শনিপুজোয় হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন – সদানন্দ সিংহ

শনিপুজোয় হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন    (ছোটদের গল্প)

সদানন্দ সিংহ

স্কুল থেকে ফিরেই দেখলাম, টেবিলের ওপরে আমার চার নম্বরী খাতায় বানানো ‘ভিজিটরস্‌ বুক’ খাতায় বড় বড় হরপে জ্বলজ্বল করছে – “হাবু, আজ আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যেয় শনিপূজার উদ্বোধন করিবেন কলিকাতার প্রখ্যাত হর্ষবর্ধন; সঙ্গে থাকিবেন উনার ভাই গোবর্ধন। ইতি – জটুমামা।”

জটুমামা মানে আমাদের চিংড়িমামা ওরফে জংলিমামা। আর আমি জানতাম পৃথিবীতে প্রখ্যাত হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন জুটি শুধু শিব্রাম চক্কোত্তীর গল্পেই আছে। উনারা কি এখন আগরতলার জংলিমামার বাড়িতেও উপস্থিত হচ্ছেন নাকি ? কথাগুলি আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছিল না। বিশেষ করে জংলিমামার মতো মিথ্যেবাদী লোক যে রাতকে দিন আর দিনকে রাত বলতে জিভে কোনোদিনই আটকাতে দেখিনি। ভিজিটরস্‌ বুক খুলে আমি আবার লেখাগুলি পড়লাম। এবার পড়ে আমার কিন্তু বেশ রাগ হল। ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে গেল বাড়িতে শনিপূজা, অথচ আমাকে আমন্ত্রণ জানাবার ভদ্রতাবোধটুকু দেখাল না। এমন অকৃতজ্ঞ, মিথ্যেবাদী, স্বার্থপর লোক আর হয় না। চুলোয় যাক জংলিমামা, চুলোয় যাক শনিপূজা। আমি সশব্দে ভিজিটরস্‌ বুক বন্ধ করে দিলাম।

বিকেলে কিছু খেয়ে আমি রবিস্যারের কছে টিউশানি পড়তে চলে গেলাম। টিউশানি সেরে সন্ধ্যের দিকে আমি যখন বাড়ি ফিরে এলাম তখন দেখি গোবরা, ফটকে, জগা আর সুদেব রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওদেরকেও জংলিমামা ঐ একই কায়দায় শনিপূজার খবরটা জানিয়ে গেছে। কিন্তু কাউকেই আমন্ত্রণ জানায়নি। গোবরা তো দেখলাম ক্ষেপে একদম লাল। আর ক্ষেপে গেলে গোবরা কেবল তোতলায়। গোবরা বলছিল, জ-জ-জ-জ-।
কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারছিল না। সুদেব পূরণ করে দিল, জংলিমামা।
₋₋ হ্যাঁ। সে আমাদের পে-পে-পে-পে-।
কথাগুলো শেষ করতে না পেরে গোবরা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। সুদেব আবার পূরণ করে দিল, পেয়েছে কি ?
₋₋ হ্যাঁ। চ-চল্‌ এখন। আমরা শ-শনিপুজোর প্র-প্র-প্র-।
আমি এবার পূরণ করে দিলাম, প্রসাদ সব খেয়ে ফেলবো।

ঠিক হল, সুযোগ পেলেই পুজোর প্রসাদ সব সাবাড় করা হবে। অতঃপর আমরা রওনা হলাম জংলিমামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসল উদ্দেশ্য অবশ্য হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনকে চাক্ষুষ দেখা। কেমন হবে জুটির চেহেরা, কার্টুনের মত কিনা? ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করতে করতে এগোতে থাকলাম। যদিও আমাদের সন্দেহ ছিল হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের ব্যাপারটা ধাপ্পা কিনা।  

সন্ধ্যেয় আমরা জংলিমামার বাড়িতে একে একে ঢুকলাম। সত্যিই সেখানে তখন শনিপুজোর আয়োজন চলছে।
জংলিমামা আমাদের দেখে বললো, তোরা সব এখানে দেখি!
আমি বললাম, কেন, এখানে আসতে মানা নাকি ?
জংলিমামা জবাব দিলেন, এসেই যখন পড়েছিস তখন মানা করে আর লাভ কি। বস্‌। একটু পরেই শনিপুজোর ফিতে কাঁটা হবে।
কথাগুলি শুনে মনে একটু খটকা লাগলেও ফিতে কাটার কথা শুনে একটু তাজ্জব ব্যাপার বলে মনে হল। ফিতে কেটে শনিপুজোর উদ্বোধন জীবনে কখনো শুনিনি। আর এই ফিতে কি হর্ষবর্ধনই কাটবেন?
আমরা পাঁচজন বারান্দায় এক লম্বা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আসলে অপেক্ষাটা ছিল হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের জন্যে। একসময় জংলিমামা বারান্দায় শনির ঘটের একটু আগে একটা লাল ফিতে বেঁধে দিল। তারপর যাবার আগে আমাদেরকে বলল, এবার আমি হর্ষদা-গোবরাদা-কে আনছি। বলেই জংলিমামা ঘরের অন্দরমহলে ঢুকে গেল। বেশ অবাক হলাম, তাহলে কি হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন এনারা কি এতক্ষণ জংলিমামার বাড়িতেই ছিলেন ? আর জংলিমামা ইচ্ছে করেই আমাদেরকে সেটা বলেনি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা দু’জন লোককে নিয়ে জংলিমামা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। লোক দু’জনকে অনেকটা শিব্রাম চক্কোত্তীর লেখা বইয়ের ছবির মতোই লাগছিল। আমাদের সামনে দিয়ে যাবার সময় জংলিমামা আমাদেরকে দেখিয়ে সামনের লোকটিকে বলল, এই যে হর্ষদা, এর সব আমার ভাগ্নে। এক-একটা হনুমান।
পেছনের লোকটার হাতে বিরাট একটা বড়ো পাতিল। তিনি বলে উঠলেন, হনুমান! তাহলে তো একটা করে লেজও থাকবে।
জংলিমামা জবাব দিল, না গোবরাদা, এরা লেজগুলি বাড়িতে রেখে এসেছে।
গোবর্ধনের চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল, তাই নাকি! তা বিড়ালে নিয়ে যাবে না তো?
₋₋ চুপ করবি গোবরা? হর্ষবর্ধন ধমকে উঠলেন। কথাগুলির সঙ্গে আমরা একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দও শুনলাম। দেখলাম হর্ষবর্ধনের হাতে মাঝারি সাইজের একটা কাঁচি। উনি হাওয়াতেই কাঁচি চালাচ্ছেন ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে।
তারপর ফিতার সামনে গিয়ে হর্ষবর্ধন ফিতা কাটতে চলেছেন এইসময় আবার গোবর্ধনের কথা শোনা গেল, ফিতার আর্ধেক কেটে আমাকে কাঁচিটা দিও। বাকিটা আমি কাটবো।
₋₋ পাগল নাকি! পৃথিবীতে ফিতা কি কোনদিন দু’জনে কাটে ? ফিতা একজনেই কাটে – একজন সম্মানীয় ব্যক্তিই। বলেই হর্ষবর্ধন খ্যাচ করে ফিতা দু টকরো করে দিলেন। গোবর্ধন এবং জংলিমামা হাততালি দিয়ে উঠল। আমরা সবাই হাততালি দিয়ে তাল মেলালাম।
দেখলাম, আরো কিছু কাটার জন্যে হর্ষবর্ধন হাওয়ায় কাঁচি চালিয়ে যাচ্ছেন অনবরত।