বৃত্তি বা পেশা আপনাকে বাধ্য করছে আপনার এতদিনের অনুশীলিত চরিত্রধর্মকে বদলিয়ে দিতে। এতদিন ধরে জেনে আসছিলেন যে, সৎভাবে জীবনযাপন করার লক্ষ্যে আপনাকে সৎভাবে যে-অর্থ আসে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন। একজন অশিক্ষিত, স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি অব্দি হয়তো পড়েছে, সে এসে আপনাকে জানালো ‘চিন্তা কইরেন না, ছয়শ টাকা দেন, আমি গ্যাস আইনা দিমু’। বহুদিন লাইন ধরেও যখন অভিভাবক হিসেবে আপনি ব্যর্থতার প্রমাণ দিলেন, ঠিক সেইসময়ই গিন্নি এসে বললেন ‘দুইশ দিয়া দেও, তবু গ্যাস আইবো --- এই গরমে এমনিতেই প্রেসার বাড়ছে, তারমধ্যে তুমি খালি কও সৎভাবে সৎভাবে। সৎ আছেনি কেউ?’
সেই লোকটা গিন্নির কথাটি শুনলো, এবং আকর্ণ হাসি দিয়ে টাকা নিয়ে নিল। আর সত্যি বলতে কী, পরদিনই গ্যাস বাড়িতে এলো। স্বস্তি।
কিন্তু আপনি খোঁজ নিয়ে দেখলেন, সমাজে যারা সামান্য লেখাপড়া শিখেছে, অথবা স্কুলেও যায়নি, তদের প্রতি মাসে যে-রোজগার; কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও আপনি চাকরি না পেয়ে এদিক-ওদিক খুচরো কাজ করছেন, এতে আপনার মনে হচ্ছে আপনার সম্মান বজায় থাকছে, আপনি দু-নম্বরি কোনো রোজগারের পথে জড়িত নন, আপনি ১৩ ঘন্টা রোজ পরিশ্রম করেও ওই সম্মান বাঁচানোর জন্য প্রতিদিনের ‘মহান দারিদ্র্য’ বহন করে যাচ্ছেন। অথচ যে লোকটা আপনাকে গ্যাস এনে দিল, খোঁজ নিয়ে জানলেন সে জায়গা কিনে দালান কোঠাবাড়ি করেছে; আর তাজ্জবের কথা (আপনার কাছে ‘তাজ্জবই’ মনে হবে, কারন আপনার মননে যে আদর্শ খেলা করে তা এতদিনে বস্তাপচা হয়ে গেছে) তার ১টি মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক সরকারি চাকুরেজীবীর সঙ্গে; এবং ছেলেটি চেন্নাইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
আপনার মোরালিটি আপনার কাছে—কথাটা বললো সেদিন আপনার এক বন্ধু। যে-বন্ধুটিকে আপনি দেখেছেন ছেলেবেলা থেকে। সেই বন্ধুটি দেড় লক্ষ ক্যাশ টাকা দিয়ে চাকরি কিনেছে, তার দুটো ছেলেই বাইরে পড়ে, একজন ডাক্তার হবে অন্যজন ইলেক্ট্রিকেল ইঞ্জিনিয়ার। আপনার বাবা ছিলেন গ্রামের স্কুল মাস্টার, স্বদেশী যুগের একজন নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক সৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আপনি চোখের সামনে দেখেছেন কীভাবে যৌথ পরিবারগুলি ভাঙচুর হয়েছে স্বাধীনতার সময়। আপনার বাবা বড় ভাই হওয়াতে আপনার বাবার মা অর্থাৎ ঠাকুরমা আপনার বাবার হাত ধরে এপার ভারতবর্ষ ত্রিপুরায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল ভাই-বোন-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পরিবারের সদস্যগণ। ক্রমে এ রাজ্যে জীবনসংগ্রামে লড়াই করতে করতে আপনার বাবা ও ঠাকুরমার মৃত্যু হলো। বর্ডার পেরোনোর সময় আপনার মতো একজন সেন্সেটিভ নাতির এক হাত ধরে এবং অন্য হাতে একটি মুড়ির টিন কোলে-কাঁখে করে এনেছিলেন। অজানা পথে ক্ষিধে পাবে নাতির ভেবে --- সেই দৃশ্যটি আপনার মনে পড়ে গেল আজ হঠাৎ করে, যে, ওই দুশো টাকা নিয়ে যে রান্নার গ্যাস সাপ্লাই করে দেয়, এবং এ করেই যে ছেলেমেয়ে মানুষ করছে, বাড়িঘর করছে, সে-ই তো আধুনিক মনের মানুষ। আপনি ভাবছেন, তাহলে আমি কী শিখলাম এতদিন এই পৃথিবীতে।
এসব ভেবে ক্লান্ত আপনি বাজারে ঢুকলেন। আপনার খালপারে ১৯৫৬ সালে বাবার কেনা বাড়ি। আপনার স্ত্রী ও দুই পুত্র। আপনার মানসম্মান আপনি বজায় রাখতে চান সৎভাবে অর্থ উপার্জন করে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনে। তাই দৈনিক ১২ ঘন্টা শ্রম করেও রাস্তার পাশে বসে যে সবজি বিক্রি করে প্রতিদিন সন্ধ্যে-সকাল, তার চেয়েও কম রোজগার আপনার। আপনার ছেলেরা পাস করে বসে আছে। দুজনেই সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। অথচ আপনি কোনোদিন কোনো রাজনীতি দলের সদস্য হতে পারলেন না, মিছিলেও যান নি কোনোদিন, ভোট দিতেও যান না, বলেন কাকে দেবো পছন্দ হয় না; ব্যক্তি যখন দলের চেয়ে বড় হয় না, তবে এ রাজনীতি করে কী হবে, এসব আপনার মনের কথা, মনের দেশের মনের মতো আদর্শবাদ-বুলি। সুতরাং, আপনার দুই ছেলে এবারই ঠিক করেছে যে, সরকারি চাকরি না-করেও পৃথিবীতে বাঁচা যায় এবং মা-বাবা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহও বাঁচা যায়, এবং যথেষ্ট মান-সম্মান বজায় রেখেই।
কীভাবে ? প্রশ্নকর্তা আপনার বিবেক। উত্তরদাতা ওই দুই পুত্র। যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েও রাস্তার ধারে সবজি নিয়ে বসতে চায়; কিন্তু কখনই ওই ২০০ টাকা বেশি দিয়ে গ্যাস সিলিণ্ডার পাইয়ে দেয়ার ব্যবসাটা কখনই নয়।
এসব কথা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে আপনি বাজারে ঢুকলেন। কিন্তু কিছুদিন আগেও আপনি ১০ টাকার নোট দিয়ে ৮ টাকার সবজি কিনে ২ টাকা ফেরৎ পেতেন। এখন বলা হয় --- ‘মিলাইয়া নেন’ অর্থাৎ ২ টাকা খুচরা নাই। অর্থাৎ ২ টাকা আপনি সব্জিওয়ালাকে দান করে যান অথবা আপনার দরকার নেই তবু আপনি ১০ টাকার পর ১৫ টাকা, নয় একেবারে ২০ টাকার সবজি নিতে হবে, কারণ ৫ টাকার কোন খুচরা নেই। না কিনলে যেতে পারেন আপনি, আমার বিক্রি করার কোনো ইচ্ছে নেই আপনার কাছে। এসব কথা আপনাকে বলতে হয়নি। ক্রমে ক্রমে প্রচলিত হয়ে গেছে। আপনি এসবের জটিল চক্রের ভেতর পড়ে গেলেন, এই অর্থনীতির গ্যাঁড়াকল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না আপনি, বাড়তি টাকাও রোজগার করতে পারছেন না, --- তারপরেও আপনি ভেবে রেখেছেন আপনি সৎভাবে সৎ উপার্জনে জীবনযাপন করতে চান সপরিবারে।
অসম্ভব! আপনি মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছেন। মূর্খরা স্বর্গের বারান্দায় পৌঁছেই ডক্টরেট পায়, এটাও জানেন না? এরা কোনোদিন বলে না যে ‘আমি কিছুই জানি না’ – ‘আমি মুস্কিল আসান, বলুন কী চাই, টাকা ঢালুন সব ব্যবস্থা হবে।’
আসলে ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে যারা ঘুরঘুর করে, এরা বিদ্যা ও জ্ঞানের পক্ষপাতী নয় আপনার মতো। একমাত্র রাজনীতির ক্ষমতাতেই এরা পরিচালিত হয়। যেমন ধরুন জীবনে কোনোদিন পড়াশোনা করেনি, ফেল থাকা ছাত্র --- একদিন রাজনীতির ব্যবসায় ঢুকে এমএলএ হয়ে গেল। এখন এই লোকটির ক্ষমতা হচ্ছে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়া। খুবই মূল্যবান। আপনি কিংবা আপনার আদর্শবাদী ছেলেমেয়েরা হয়তো সে সার্টিফিকেট চাইবে না; কিন্তু আপনাকে কোনো না কোনো দলে নিতে চাইবে রাজনীতির ব্যবসায়ীরাই।
চট করে এদের মূর্খ বলা ঠিক হবে না। ঝুঁকি আছে আপনার। বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিতে পারে এরা। এদের লোকের যখন এসে ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢোকে, মনে রাখতে হবে এরা রাজনীতির ব্যবসা করে খায়; এদের মন জুগিয়ে না চললে আপনার ছেলে-মেয়েদের জন্যে কোনোদিন কোনো সরকারি সাহায্য পাবেন না, চাকরি পাবেন না, লোক পাবেন না, আপনার চোখের সামনে আপনার যুবতী মেয়েকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবে, এসব দেখেও আপনি গর্জাবেন না, আপনার প্রাণের ভয় আছে, আপনার সামনে তখন সব অন্ধকার; তখন আপনার সামনে কোনো আদর্শবান উকিল নেই, স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই, দেশভক্ত নেই --- চতুর্দিকে শেয়ালের ও শকুনের চিৎকারের ভেতর আপনি তখনও ভাবছেন আপনি সৎ, সৎভাবে বেঁচে আছেন। শেষ শব্দটি ছুঁড়ে ফেললেন এই পৃথিবীতে, ভূমির উপরেই --- থুঃ।
HOME
এই লেখাটা শেয়ার করুন