মণিপুরের চারটি অনুগল্প
আই এস কাঙজম
(মূল মণিপুরি থেকে অনুবাদঃ সদানন্দ সিংহ)
নর্তকী
নাচ-গানের এক বিরাট অনুষ্ঠানে চীফ গেস্ট ছিলেন অচৌবাবু। সে অনুষ্ঠানে নাচ-গানের কলাকারদের প্রশস্তি গেয়ে এক জ্বালাময়ী ভাষণ রাখেন তিনি। জাতি এবং দেশের অন্যতম সম্পদ বলে কলাকারদের উল্লেখ করেন।
সেই অনুষ্ঠানে অচৌবাবুর সঙ্গী ছিলেন তার গিন্নি এবং ছোট মেয়ে। বাবার জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পর ছোট মেয়েটি বাবাকে বলল যে সেও নাচ শিখতে আগ্রহী। শুনে অচৌবাবু খুব রেগে মেয়েকে বললেন, ছিঃ তোমার মত আপার ক্লাসের মেয়েরা কী নাচ শেখে?
যাত্রী
দরজাটা আস্তে খুলে বেরিয়ে এলো। বাইরে অমাবস্যার অন্ধকার রাত। নুংবান ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগলো। তার জীবনের কোনো মনোবাসনাই তো আর পূর্ণ হল না, তাই সে মৃত্যুর জন্যে আজ প্রস্তুত। যেতে যেতে তার জীবনের চাওয়া-পাওয়া সুখ-দুঃখের কথা একের পর এক মনে পড়তে থাকে। এইসব চিন্তা করতে করতে একসময় মৃত্যুর কথা ভুলে যায় সে। সেই সময় হঠাৎ অন্ধকারে হোঁচট খায়, নিচে উপুড় হয়ে পড়ে যায়। উঠতে গিয়ে আপন মনে বলে ওঠে, ইস, এখুনি মারা যাচ্ছিলাম; বড় বেঁচে গেছি।
বিধি বাম
এদিকে নিজের দলের সরকারটা পড়ে যায় যায় অবস্থা; ওদিকে বাড়িতে তার বাপটার অসুখ দিনের পর দিন যেন বেড়েই চলেছে। সে ভাবে, বাপটা মরলে যেন সরকার ভেঙে যাবার আগেই মরুক। ক্ষমতা থাকতে, সঙ্গীসাথী থাকতে এমন হলে খুব ভালো হয়।
কিন্তু তার কপালটাই খারাপ। সরকারের পতন হয়। তল্পিতল্পা গুছিয়ে সেও সরে পড়ে। তিনদিন পর তার বাবাও মারা যায়। মৃত বাপটার ওপর ভীষণ অখুশি সে। বলতে থাকে, এক মাস আগে মারা যেতে পারলে না? তাহলে সরকারে থাকতেই শ্রাদ্ধ-শান্তি সব চুকে যেতো।
সংগ্রাম
ভোরের আলো ফুটে ওঠা মাত্র সে দৌড়ে বাসস্ট্যাণ্ডে চলে এসেছিল। তারপর কোনো বাস দেখা মাত্র দৌড়ে সে বাসে ওঠার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অন্য লোকেরা “এই ছেলে, সরে যা। তুই ঊঠতেই পারবিনা” বলে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের বস্তা-পুঁটলি সহ বাসে উঠে পড়ছিল। নিজেদের মালপত্র নিয়ে উঠলেও কোনো ব্যবসায়ীই তাকে বাসে উঠতে দিচ্ছিল না। তার মালপত্রগুলিকে সবাই আটকে দিচ্ছিল।
দিনের শেষে ব্যর্থ হয়ে সে বস্তা-পুঁটলি মাথায় বাড়ি ফিরে আসে। বিছানায় অসুস্থ তোম্বিবিবি কাতরাতে কাতরাতে ছেলের বিষণ্ণ মুখটাকে দেখে সব বুঝতে পারে। ও আগেই বুঝেছিল ওরকম হবে তাই তার দশ বছরের ছেলেকে সে যেতে অনেক মানা করেছিল। কিন্তু গতকাল থেকে অভুক্ত ছেলে মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে শহরের দিকে রওনা হয়েছিল।
লুকিয়ে চোখের জল মোছে তোম্বিবিবি। লুকিয়ে ছেলেও চোখের জল মোছে।
ব্যাপারটা কিন্তু দুজনেই দুজনকে লক্ষ করে; কিন্তু এমন ভাব করে যেন কেউ কাউকে দেখেনি।
HOME
এই লেখাটা শেয়ার করুন