নিবন্ধ

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন গ্রীষ্ম সংখ্যা মে ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]
যৌনতা ও বাংলা কবিতা 
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

যৌনতা কথাটি শুনলেই এখনও অনেকেই কানে হাত দেয় কিন্তু এরাই আবার গোপনে নীল ছবি দেখেন কিংবা সুযোগ পেলে অন্য কিছু করে ফেলেন। যৌনতার পাঠ প্রতিটি নারী পুরুষের নিজস্ব একটি ধারণার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। রাধা কৃষ্ণ এবং হর পার্বতীর মধ্যে যে প্রেম এবং যৌন আবেদন তা কবির কবিতায় উঠে এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। শোপেন হায়ার তার " Metaphysics of the love of Sexes " এ যেখানে বলেছিলেন - পুরুষ-প্রেমের কেন্দ্র ও গন্তব্য হল শরীর, শরীর তার প্রেমের শীর্ষ; নারী শরীরের মাধ্যমে প্রেমের জন্ম দেয়, তাই তা ক্রমবর্ধমান: এই বক্তব্যের সমর্থন পাই কৃষ্ণের প্রত্যাখ্যানে। পুরুষের কবিতার যৌন প্রবণতায় নিহিত আছে অবচেতন ভয় ও পরাজয়। নারীর কবিতায় যৌনসংকেতের ভেতরে প্রত্যক্ষ সমাজ বিরোধিতা ও স্বেচ্ছাচার লুকিয়ে আছে। কবি কিটস্ লিখছেন ,
"The day is gone, and all its sweets are gone!
Sweet lips, soft hand, and softer breast "

নারী শরীরের স্পর্শ প্রলোভন উত্তীর্ণ হয়েছে প্রেমের প্রশান্তিতে। আবার আমার দেশের কবি লিখছেন "মূর্তি না মাটির নারী / ছোটো শক্ত স্তন / ফোঁটা ফোঁটা মধুপাত হয় "। এই চিত্রকল্প কবির আশ্চর্য কুশলতার প্রকাশ। কবিতায় যৌনতা কিন্তু পর্নোগ্রাফি নয়। পর্নো বা পানুছবিতে যেভাবে একজন নারীর বিনির্মাণ ঘটে তা কবিতায় কখনো হয় নি। বরং নারী এখানে দয়িতা বা প্রেমিকা। তার প্রতিটা অঙ্গের জন্যই কবির প্রতিটি অঙ্গ কাঁদে।

কালিদাস কুমারসম্ভবে বললেন:-
"অনোন্যমুৎপীড়য় দুৎপলাক্ষ্যাঃ স্তনদ্বয়ং পান্ডু তথা প্রবুদ্ধম্।
মধ্যে যথা শ্যামমুখস্য তস্য মৃণাল –সূত্র্ন্তরমপ্যলভ্যাম।”

আবার বিদ্যাপতি আশ্চর্য সুন্দর কৌশলে লিখলেন,
“উরহি অঞ্চল ঝাঁপি চঞ্চল
আধ পয়োধর হেরু।
পবন পরভাবে শারদ ঘন জনু
বেকত করল সুমেরু।”

কালিদাস এবং বিদ্যাপতি দুটি ক্ষেত্রেই নারীদেহের বর্ণনা প্রাকৃতিক, মনস্তাত্বিক নয়। রমেন্দ্রকুমারের "একটি মিশকালো ব্রেসিয়রের মধ্যে বসে চারটে বেড়ালের বাচ্চা ...." কবিতার অন্তর্গূঢ় চেতনা প্রবাহ প্রাচীন কবির রচনায় অনুপস্থিত।
কবিতা সিংহের কবিতা সাহসী অভিব্যক্তির প্রকাশ এবং এই প্রকাশ যথার্থ লিঙ্গ ভেদের সীমা লঙ্ঘনের সচেতন প্রয়াস এবং এই চাপা যৌনতা নজর এড়ায় না পাঠকের।

“হরিণী না জানে ঘর কোথা রে হরিণ?
একতারা হয়ে যায় তার ছিঁড়ে বীণ
শিখা খায় লক লক
আগুনে আহুতি হোক
চোখ নাক স্তন ত্বক মাংসের ঋণ
বৈরী অপনা মাসে হরিণা অচিন।
কিংবা 
শমীবৃক্ষে শস্ত্র খুলে রাখো
খুলে রাখো রমণী ধরম্
কিম্পুরুষের সঙ্গে ঘটে যায় পৃথিবীর
সমস্ত অফলা সঙ্গম।”

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতায় যৌনতা আসে কখনও বৈধ বা অবৈধতার তৃপ্তি নিয়ে প্রতিদিনের রক্তাক্ত জীবন যাপনের মধ্যে:-
শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে ফিরে / আসি শরীরের কাছে / কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে / শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনি / মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি / কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে। (হিমযুগ)

কবি এখানে শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূরে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসছেন সেই শরীরের কাছে ।

একসময় পশ্চিমবঙ্গে জীবন শৈলী নাম যৌনশিক্ষা চালু করা হয় যুগের দাবি মেনে কিন্তু চাদ্দিকে শুধু গেল গেল রব ওঠে। এটা হলে হয়তো কিছুটা ধর্ষণ মানসিকতার পরিবর্তন হতো। আজ নেটের দৌলতে যৌনক্রিয়ার পানু পৌঁছে যাচ্ছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না ।
পঞ্চাশের কবিদের একেবারে বিপরীত বিনয় মজুমদার। তার কবিতার ভেতরে যে যৌনতা তা আবহমান নারী পুরুষের মিলন মাধ্যম এবং তা যথেষ্ট সাংকেতিক:-
আমার ভুট্টায় তেল মাখতে মাখতে চাঁদ বলল, / 'তোমার ভুট্টাটি বেশ মোটা' আমি তার জবাব না দিয়ে / অন্য কথা বললাম -'ভুট্টার মাথায় একটু তেল মাখো' তবে / চাঁদ মাখল না শুধু চারপাশে গায়ে মাখে, / তেল মাখা হলে / চাঁদ মেঝে থেকে হেঁটে বিছানায় এসে শোয়, / বিছানা মেঝেই পাতা থাকে। / বালিশে মাথাটি রেখে পা দুটিকে তুলে ধরে শুয়ে পড়ে, / আমি / হাঁটু গাড়ি, দু হাঁটুর নিচে দিই খুলে রাখা / গরম প্যান্ট ও জামাটিকে। / তারপরে গুহা দেখি গুহাটি বন্ধই আছে, / দু ফাঁক করলেই গুহা / সম্পূর্ণ বন্ধই থাকে, চাঁদ শোয়া অবস্থায় হাত দিয়ে / ভুট্টাটি ধরতে গেলেই / আমি তাকে বললাম "দাঁড়াও ভুট্টাটি আমি নিজেই / ঢোকাতে পারি কি না / দেখা যাক' বলতেই ভুট্টাটিকে চাঁদ আর ধরল না, / ভুট্টার মাথাটি / গুহার বোজানো মুখে চেপে দিই সঙ্গে সঙ্গে / সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি / ভুট্টাটি সহজভাবে ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা / শুরু করি।" (কবিতার খসড়া)

বিনয়ের যৌনতা চলিষ্ণু জীবনের ব্যালেন্স একেবারে পুরোপুরি। এবার আমরা ষাটের কবিতায় যেখানে যৌনতা স্পষ্টবাক, শরীরী সৌন্দর্য অনুপস্থিত। আত্মপ্রত্যাখ্যানশীল যৌনতা ছিল ষাটের কবিতায়। মলয় রায়চৌধুরী যেখানে লিখছেনঃ-
ওর স্তনে অন্তর্বাস ছিল না কখনও ব্লাউজ কাকে বলে জানে না / শাড়ির আসল রং হয়তো ও নিজেও ভুলে গেছে / আঙুল দিয়ে টের পাই ওর চুলের জট / আমি বুঝতে পারি আমি থির থির করে কাঁপছি / হাত ধরে পাট ক্ষেতের মধ্যে নিয়ে যায় / আমার জামাপ্যান্ট খুলে দেয় / আমি চাই / আমি চাই না / মাঝরাতের প্রাঙ্গণে আমরা দুই উদোম / আমি এরকম নারীর সঙ্গম করি নি কখনও / স্তদ্ধতা- ফাটানো চিৎকারে দুর্গন্ধের শতছিন্ন / নারী জড়িয়ে ধরে। (অভিজ্ঞতার মৃত্যু)

মলয়ের নারী অসুন্দরের বার্তা বয়ে আনে। বার্তা আনে সেই জীবনের, যে জীবনে কামনা এসেছে ভয়াবহতা নিয়ে হয়তো বা প্রয়োজনে।
সত্তরের� জয় বা রণজিতে লক্ষ্য করা যায় বেশি মাত্রায় যৌনতা কিন্তু সেখানে নিজস্বতার অভাব ছিল না।
রণজিৎ লেখেন:-
রাত্রি দিন চুমু খাবো, বুকে জাপটে, মুখ থেকে মুখে / ভরে দেব অক্সিজেন, মধু, মদ, সিংহির কামনা / আমার কঙ্কালটিকে দুহাতে জড়িয়ে রেখে, তুমি থাকবে অনন্ত যৌবনা। (ইচ্ছে)
আবার জয় লিখছেন:-
"এতই অসাড় আমি চুম্বনও বুঝি নি। মনে মনে দিয়েছিলে, তাও সে না-বোঝার নয় - / ঘরে কত লোক ছিল, তাই ঋণ স্বীকার করি নি / ভয়, যদি কোনো ক্ষতি হয় "

এবারে আসি মেয়েদের কবিতায় কিভাবে উঠে এসেছে যৌনতা। দেবারতি মিত্রের যুবকের স্নান বর্ণনায় দেখিঃ-
আবিষ্টা যৌবনা জল উড়ে এসে
ভেঙে দেয় তাকে
ভেঙে ভেঙে নিয়ে যায়
সাদা পাথরের প্রাকৃতিক কারুকাজ
ঘুমন্ত ঊরুর একখানি
স্তদ্ধ গর্ভে
টেনে নিল দূর পাহাড়ের জন্মদেশ

মিতুল দত্তের কবিতায় আমরা পাই শরীরী বিভার খোলামেলা নতুন মাত্রা। অতি স্পষ্ট ভাবে মিতুল বলেনঃ-

যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস
মনে হয় ওরা তোর মেয়ে
একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে
ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের

স্নানের সময় যেই খুলে দিস
হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে
কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে
যে যার মতো একা (দুর্বার জন্য কবিতা)

আবার পুরুষ অঙ্গের বর্ণনা রাজশ্রী চক্রবর্তী এভাবে লেখেনঃ-

ডিম পাঁউরুটির মত জীবনে, তুমি এলে / একটি হলুদ রঙের কলা / নিটোল আকার দেখে, বিশ্বাস করো, / ভারি খিদে পায়"

উদহারণ অজস্র। এখনকার যারা কবিতা লিখছেন তারা মনে হয় আরো বেশি সাহসী এবং সরাসরি যৌন অঙ্গ তাদের কবিতায় বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় চলে আসছে। এটা কেউ খারাপ ভাবে নিলে খারাপ লাগে। যা অনিবার্য যা সত্য তা মেনে নিতে হয়। আমাদের কবিতা বিশুদ্ধ হয়ে থেকে যাবে চিরকাল না তাকে গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে যাব এবং আরো সাহসী প্রকাশ সবকিছু ভেঙে চুরে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা ভাববেন ভাবীকালের কবি। স্বল্প পরিসরে বাদ পড়ে গেল গোটা বাংলাদেশ যেখানে বিপ্লব করছেন এ যুগের কবিরা। আমি শুধু একটি উদহারণ রেখে শেষ করলাম এই আলোচনা । মাসুদার রহমানের কবিতাটির নাম "সিংহ"।

“সিংহীটির পাশে শুয়ে আস্তে আস্তে সিংহ হয়ে উঠি
তীব্র দাঁতের ভেতরে পাতলান জিহ্বা পুরুষ লেহনের তুলনা হয় না
কেশরও একটি বিস্ময়
পুরুষের দাঁড়ি আর গোঁফ বিষয়টিও সিংহ বিষয়ক”
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন