রিটায়ারমেন্টের পরে আলোচনাঃ শুভেশ চৌধুরী
উৎস কথা ‘হোসে মার্তি’র কবিতার সাথে একসাথে বাঁচার অঙ্গীকার কবি দিলীপ দাসের। কাব্যগ্রন্থের শীর্ষক কবিতাটিতে সময় স্থির আপাত কবির দৃষ্টিতে যা কবিই আবার বহমনতায় নিয়ে গেছেন গীতিময়তা ও মরমী আবেগ সহকারে, পঙতিতে পঙতিতে কবি মূলত পিছনে তাকিয়েছেন একটি সীমারেখার ওই পারে। যেই দিন অতিক্রান্ত, সেই দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে, ভালোবাসার দিকে ফিরে, তাকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন, পরমুহূর্তটিতে প্রত্যক্ষ করেন, আজ যেন নিজেকে সময় দিতে পারছেন না, তাই অভিমানী আর আবিষ্কার করে ফেলেন বড় বেলাটিকে –
“সময় আমাকে আর শাসন করে না।
চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলি
বেহিসেবী শিশুর মতো, তারপরও
পকেট ভর্তি অজস্র অনিকেত সময়”
এই কাব্যগ্রন্থের একটি বিশাল আকাশ ওই ‘পরবাস’। কবি এই নামেই সীমারেখার যে প্রান্ত তাকে এতোদিন শাসন করে আসছিল তাকে নামকরণ করেছেন। রিটায়ামেন্টের পরে এই অনিকেত সময়েই তিনি বাসাবদল করেছেন।
বাসাবদল করার পরও সময়, পরিস্থিতি, দৈন্য, হতাশা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। কথা বলতেই হচ্ছে তাকে। কবিতা তাঁর মুখপাত্র। প্রকাশ করছে কবিতা একটি সময়কে, ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ করে দেখাচ্ছে মৃত শরীরের ব্যথা, পুঁজ, আঘাত, ক্ষয়।
১)
আমাকে ছেড়ে দে, আমাকে ছেড়ে দে
কাতর আর্তনাদ জুড়ে অন্ধকারের মাংসপিণ্ডগুলো।
আমি জানি,তাদের পিতা কে।
সে এক উদ্ভ্রান্ত অসুস্থ, বস্তুত যে পুরুষ নয়,
নারীও নয়, সে এক ক্লীব ক্লিন্ন জীব। তাকে চেনে
মৃত নদী, বরফ ঠাণ্ডার হাত,
শ্মশানের নির্দয় হৃদয়, আর
ভনভনে মাছিদের লোভী, পাংশু ঠোঁট।
[অন্ধকার]
২)
আপনি বলেছিলেন মার্কস, প্রভুভক্তি নয়,
ভক্তের মতো নিঃশর্ত আনুগত্য নয়।
সন্দেহ করো। প্রশ্ন করো। তর্ক করো।
……
……
তবু, এটুকু যে জেনেছি, এ-ও তো কম
নয়। মানুষের প্রতি অনুগত হও।
সবচেয়ে পেছনে পড়ে আছে যে মানুষ
তুমি তাঁর পেছনে বিনম্র হয়ে দাঁড়াও।
[পাঁচই মে]
কাব্যগ্রন্থ পাঠে ভালোবাসায় আমি আক্রান্ত হই। যেমন, সাধারণ ও মহান দুইই মহান হয়ে আছেন আমাদের জীবনে। পিতা থেকে চাচা বঙ্গবন্ধু, সবাই আর যে সব নারী পুরুষের উপস্থিতি জীবনকে মহার্ঘ করে আছে, তাঁকে মর্যাদার আসনে বসিয়ে কবি দিলীপ দাস অবসরপূর্ব (শুধু আক্ষরিক) মুহূর্তগুলোর একটি রূপরেখা টানতে চেয়েছেন, যা তাঁর হৃদস্পন্দন।
৩)
কোথায় হারালো এমন উদার আকাশ
কারা কেড়ে নিল এমন দরাজ দিলের
দৃপ্ত, সাহসী বাঙাল –
যার চোখে বাংলার শ্যামল তীর
বেড় দিয়ে আছে, বেদেনির মতো
সুঠাম কাঁকাল ?
[হাওড় (বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে)]
৪)
চাচা যখন রাস্তার পাশ দিয়ে
নিরীহ হেঁটে যেতেন,
আবার নিঃশব্দে ফিরে আসতেন
স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো তার পাড়ায়,
দু-চারজন ছাড়া কেউ জিজ্ঞেসও করত না,
কেমন আছেন মশায়?
চাচা কিন্তু সবার খোঁজ রাখতেন।
[ চাচা হো]
৫)
আমার নিঝুম চাঁদ
জোছনা ছড়াচ্ছে জারুলের ডালে।
আমি তার এক সারি পেছনে বসে
দেখছি, তার ডান গালে
কোথা থেকে এসে মায়াবি আলো পড়েছে।
[নিঝুম চাঁদ]
পুনশ্চ
কবি দিলীপ দাসের বর্তমান কাব্যগ্রন্থ ‘রিটায়ারমেন্টের পরে’-র উপর আমার এটি একটি অতি সংক্ষিপ্ত বাস্তবতা।
দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ। সর্বোপরি প্রচ্ছদে নৌকাটির উপস্থিতি সময়কে যেন গতিময় করে তুলেছে।
প্রকাশকঃ অক্ষর পাব্লিকেশন। প্রচ্ছদঃ ইমানুল হক। মূল্য একশ টাকা।
সাদা শালিকের ঝাঁক আলোচনাঃ সন্জিৎ বণিক
“সাদা শালিকের ঝাঁক” রামেশ্বর ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ। প্রচ্ছদে পুষ্পল দেব চমৎকার এক আবহ ধরেছেন। কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য কবিতা কম লিখলেও যা লেখেন সহজসরল রহস্যাবৃত এক ছবি যা আমাদের ভাবনাজগৎ বিচরণে সহায়তা করেন ও ছবির মাত্রামননকে নতুন আশ্রয় দেন। তিনি বইটি মাকে উৎসর্গ করেছেন। এরকম বই মায়ের রাতুল চরণে এক পুষ্পার্ঘ, কবির মনের সারাজীবনের ধ্যানবিন্দু। ভালো লেগেছে। এবার কবিতায় ফিরে যাই। “তিতাসনামা”-র বারটি কবিতা আর অন্যান্য বত্রিশটি, মোট ৪৪টি কবিতায় কবির অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কবিতার চিত্রকল্প ও কাব্যমূর্ছনা জাগিয়ে তুলেছেন। প্রাণ দিয়েই কবিতার চরণ এঁকেছেন। উল্লেখ করার মতো সবক’টি কবিতায় মনে দোলা দেয়।“তিতাসনামা”-র ৫ নং কবিতায় কবি বলেছেন-
"বোতামটা খুলে যেতেই
আকাশ থেকে নামে বৃষ্টি
……
বোতামটা ঠিকঠাক করে
ফেললেই আকাশ থেকে
উড়ে আসবে এক দঙ্গল সাদা শালিক"।
শ্রদ্ধেয় জননেতা নৃপেন চক্রবর্তীকে স্মরণ করে লেখা “তিনি” কবিতায় বলেছেন—
"রোদে ঝলসানো মেঠো পথে
তিনি হেঁটে যাবেন একাকী,
ফসল তুলে নিয়ে গেছে সব
এখন শুধু ধূ-ধূ প্রান্তরে তাঁর দৃষ্টি
অসীমান্তিক। ভাঙা চেয়ার, এক
বাটি গুড়-মুড়ি, আর শান্ত সন্ধ্যা
এই ছিল তার পরম আশ্রয়"।
‘তিনটি স্তবক” কবিতার প্রথম স্তবক এইরকম—
"যা ভাঙতে চাই তা পারছি কোথায়
যা বলতে চাই তা যাচ্ছে কোথায়
যা দেখতে চাই তা দেখছে কে
যা শুনতে চাই তা দিচ্ছে কে
যা গড়তে চাই তা ভাঙছে কোথায়
যা ভাঙ্গতে চাই তা পারছে কে"?
“উর্মিলার জন্য দু-চার পঙক্তি” কবিতায়-
"এখন সময় বড়ো নিষ্ঠুর
এখন মানুষের হৃদয়ের বৃক্ষবাটিকার কথা কেউ জানে না
কে যে সুমনস আর কে যে চতুর কানাই,
তার খোঁজ কে রাখে"?
“অক্ষর জেগে উঠলে” কবিতায় কবি বলেছেন—
"অক্ষর জেগে উঠলে ভেঙে পড়বে
কারাগারের চতুর্দেয়াল
অক্ষর জেগে উঠলে ঘুচে যাবে
চাঁদের চিবুকে জমে থাকা ব্রণ
অক্ষর জেগে উঠলে তিতাসের ঢেউ
ছাড়িয়ে যাবে শহিদের প্রান্তর
অক্ষর জেগে উঠলে মানুষের মিছিল
ছুটে যাবে সীমানার দিকে"।
“মেঘবালিকার বিরহ কথা” কবিতায় উজ্জ্বল চমৎকার কয়েকটি লাইন---
"মেঘবালিকার দুঃখের কথা যদি
জানতে চাও, তাহলে যেতে হবে
ভাইরাসহীন ল্যাপটপের কাছে
সেখানেই পাওয়ার পয়েন্ট
বন্দি হয়ে আছে
সব বইনারি বিরহ কথা"।
কবি কল্যাণব্রত চক্রবর্তীর কথা মনে রেখে যে কবিতাটি তার নাম “ষোড়শী”। কবিতার শেষ তিন লাইন এইরকম-
"কাদামাটি ঝেড়ে ফেলে দিলে দুটি চরণই
এখন স্বর্ণময় হয়ে উঠবে। কবি এখন
নতজানু ষোড়শীর কাছে"।
কবিতার কথা ও বর্ণনা চমৎকার বলে ফেলতে পারেন, একজন কবিতাপ্রেমী মননশীল ভাবনা যাপনের পথ ধরে আঁকেন কবিতা। কবি রামেশ্বর আরো আরো চমৎকার কবিতা লিখবেন। আরো আরো সুন্দরতম কবিতা পাবো আগামী দিনে এই বিশ্বাস।
প্রকাশকঃ অক্ষর পাব্লিকেশান। প্রচ্ছদঃ পুষ্পল দেব। দাম ৭৫.০০ টাকা।
HOME
এই লেখাটা শেয়ার করুন