোগুলি কি পাখির বাসা বাবা ? টিয়ার চোখের মণিতে বরফকুচি । বাসাগুলির দরজা কোথায় ? কোথা দিয়ে পাখিরা ঢোকে ? রঞ্জন তাকিয়ে দেখে একটি জংলীজিলেবি গাছে ঝুলছে নানা আকারের অসংখ্য কালচে রঙের পিঁপড়ের বাসা । ও বলে, চল কাছে গিয়ে দেখবি, ওগুলো পাখির বাসা নয় ! নুব্রা আঁতকে বলে, না না, জঙ্গলে যেতে হবে না । লাল, কালো, ছোট বড় সব পিঁপড়েরই বাসা রয়েছে দেখছি । ওর কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা শালিক একটানা কিছু বলে । পিঁপড়ের বাসা নিয়ে শালিকের আর্জিটা বোঝার চেষ্টা করে । শালিকের আর্জি ।
বিকেলের ডিউটি থাকলে সন্ধ্যায় এখান দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফেরার সময় শালিকেরা এমনি অনেক কথা বলে । রঞ্জন ধীরে ধীরে প্যাডেল ঘোরায় । ঝিঁঝিঁর ডাক শোনে । ঝিঁঝিঁর ডাক ছোটবেলা থেকেই ভীষণ প্রিয় ওর । নানারকম ঝি ও ঝিঁঝিঁ ও তক্ষকের কক্কের সঙ্গে পিলে চমকে দিয়ে হুয়া হুয়া চিৎকারে শিয়ালেরা ডেকে ওঠে । কখনো ডাক থামিয়ে দলে দলে শিয়াল রাস্তা পেরোয় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে । রঞ্জন তখন জোরে প্যাডেল চাপে । কিছুক্ষণ জোরে চালিয়ে আবার ধীরে চালায় । আবার ঝিঁঝিঁর ডাক । আবার কক্কে, কক্কে । ছোটবেলা এই তক্ষকের ভয় দেখিয়ে, রাজা পরীক্ষিতকে তক্ষকে কাটার গল্প শুনিয়ে ওকে ভাত খাওয়াতো মা । ঝিঁঝিঁর ডাককে বলতো, জুজুবুড়ির কান্না । জুজুবুড়ি কেন কাঁদে ! কিসের দুঃখ ? আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে মা বলতো, এখন ঘুমিয়ে পড়ো, বড় হলে বুঝবে তুমি জুজুবুড়ির দুঃখ । এ পথে সাইকেল চালাতে গিয়ে অনেক অনেক বছরের পরও রঞ্জনের মনে হয় সত্যি ঝিঁঝিঁর ডাক জুজুবুড়ির কান্না একই রকম ! প্রায় ন্যাড়া হয়ে যাওয়া পৃথিবীর জন্যে কাঁদে জুজুবুড়ি ।
জুজুবুড়ির আকর্ষণেই রঞ্জন বিকেলের ডিউটি সেরে এ পথে সাইকেল চালিয়ে ফেরে । জুজুবুড়ির আকর্ষণ । ভোরবেলার আওয়াজ একেবারেই অন্যরকম । অফিসার মেসে হেলথ ক্লাব হয়ে যাওয়ায় আজকাল আর কেউ এদিকে জগিং-এর জন্য আসে না । এই নির্জনতায় এখন শালিক চড়ুই-এর কিচির মিচিরে মিশে যাচ্ছে কুব কুব কুবোর ডাক । দু’রকম ঘুঘুর ডাক; একটি সরু ও প্রলম্বিত, অন্যটি একটু মোটা ও আদুরে । তাছাড়া ভালুক-বক-সারস-হাঁসপাখি ও দোয়েলের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার ব্যস্ত কলকাকলি । সারি সারি চাকোলতা, ক্ষীরন্তি, কেঁদ, বয়জ, ছাতিম, কুসুম, চিকুম ভুয়াশ আরো কত নামের গাছের ফাঁক থেকে ডাকে পাখিরা ।
আরো কত শব্দ মিশে আছে এই আবহে ! কত বিচিত্র পাখি রয়েছে পৃথিবীতে । এ পথে যেতে যেতে অনেকবারই মনে হয়েছে সালিম আলি বা কোন পক্ষী বিশারদের বই কিনে পড়বে । ভাবতেই কোন্‌ সে অতল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শরীর কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে ! রঞ্জন অবাক হয় ।স্মৃতি ওকে আনমনা করে দেয় । ভীষণ আনমনা । মোটা মোটা মওল, পিয়াশাল ও পলাশের সারি দেখে ওর মনে পড়ে পেরিয়ার । তামিলনাডু-কেরালা সীমান্তে ঘুমিয়ে থাকা জোড়া আগ্নেয়গিরির মুখে বিশাল সরোবর । অনেকটা বাংলা চারের মতন আকারের সরোবরে নানা জায়গায় জলের রং নানারকম । প্রতি মুহূর্তে সেখানে মেঘের রং, আকাশের রং পালটায় । যেদিকে চোখ যায় তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে । ঘাড় ঘোরালেই বুঝি কিছু না কিছু অদেখা থেকে যাবে ।
সেই সুন্দর দিনগুলি রঞ্জন ভুলতে পারবে না কোনদিন । নুব্রার সঙ্গে পরিচয় ঐ পেরিয়ার ঘুরতে গিয়েই । সরোবর ঘিরে সমাধিস্থ আগ্নেয়গিরির শীর্ষ থেকে পাদদেশ অব্দি ঘন অরণ্য আর অসংখ্য প্রজাতির পাখি । প্রথম পরিচয়েই কিছু অদ্ভূত রঙের আদানপ্রদানে ওদের বন্ধুত্ব দানা বাঁধে । তারপর একসঙ্গে পাখি দেখা, পাখি চেনা, ফুলের আদানপ্রদান, গল্প আর গল্প । সেখানেও ঝিঁঝিঁর ডাক । ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে রঞ্জন নুব্রাকে জুজুবুড়ির কান্নার কথা বলেছিল । জীবনে ঐ একবারই কাউকে ও জুজুবুড়ির কান্নার কথা বলেছে । কখনো আবার নৈঃশব্দ্য গল্পের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভাবের পরিবাহী । এ যেন প্রতি মুহূর্তে ফুলপাতা, পাখি ও পালকে, রং ও কাকলিতে পরস্পরকে নতুন করে আবিষ্কার । সালিম আলি নাকি ওখানেই বছরে ছয়মাস কাটাতেন । ওরা থাকে মাত্র পাঁচদিন । ফেরার সময় খারাপ লেগেছিল খুব । নুব্রারা আরো দু’দিন পরে ফিরবে । বাসস্ট্যাণ্ডে সেদিন ভীষণ অস্থির লাগছিল নুব্রাকে । সাদা সালোয়ার কামিজে বাদামি ওড়না । নীলগিরি ছুঁয়ে ছুটে আসা আরবসাগরের বাতাসে চুলগুলি উড়ে উড়ে মাঝেমধ্যেই কপাল ও চোখ ঢেকে দিচ্ছিল । বাস ছাড়লেও ওখানেই দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল নুব্রা । রঞ্জনের মনে পড়ে বাসের জানালায় দূরবীন চোখে লাগিয়ে ও তাকিয়ে ছিল থেক্কারি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প অব্দি --- যতক্ষণ দেখা যায় । তারপর কতদিন স্বপ্নে সেই বনানীর ঘ্রাণ পেয়ে জেগে উঠে এক অন্যতর বিষণ্ণতায় ডুবে গেছে শেষরাতে । তখন থেকে ভোররাত অব্দি এক দমবন্ধ যাপন । আলো জ্বালালে বিলেটের অন্য সহকর্মীদের ঘুম ভেঙে যাবে । সেই বিশেষ ভোরগুলিতে দিনের আলো ফুটলেই নুব্রাকে চিঠি লিখতে বসতো । বিলেটের বারান্দায় টেবিল চেয়ার পেতে নিত সে ঘন্টাখানেকের জন্যে । ভোরের আকাশ রং বদলাত চিঠির কাগজে । রং বদলাত । --- একটা গন্ধ পাচ্ছো বাবা ? খুব সুন্দর গন্ধ !
টিয়ার প্রশ্নে চমকে বুক ভরে বাতাস নেয় ও । মনে হয় গন্ধটা পরিচিত । এক আশ্চর্য সুবাস সমস্ত চৈতন্যে ছড়িয়ে যায় । চনমনে হয়ে ওঠে রঞ্জন । ও আবার ঘ্রাণ নেয় । শরীরের কোষে কোষে এই সুবাস পৌঁছে দিয়ে ভাবতে থাকে, কোথায় যেন, কোন্‌ সে সুদূর অতীতে, অথবা জন্মান্তর থেকে ভেসে আসা এই ঘ্রাণ ! ভাবনার মাঝে বলে টিয়া, কিসের গন্ধ বাবা ওটা ? হালকা গোলাপি ফ্রকে সকালের আলো প্রতিসারিত হচ্ছে । ওর গালে ও চিবুকে এক অলৌকিক আভা । রঞ্জনের খুব ভালো লাগে । অরণ্য আর ট্যাক্সি-ট্র্যাকের মাঝে দু’হাতের মতন কাশফুলে সাদা । যেন ঘাসের ওপর তুষারপাত । কাশের শরীরে শরতের বাতাস ঢেউ খেলে । রঞ্জন চোখ বন্ধ করে আরেকবার ঘ্রাণ নিলে হঠাৎই স্মৃতির জানালা খুলে গিয়ে হুড়মুড় করে জেগে ওঠে সারি সারি রুক্ষ পর্বতমালা । ও চোখ বন্ধ রেখেই বলে, নি-র্মো-সী । নির্মোসীর মতন গন্ধ !
--- নির্মোসী কি বাবা ?
--- একরকম গাছ । পশ্চিম হিমালয়ের ঢালে পাথর ফুঁড়ে বেরোয় ! এর পাতা খাইয়ে দিলে মাতাল মানুষ বমি করে সুস্থ হয় । শিকড় বেটে খাওয়ালে মুমূর্ষু চাঙ্গা হয়ে ওঠে ।
একটি জলপাই গাছের নিচে রাখা অতি পুরনো বোমারু বিমানের ককপিটে কাকের বাসা । পুরো খোলটাই লতাগুল্মের ঘন আস্তরণে ঢাকা । অদ্ভূত লাগে । কেন জানি মনে হয় যে কোন মুহূর্তেই বিমানটি গা ঝাঁকিয়ে উঠবে । অথচ রঞ্জন জানে এরকম কোন সম্ভাবনা নেই । নুব্রা বলে, ধ্যাৎ, পাথর ফুঁড়ে আবার গাছ বেরোয় নাকি ?
রঞ্জন মাথা নাড়ে । মুচকি হেসে নির্মোসী-প্রবাদের গল্প শুরু করে, রামচন্দ্র সাগর শুকিয়ে ফেলতে উদ্যত হলে সমুদ্রদেবতা ভয়ে হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চায় নিজের ও কোটি কোটি জলজপ্রাণী ও উদ্ভিদের । বলে, আমার বরে যে কোন মনুষ্যেতর প্রাণী যদি জলে পাথরও ফেলে সেগুলি ভেসে ভেসে থাকবে ! রামচন্দ্র খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু আমি ধনুকে যে আগ্নেয়াস্ত্র লাগিয়েছি তা তো আর তূণীরে ফিরে যাবে না, ফিরিয়ে আনলেই বেসমেন্টটাই ব্লাস্ট হয়ে যাবে । সমুদ্র বলে, নো প্রবলেম, হিমালয়ে নিক্ষেপ করো । রঞ্জন ভেবেছিল এমনি করে বললে টিয়া মজা পাবে । কিন্তু ওর চোখে আতংক খেলা করে । মুখ থমথমে । নাকি ওর এমন মনে হচ্ছে । গতকাল রাতে একটা তথ্যচিত্রে সি.এন.এন.-এর তোলা খাড়িযুদ্ধের ক্ষেপনাস্ত্রগুলি কেমন রাতের আকাশ চিরে যাচ্ছিল সে দৃশ্য মনে পড়তে ও চুপ হয়ে যায় । দুই হাত কাঁধের দুপাশে সামনে পিছনে ঘোরায় । যতদূর চোখ যায় প্রশস্ত পথের দুপাশে কাশের বুকে বাতাস থেমে আছে । এসময় কাশ নীলচে সাদা । এরপর থেকেই মেঘ ও রোদে মানুষের মনের মতন বারবার রং বদলাতে থাকবে সকাল থেকে সন্ধ্যা । রঞ্জন টের পায় এ মুহূর্তে হাত ঘোরাতে আর ভালো লাগছে না । ও জোরে জোরে শ্বাস নেয় । আবার গন্ধটা পেতে চেষ্টা করে ।
নুব্রা জিজ্ঞেস করে, তো রামচন্দ্র তীর ছুড়লেন ? রঞ্জন গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়, হুঁ । না জানি কেন হঠাৎ মনটা বিষণ্ণ লাগে । সেই তীরের বিষ পশ্চিম হিমালয়ের সমস্ত কোমলতা শুষে নেয় । মাটি হয়ে ওঠে নিরেট পাথর । বছরে নয়-দশমাস তো বরফেই ঢাকা থাকে । শুধু গ্রীষ্মের দুই-তিনমাস বরফ গলে গলে কঠিন পাথর খা খা ! প্রাণীকূল বাঁচার কোন উপায় না দেখে তপস্যা শুরু করে । তপস্যায় তপস্যায় হাড্ডিসর্বস্ব স্মৃতিসর্বস্ব ফসিল হয়ে পড়ে একেকজন । সবশেষে সবার সম্মিলিত ইচ্ছা ও শক্তি সেই পাথর ফাটিয়ে একটা গাছের জন্ম দেয়, --- নির্মোসী ।
নুব্রা বলে, যেমন সব দেবতার মিলিত আকাঙ্ক্ষায় মূর্ত হয় দেবী দূর্গা ।
টিয়া হাততালি দিয়ে বলে, ঠিক বলেছ মা, স্যাইম টু স্যাইম, দূর্গা আর নির্মোসী । তালির শব্দে পাশের ঝোপ থেকে এক ঝাঁক সবুজ টিয়া ছোট্ট পুকুরটার দিকে উড়ে যায় । পুকুরে পানকৌড়ি ও হাঁসেরা ভেসে বেড়ায় । গলা ডুবিয়ে জল খায় । পুকুরের কোণে কোণে গাছ ও বাঁশঝাড়ের ছায়ায় এখনো অন্ধকার । পানকৌড়ি হাঁসের আলোকিত মধ্যখানে ভেসে বেড়ায় ।
টিয়ার উচ্চারণ নকল করে নুব্রা বলে, স্যাইম টু স্যাইম, তুই খুশিতে একঝাঁক পাখি উড়ালি ।
ওদের শব্দের অভিঘাতে নাকি কোন এক ফড়িঙের পাখার ছোঁয়ায় লজ্জাবতী ঝোপে শতসহস্র পাতা মুখ লুকায় । ঘোমটার বাইরে টিকলির মতন জেগে থাকে বোতাম আকারের গোলাপি রোম রোম ফুলগুলি । নুব্রা বলে --- দেখো রঞ্জু, এই এয়ারবেসের বাইরে কোথাও সবুজ নেই । চারিদিকে লোকালয় আর কলকারখানা, বয়ে যাওয়া নদীটাও যেন পয়ঃপ্রণালী । অথচ দেখ কত প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্ম, ফুল ও পাখি, এই মাটিতেই, এমনি এই পুরো অঞ্চলে ছিল, কত টাটকা বাতাস ...... ।
নুব্রার কথা শেষ হওয়ার আগেই চার্লি হ্যাঙ্গার থেকে জেট ইঞ্জিন অন করার বিকট শব্দ ওদের চমকে দেয় । রঞ্জন কবজি উলটে ঘড়ি দেখে । তারপরই দ্রুত হাঁটতে শুরু করে । তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে । ডিউটি রয়েছে । প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে এতক্ষণ বাস্তবকে ভুলে ছিল । কান ফাটানো শব্দে কংক্রিট কাঁপে । কোলাব্যাঙ, আঠাপোকা এবং শামুকেরা নিজেদের গতিপথ পালটে নেয় । গতিপথ বদলায় পিঁপড়েরাও । ওরা দ্রুত অরণ্যমুখী । খানিক এগোতেই টিয়া ওর টি-শার্ট খামচে ধরে কিছু বলে । ইঞ্জিনের শব্দে রঞ্জন বুঝতে পারেনা । টিয়া আঙুল তুলে ওর মাকে দেখায় । একটু পেছনে একটা হলুদ রঙের ধুতুরার মতন দেখতে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নুব্রার দিকে তাকিয়ে রঞ্জন বিস্ময়ে হতবাক । নুব্রা চোখ বন্ধ করে ফুলটার ঘ্রাণ নিচ্ছে । টিয়া চেঁচিয়ে বলে, মায়ের হাতে নির্মোসী ফুল ।
রঞ্জন ভাবে, নির্মোসীর তো ফুল হয় না । ভোরের বাতাসে নুব্রার ওড়না যেন জয়ধ্বজা । থুতুনি ও গালে এক সবুজ আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ! কী অপরূপা নুব্রা তুমি এখন ! ওর খুব ভাল লাগে । নুব্রা আরেকটা ফুল ওর হাতে তুলে দিয়ে বনদেবীর মতন মিষ্টি হেসে বলে, দেখো গন্ধটায় কত জাদু, অবাঞ্ছিত শব্দ থামিয়ে দেয় । রঞ্জন কিছুই শুনতে পায় না । বাতাস তোল্পাড় করে দিচ্ছে ইঞ্জিনের গর্জন । নুব্রার ইঙ্গিতে ওর হাতের কাছে নাক এগিয়ে ঘ্রাণ নেয় বুক ভরে । আঃ । অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি ! প্রবল সুবাস মস্তিষ্কের কোষে কোষান্তরে পৌঁছে কানের পর্দার কাছে রেণু রেণু জমা হয় । ভোজবাজির মতন ইঞ্জিনের শব্দ কানে আর ঢোকে না । অথচ কংক্রিট কাঁপতে থাকে । লজ্জাবতীর পাতারা এখনো মুখ লুকিয়ে । একটু আগের মতন কানে ঢোকে কলকাকলি । এই কলকাকলি আর্ত গোঙানির মতন, কান্নার মতন । শুধু ঝিঁঝিঁর নয়, এই সংকটে জুজুবুড়ি যেন সবার কণ্ঠে কাঁদছে । ব্যাঙ, আঠাপোকা, পিঁপড়ে ও শামুকেরা এখনো ত্রস্ত । শুধু কিছু নানা রঙের প্রজাপতি, মৌমাছি ও ফড়িং লজ্জাবতীর গায়ে গায়ে জড়ানো আরেক ধরনের শক্ত লতায় অনেক ক’টা ধুতুরার মতন দেখতে হলুদ ফুলগুলিতে বসছে ও উড়ছে । পাতাগুলি পানের মতন কিন্তু অগ্রভাগ সূচালো বর্শার মতন । সব ক’টি ফলা ট্যাক্সি-ট্র্যাকের দিকে তাক করা । এই চওড়া কংক্রিট ঢেকে দিয়ে সমস্ত অ-প্রাকৃতিক শব্দ থামিয়ে সবুজের সমারোহে পূর্ণতা আনতে ওরা উদ্‌গ্রীব । টিয়াও একটা ফুল শুঁকছে চোখ বন্ধ করে । বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিচ্ছে টিয়া । গোলাপি ফ্রক ফুলে ফুলে উঠছে বাতাসে ।
এখন রঞ্জন নিশ্চিত; এই ঘ্রাণ নির্মোসীর নয় । এই সময়ের উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের মিলিত আকাঙ্ক্ষার মূর্ত রূপ এই শরতের ফুল । টিয়া আঙুল তুলে দেখায় কাশের ফাঁকে দাঁড়িয়ে একটা সাদা খরগোশ তখন জ্বলজ্বল চোখে ওদেরকে দেখছে । টিয়ার চোখের মণিতে চিকচিক করছে কয়েককুচি বরফ ।
                                                                                                      HOME                                                                                                                                                                                                                                                                         

এই লেখাটা শেয়ার করুন