ড্যামো – সদানন্দ সিংহ

ড্যামো – সদানন্দ সিংহ

ড্যামো                   (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

(আখ্যানের বিকেল আয়োজিত গল্প উৎসব ২০২৫-এ পঠিত)

সুখীলালের নাকি ড্যামো হয়েছে। সরস্বতী বলেছে অনেকবার। সে বলেছে, “তোমার কোন ব্যামো হয়নি; তোমার হয়েছে ড্যামো।” সুখীলাল সেকথা মানে না। তার তো মনে হয়, তার বুঝি কোনো ব্যামোই হয়েছে, যে ব্যামোর হদিস হয়তো কোনো ডাক্তারের কাছে নেই।

তবে সুখীলাল জানে তার সারা আকাশ জুড়ে ইদানীং সচেতন, অচেতন এবং অবচেতন মনের এক খেলা চলে। অচেতন এবং অবচেতন মন হঠাৎ সচেতন হয়ে বেরিয়ে আসে সবার সামনে, সচেতন মন চলে যায় অচেতনে। আর সে খেলায় সে নিজেও ফেসে যাচ্ছে। এই খেলাটাই যেন এক ব্যামোর মতই মনে হচ্ছে তার কাছে। সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না, কীভাবে কখন কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলেছে।

আজ সাতসকালে বেশ ঠান্ডা। জড়োসড়ো কম্বলমুড়ি হয়ে থাকলে বেশ আরাম। সরস্বতীও কম্বলের নীচে। বাড়িতে দু’টি প্রাণী। রবিবার বলে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। একমাত্র ছেলে ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সুখীলাল চা বানাচ্ছে। দু কাপ চা বানাবার পর সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকতে যায়। সে সরস্বতীকে ডাকে, “ডার্লিং চা হয়ে গেছে, উঠো।” কিন্তু এ কথার বদলে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, “ইডিয়ট, আরামি হারাম হ্যায়, উঠো।” শুনে সরস্বতী ধড়মড় করে উঠে অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে গতকালও অফিসে সুখীলাল এক কাণ্ড করে এসেছে।

গতকাল অফিসে যখন সুখীলাল দুপুরে নিজের টিফিন খেতে তার টিফিন ক্যারিয়ার খুলছিল তখন শ্যামাচরণ সরকার তাকে এসে কাঁচুমাচু করে বলেছিল, দাদা আজকেও হল না। আজ দীর্ঘ তিন মাস ধরে আমার বিলের পিছনে ঘুরছি। আমি এক ছোট্ট সাপ্লাইয়ার। আমার টাকা আটকে যাওয়াতে আমার যে কী অসুবিধে হচ্ছে তা বলে বোঝানো যাবে না।

সুখীলাল শ্যামাচরণের ফাইলের কাজ শেষ করে দু মাস আগেই তাদের অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট কালীদা’র কাছে পাঠিয়েছিল। সুখীলাল জানে কালীদা লোকটা কেমন।

— আচ্ছা আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি কালীদাকে একটু বলে দেখি। বলে সুখীলাল শ্যামাচরণকে কালীদার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কালীদাকে বলেছিল, শ্যামাচরণবাবুর ফাইলটা ছেড়ে দিন না কালীদা। ওর মত একজন ছোট্ট সাপ্লাইয়ারের খুব অসুবিধে হচ্ছে।

কিন্তু আশ্চর্য, সে বলল এক কথা, আর বেরিয়ে গেল আরেক কথা, “শ্যামাচরণবাবুর ফাইলটা কেন আটকে রেখেছেন রাস্কেল ! ঘুষ খেতে খেতে পেটটা যে ফুলে গেল। ঘুষখোর কোথাকার।”

শুনে শ্যামাচরণ তো অক্কা যায় যায় অবস্থা, বলে, থাক থাক সুখীলালবাবু, আমার বিল পাস হয়ে যাবে, ওটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।

তারপর তো সমস্ত অফিস জুড়ে হুলস্থুল। কেউ বলেছে সুখীলালের এ ভাবে বলা উচিত হয়নি, আর কেউ বলেছে খাসা হয়েছে। পরে ঠিক হল, সোমবার অফিসে এ নিয়ে একটা মিটিং হবে। জানি না, এদিন হয়তো সুখীলালকে দিয়ে ভুল স্বীকার করানো হবে।

চা খাবার পর সরস্বতী বলে, আমি তাহলে ইডিয়ট !

সুখীলাল হাসে, ইডিয়ট না, ডার্লিং।

সরস্বতী এবার তার স্বামীটিকে নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। সত্যিই তো, এভাবে যদি অন্য কারুর সঙ্গে হয় তাহলে মুশকিলই হবে। একটু ভেবে সে বলে, চলো, আজ কোনো সাইকো অ্যাানালিস্টের কাছে যাই।

সুখীলাল জবাব দেয়, কী যে বলো, আমি একদম ঠিক আছি।

— কিন্তু তোমার ড্যামো কীভাবে সারবে ?

— ওটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমি বাজার যাচ্ছি। আজ মাংস-পোলাও খাবো।

বাজারে গিয়ে আবার এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে সুখীলাল। সকালের ঠাণ্ডা ভাব এখন আর নেই, বেশ রোদ বেরিয়েছে। ব্যাগভর্তি বাজার করে সে যখন একটা রিক্সা খুঁজছে তখন ওদের রিজিওনাল অফিসের বসের সঙ্গে তার সামনাসামনি দেখা হয়ে যায়। বস অসম্ভব মোটা। বসের দু হাতে দুটো বাজার ভর্তি ব্যাগ, পরিশ্রান্ত মুখে গুড়িগুড়ি ঘাম।  মাঝেমাঝে উনি তাদের অফিসে ভিজিট করতে আসেন। একটু বদরাগী ধরনের মানুষ, মুখে যা আসে উনি তাই বলে থাকেন। সুখীলালকেও অনি অফিস ভিজিটে এসে কয়েকবারই বলেছেন, একটা কাজ করতে এতোদিন লাগে, চাকরিটা ছেড়ে দিন মশাই। আপনার থেকে অনেক কম বেতনে নতুন ছেলে পাওয়া যাবে। সেসময় জবাবে সুখীলাল কিছুই বলেনি, নেহাত বস বলে। আজ বসকে সামনে দেখে সুখীলাল বলে, নমস্কার স্যার।

বস দু’টো ব্যাগকে দু’হাতে একটু উঠিয়ে যেন প্রত্যুত্তরের ভাব করেন। সুখীলাল আবার বলে, ভালো আছেন তো স্যার ? কিন্তু আশ্চর্য, সুখীলালের মুখ থেকে তার বলা কথাগুলি বেরিয়ে না এসে অন্য কথা বেরিয়ে আসে, “মজা লাগে তো স্যার ?”
ব্যস, আর যায় কোথায়। বস কটমট করে সুখীলালের দিকে চেয়ে বলেন, মস্করা হচ্ছে ? দাঁড়াও, তোমাকে সোমবারে মজা দেখাব।

সোমবার দিনটি আসে। অফিসে যায় সুখীলাল; প্রস্তুত থাকে, আজ জানি কী কী ব্যাপার ঘটতে থাকবে। দুপুরের আগেই তার ট্র্যান্সফার অর্ডার চলে আসে। এক মফসসল শহরে তাকে ট্র্যন্সফার করা হয়েছে। কালীদাও খুব খুশি। সবাই ভাবে, কালীদার কারসাজিতেই সুখীলালের এই ট্র্যান্সফার। ফলে কালীদার খুঁটি আরো শক্ত হয়।

সুখীলাল নতুন কর্মস্থলে চলে যায়। কিন্তু তার ড্যামো ব্যাপারটা মোটেই কমেনি। রাত দুপুরের কোনো রংমশালে আবাহন মুখীনতার উল্লাস ছাড়িয়ে যে নিনাদ হাওয়ায় ভাসে তাকে বোঝার চেষ্টায় সে মুখর থেকেছে।
সে বেশ বুঝে গেছে, ড্যামো ব্যাপারটা মোটেই অপরাধ নয়। শুধু ঝোপ বুঝে কোপ দিতে হয়।