রাংতা বানু
উঁচু দাঁত, ট্যাপা নাক, দীঘল দুটি চোখ, বয়েস তেরো কি চোদ্দ, কিংবা পনেরোও হতি পারে,
গরীবগুর্বোর ঘরে ছেলেপিলের বয়েসের হিসেব থাকে না।
সেই যে বচ্ছর বান ডেকেছিল খুব কিংবা ধান মোট্টে ফলেনি কো এভাবে হিসেব চলে।
তা যাইহোক মাবাপখাওয়া অনাথ মেয়েটিকে নিয়ে বেলডাঙ্গার পঞ্চানন এসে দাঁইড়েছেল লেকভিউ রোডের সান্যালবাবুদের লনে।
ঘরের ফাইফরমাশ খাটার জন্যি একটি কাজের লোক চাই।
পইপই করে শিখিয়ে এনেছিল পঞ্চা, জাত জিগাইলে কইবি, হিঁদু, চাষা, সদগোপ।
সেই ইস্তক রাংতাবানু হিঁদু হইছে।
নোক্কীনারাণের ঘরে সোনঝে পিদিম দেয়,
ভুলেও আল্লারে আর একবারটিও ডাকেনিকো।
বাবুদের পেল্লাই ঘর, হাজার মানুষের যাতায়াত,
সেজ দিদিমুনির পুরানো ফরক আর ছুটকি দিদির ইজের পরে রাংতা বেড়ে ওঠে পুকুরের শাপলার মতো।
এসোজন বসোজন কালে ভদ্রে দুদশটাকা বোকশিশও গুঁজে দিয়ে যায় হাতে,
আর দুচারজন নোলা চোখ আড়ালে আবডালে হাত দেবারও চেষ্টা চালায় তার বুকে বা পাছায়,
তা বাড়ন্ত বয়সের কোঠায় এসব এট্টু আধটু অঘটন হতিই পারে,
এইসব খুশি বা আক্রোশ রাংতা সবকিছু তুলে রাখে বুকের খাঁচায়।
একে একে সব দাদাবাবু দিদিমণিদের বে হতি থাকে,
চাকুরী জীবিকার টানে টানে সব বিদেশ বিভূঁই চলে যায়।
রাংতার তো মাবাপ নেই, তাই তার বে হতি নেই।
সে ভাদোরের রোদে সেঁকে রাখে তোষক, বালিশ, আলোয়ান, সোয়েটার। মুছে রাখে ফার্নিচার, দামি দামি সেরামিক বাসন কোসন, চোখ ফেটে পড়ে যাওয়া অবাধ্য জল।
সেই যে কবে যেন এসেছিল কোন এক যুগে গ্রামতুতো চাচার হাত ধরে,
ভাতের দায়ে চুপিচুপি আজান ভুলেছে, ভুলেছে রমজান, এখন সে নবগ্রহস্তোত্র আউড়ায়, সুর করে গায় মীরার ভজন গান।
ধুপদীপ জ্বালে চিলেকোঠার ঠাকুর ঘরে রোজ সন্ধ্যায়।
বাবামশায় চলি গেলেন দুবছর আগে, মাঠান গেলেন গত বর্ষায়। পাশে তাহাদের ছিল রাংতাই একা। দাক্তারবদ্যি, ওষুধ, হাসপাতাল। বাকি সব যারা উপদেশ দেয় ফোনে, নামমাত্র দেখতে আসে বা দুদিন থেকে ফিরে যায় যে যার ঠিকানায়।
চার মহলা বাড়িটায় এখন রাংতাবানু একা। বয়স তার ষাটের কোঠায়। চোখে ছানি, চুলে রূপার ঝিলিক।
আজ সকালে ফাইনাল মিটিন বসিছে হলঘরে।
এ ঘর নাকি বেচা হবে।
বাকি ব্যাংকের কাগজপত্তোর, মাঠানের গহনাগাটি, পিতল-কাঁসা-রূপার বাসন কোসন আর যাবৎ কিছু সম্পত্তির চুলচেরা ভাগ হবে পাঁচভাইবোনে।
ওগো, শুনতিছো, তোমরা কে নেবে গো রাংতাবানুরে?
চুলচেরা ভাগাভাগি, চেঁচামেচি, কথার গায়ে কথাদের চাপানউতোর রাংতার ক্ষীণ গলা কারো কানেতে না পৌঁছায়।
এই লেখাটা শেয়ার করুন