গল্প, ছোটোগল্প এবং অনুগল্প – সদানন্দ সিংহ

গল্প, ছোটোগল্প এবং অনুগল্প

সদানন্দ সিংহ

 

 

গল্পের উৎপত্তিঃ-

গল্পকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন সাহিত্য। অবশ্য সেগুলি লিখিত আকারে ছিল না। সেগুলি প্রচলিত ছিল মুখে মুখে এবং হাজার হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মে রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা এবং লোককাহিনির মাধ্যমে। এমন কি এগুলি প্রসার লাভ ঘটেছিল লোকোৎসবের নাচ-গানের মাধ্যমেও। পরবর্তীকালে গল্প বলার মাধ্যম হিসেবে প্রবেশ করেছিল পুরাণ কথা, আখ্যান-উপাখ্যান, ধর্মকথা ইত্যাদিতে।

কিন্তু গল্প পৃথিবীতে এসেছিল কত বছর আগে থেকে? এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দেশের রূপকথা, উপকথা, লোককাহিনিগুলি বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মৌখিক গল্পগুলি দশহাজার বছরের পুরানো এবং দক্ষিণ আফ্রিকার খোইসান উপজাতিদের মৌখিক গল্পগুলিও প্রায় সমসাময়িক।

আর্য আগমনের ফলে উদ্ভূত ভারতের বৈদিক ঐতিহ্য যদি ৩৫০০ বছরের পুরোনো হয় তবে তারও আগে থেকেই ভারতের মূল অধিবাসী অনার্যদের জীবনেও অনেক মৌখিক গল্প বর্তমান ছিল যা এখনো বিভিন্ন রূপকথা, উপকথা এবং লোককাহিনির মাধ্যমে ছড়িয়ে আছে। মণিপুরিদের ‘লাইহারাওবা’ উৎসবে যে নৃত্য, গান এবং অভিনয় হয় তার সবগুলিই এক মৌখিক গল্প যা নৃত্য-গান-অভিনয়ের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করা হয়ে থাকে এবং এগুলি চলে এসেছে খৃষ্টপূর্ব বহু শতাব্দী আগে থাকে। কারণ নাচ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা বলেন লাইহারাওবা নৃত্যের মুদ্রাগুলি খৃষ্টপূর্ব বহু শতক আগের।

ভারতে বৈদিক ঐতিহ্যের সময়গুলিকে যদি আমরা লিখিত আকারের উৎপত্তি বলে ধরে নিই, তাহলেও দেখা যায় ভারতবর্ষে এটা এসেছে প্রাচীন মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যে লিখিত আকার আসার অনেক শতাব্দী পর। খৃষ্টপূর্ব ১০০ – ৫০০ শতাব্দীর মধ্যে লিখিত ভারতে প্রকৃত গল্পের একটা রূপরেখার দেখা শুরু হয়েছিল পালি ভাষায় লিখিত বুদ্ধের জাতক কাহিনিগুলির মধ্য দিয়ে এবং পঞ্চতন্ত্র-এর কাহিনিগুলির মধ্য দিয়েই।

বিস্তৃতি অনুসারে গল্পের বিভাগ এবং ব্যাখ্যাঃ-

বিস্তৃতি অনুসারে গল্প, ছোটোগল্প এবং অনুগল্প এই তিন ভাগে এখন গল্পকে ভাগ করা হয়। কেউ কেউ আবার ‘গল্প’ শব্দটির পরিবর্তে ‘বড় গল্প’ ব্যবহার করেন।

গল্পকে বলা হয় কোনো বাস্তব বা কল্পিত ঘটনার বর্ণিত আখ্যান যা লিখিত বা কথ্য ভাষার মাধ্যমে, চিত্রকল্পের মাধ্যমে, নাচ-গান বা অন্য কোনো শারীরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। তবে এখানে যেহেতু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হবে তাই গল্প বলতে গল্পের লিখিত রূপের কথাই বলা হচ্ছে বলে ধরে নেয়া হবে।

আর ছোটোগল্পের তো কোনো নির্ধারিত সংজ্ঞা নেই। বিভিন্ন জন ছোটোগল্পকে বিভিন্নভাবে ছোটোগল্পকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। লেখক এডগার অ্যালান পো বলেছেন যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটোগল্প বলে। লেখক হারবার্ট জর্জ ওয়েলসের মতে ছোটোগল্প সাধারণত ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সমালোচক উইলিয়াম হেনরি হাডসনের মতে, “A Short story must contain one and only to its logical conclusion with absolute singleness of Method.” এইচ. জি. ওয়েলস বলেন, “A short story is, or should be, a simple thing, it aims at producing a single vivid effect; it has to seize the attention at the on set, and never relaring, gather it together more and more until the climax is reached.” অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী, “a description of events and people that the writer or speaker has invented in order to entertain people” আবার ব্রিটানিকা ডিকশনারি অনুযায়ী, “a description of how something happened”

তবে গল্প আর ছোটোগল্পের মধ্যে পার্থক্য আছে। গল্প ও ছোটোগল্প – দুটোতেই চরিত্রের সংখ্যা খুব কম থাকলেও গল্প বা বড় গল্পে সেই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে যে সময়, বর্ণনা, ইতিহাস, পটভূমি ইত্যাদি তৈরি করা দরকার তার স্বাধীনতা লেখকের থাকে, এবং গল্পের শেষেও লেখকের ইচ্ছানুযায়ী বক্তব্য প্রকাশ না করা পর্যন্ত গল্প এগিয়ে নিতে পারেন। ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সেখানে একটি বা দুটি চরিত্র নিয়ে বা নামহীন চরিত্র নিয়ে প্লটযুক্ত বা প্লটহীন আখ্যানকে বিশেষ রীতি ও লেখকের শৈলীর নিপুণ প্রয়োগে সংক্ষিপ্ত রূপের সম্ভার নিয়ে পরিণতিতে গতানুগতিক গল্প বা জীবনকে আঘাত করবে যার ফলে পাঠকের কাছে গল্পের মর্মোদ্ধার করার বা নতুন কিছু চিন্তার দরকার হয়ে পড়বে।

এবার আসি অনুগল্পে। গল্পের সর্বাধুনিক রূপ হল অনুগল্প। অনেকেই এখানে বানান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন – অনুগল্প না হয়ে অণুগল্প হবে। এ যেন ‘গরু’-র বানান কেনো শুদ্ধ করে ‘গোরু’ লেখা হবে না।

অনুগল্পকে ইংরেজিতে Flash Story বলা হয়ে থাকে। ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে মাত্র এক ঝিলিক। কিন্তু অন্ধকারের মাঝে ঐ এক ঝিলিকেই কাছাকাছির সমস্ত কিছু স্পষ্টভাবে দেখা হয়ে যায় এবং ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়। আবার কেউ কেউ ফ্ল্যাশ স্টোরিকে ‘Short Short Story’ অর্থাৎ ছোটোগল্পের ছোটো রূপ হিসেবে উল্লেখ করেন। অনুগল্পেরও কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে অনুগল্প বা Flash Story কিছু উপবিভাগ আছে যা নিচে উল্লেখ করা হলঃ-

১) Six-word story অর্থাৎ ছয় শব্দের গল্প।
২) Minisaga or Dribble – 50 words অর্থাৎ ৫০ শব্দের গল্প।
৩) Microstory or Drabble – 100 words অর্থাৎ ১০০ শব্দের গল্প।
৪) Twitterature- 280 words অর্থাৎ ২৮০ শব্দের গল্প।
৫) Sudden fiction- 750 words অর্থাৎ ৭৫০ শব্দের গল্প।
পরবর্তীকালে যোগ হয়েছে চার লাইনের গল্প, দশ লাইনের গল্প ইত্যাদি। অপরদিকে মার্কিন লেখিকা লিডিয়া ডেভিস বলেন যে অনুগল্প হল ৫ থেকে ২০০০ শব্দের মধ্যে রচিত গল্প যেখানে প্লট এবং চরিত্র বিকাশের অভাব রয়েছে এবং প্রায়শই ভাগ্যের ট্যুইস্ট বা মোচড় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। অনুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছিলেন লিডিয়া ডেভিস। তাঁর লেখা অনুগল্পগুলির বিস্তৃতি এক লাইন থেকে তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ‘অণুগল্প’ হচ্ছে ‘অনুগল্প’-এর এক উপবিভাগ। ১০০ শব্দের মধ্যে লেখা গল্পকে আমরা অনায়াসেই অণুগল্প বলতে পারি। তাই অনুগল্পের বানান কী হবে তা নিয়ে তর্কের কোনো মানে হয় না।

আর ৫ থেকে ২০০০ শব্দের মধ্যে একটা গল্প লিখলেই তা অনুগল্প হয়ে যাবে তা নয়। অনুগল্পের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন – (এক) সংক্ষিপ্ততা এর প্রধান বৈশিষ্ট্য, বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত, স্বল্প পরিসরে এক বিরাট ভাবনার উন্মোচন। (দুই) গল্পে প্লট থাকতে পারে, যদি থাকে তবে তার আরম্ভ, মধ্য এবং শেষ পর্যায় থাকতে পারে। (তিন) গল্পে প্লট নাও থাকতে পারে। যদি না থাকে তবে তা হবে গদ্য কবিতার অনুভূতি নিয়ে আবেগ, স্মৃতি ও চিন্তার এক অন্বেষণ কিংবা তার এক অপূর্ব স্কেচ। (চার) এক-দু’টি চরিত্র নিয়ে ডালপালাহীন ভাবে গল্পটা এগিয়ে যাবে এবং অনেক কিছুই অব্যক্ত থাকবে। (পাঁচ) গল্পের শেষের দিকে থাকবে এক ট্যুইস্ট বা মোচড় যার উদ্দেশ্য হল পাঠকদের গল্পের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

সংক্ষেপে বলা যায়, গল্প বা বড়গল্প হল সেই গল্প যেখানে লেখক কী বলতে চাইছেন সব কিছুই ব্যক্ত করে দেন, যার ফলে পাঠককে নতুন করে কিছুই ভাবতে হয় না, ফলে বেশির ভাগ পাঠকের সেই গল্প ভালো লেগে যায়। আর ছোটোগল্প হচ্ছে সেই গল্প যেখানে লেখক কী বলতে চাইছেন তা ব্যক্ত করেন না, কিন্তু গল্পপাঠের পর পাঠকেরা বুঝতে পারেন গল্পের উদ্দেশ্য কী ? আর অনুগল্প হচ্ছে গল্পের এক ঝলক,  ফ্ল্যাশ আলোর মতো যেখানে লেখক কিছুই ব্যক্ত করেন না, বরং পাঠককেই চিন্তা করতে হয় গল্পের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে। উদাহারণ স্বরূপ বলা যায় ছয় শব্দের ‘বেবি স্যু’ নামক অনুগল্পটি — “For sale. Baby shoes. Never worn”. 

গল্পের কাঠামোঃ-

কিছুদিন আগে Robert Waldvogel-এর লেখা The Structure of a Story পড়ছিলাম। The Structure of a Story প্রবন্ধে গল্পের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে গল্পগুলি যদি গ্রাফিকভাবে চিত্রিত করা হয় তবে ধনুক থেকে নিক্ষেপ করা তিরগুলির অবস্থা অনেকটা বৃত্তের মতো। যদি এগুলি আকাশের দিকে নিক্ষেপ করা হয়, একটি অ্যাপোজি বা সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায় এবং তারপরে তীব্রভাবে বক্ররেখা হয় কারণ মাধ্যাকর্ষণ তাদের মাটিতে ফিরে আসে। বৃত্তরেখার প্রথম অংশটিকে একটি গল্পের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বা সাসপেন্সের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, এর চূড়াটিকে এর ক্লাইম্যাক্স বা টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং এর পতন হল এর রেজোলিউশন বা ডিনোইমেন্ট, যেখানে সমস্ত আলগা প্রান্তগুলি বেঁধে দেওয়া হয় এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়।

তাই তিনি বলেছেন ছোটোগল্প, বড়গল্প বা উপন্যাসের কাঠামো এভাবে একটা রেখার মাধ্যমে এগিয়ে পরপর আটটি অবস্থানের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন কোনো গল্প বা উপন্যাসে এই আট ধরনের অবস্থানের সবগুলি নাও থাকতে পারে। অবস্থানগুলি হচ্ছেঃ- Stasis, Trigger, The quest, Twists, Critical decisions, Climax, Reversal, Resolution।

এই অবস্থানগুলিকে গল্পের এক-একটা স্তম্ভও বলা যেতে পারে। এই অবস্থানগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। 

স্ট্যাসিস (Stasis)
কোনো গল্পের স্ট্যাসিসকে বাংলায় গল্পের স্থিতিশীলতা বা স্বাভাবিকতার প্রথম অবস্থান বা প্রারম্ভ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। চরিত্রই গল্পের বা উপন্যাসের মূল ভিত্তি। তাই লেখককে গল্প বা উপন্যাসের মূল চরিত্র বা চরিত্রদের জন্য দৈনন্দিন বাস্তবতার ভিত্তিরেখা তৈরি করতে হবে। গল্প-উপন্যাসের শৈলীর ওপর নির্ভর করে এটা সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ হতে পারে। দীর্ঘ হলে পাঠকরা যাতে বিরক্ত না হন সেজন্যে ফ্লাশব্যাক ব্যবহার করে আকর্ষণীয় করতে হবে।

স্ট্যাসিস দীর্ঘ হলে অনেক সময় পাঠক গল্পের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন না। সেজন্য লেখকের শক্তিশালী লেখনীশৈলীর প্রয়োজন, তাই ফ্লাশব্যাকে চক্রান্ত কিংবা বর্তমান দৈনন্দিন জীবনকে অদ্ভুত কিছু প্রদর্শন করার মাধ্যমে গল্পকে এগিয়ে নিতে হবে।

ট্রিগার (Trigger)
বন্দুকের ভেতর যে গুলি থাকে সেটা গতিশীল হয় ট্রিগারে চাপ দিলে। ঠিক সেভাবে গল্পের স্থিতিশীল বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে গল্পকে গতিশীল অবস্থায় আনতে হবে এই পর্যায়ে। তাই ট্রিগারকে উত্তেজক ইভেন্ট হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে যাতে গল্পের স্থবিরতা ভেঙে দিয়ে চরিত্র বা চরিত্রগুলি গল্পের প্লট বা মূল ঘটনার অংশ হয়ে ওঠে।

ট্রিগারগুলি কোনো হত্যা বা বিস্ফোরণ ইত্যাদি বড় ঘটনা হতে পারে, কিংবা প্রায় তুচ্ছ যেমন একটি কথোপকথন ইত্যাদি হতে পারে। এগুলি আবার ইতিবাচক বা নেতিবাচক, লক্ষিত বা অলক্ষিত, হঠাৎ বা ধীরে ধীরে, ছোট বা দীর্ঘ হতে পারে।

ট্রিগারের মূল উদ্দেশ্য হল গল্পে পরিবর্তনের স্ফুলিঙ্গ বা চক্রান্তের সূচনা করা।

অনুসন্ধান (The quest)
ট্রিগার থেকে উদ্ভূত হবার পরে গল্পের মূল চরিত্র বা উপন্যাসের নায়কের উদ্দেশ্যগুলি কী হতে পারে তা দেখাতে গিয়েই অনুসন্ধান-এর বিবেচনা করা হয়। আদর্শভাবে, এটি গল্পে বা উপন্যাসের বেশিরভাগ অংশ দখল করা উচিত।
এই পর্যায়ে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে যা হয়তো গল্পের মূল চরিত্ররা যে লজিকে বিশ্বাস করে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ভিলেনের মতো লোকের আবির্ভাবও হতে পারে। এইসবের মাঝে গল্পের মূল চরিত্ররা তাদের স্ট্যাসিস-এ ফিরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাবে অনুসন্ধান বা খোঁজ অবস্থানে। তাই এই পর্যায়ে মূল চরিত্রের রূপান্তরও হতে পারে। যা আসলে ব্যক্তিগত বা সামাজিক বেঁচে থাকার লড়াই ছাড়া কিছুই নয়।

মোচড় (Twists)
গল্পে মোচড় থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। কিন্তু গল্পে মোচড় বা চমক যদি না থাকে তাহলে সেটা একদম ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যায় যদি না শক্তিশালী ভাষাশৈলী দিয়ে গল্প তৈরি না করা হয়। গল্পের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োগ করলে এতে পাঠকের আগ্রহ বাড়ে এবং গল্পের চরিত্র বিকাশের সুযোগ হয়।
কিন্তু মোচড়টাকে দুর্বোধ্য করা উচিত নয়, এটাকে সহজ, সরল ও বোধগম্য হতে হবে। আর মোচড় হতে হবে অপ্রত্যাশিত।

গুরুত্বপূর্ণ বা সমালোচনামূলক সিদ্ধান্ত (Critical decisions)
মাঝে মাঝে গল্পকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে গল্পের চরিত্রগুলিকে কঠিন গুরুত্বপূর্ণ বা সমালোচনামূলক সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয়, যেমন তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে তার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া বা ফিরে যাওয়া উচিত।
সমালোচনামূলক সিদ্ধান্তগুলি একটি অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরিহার্য উপাদান এবং এতে পথের অন্যদের সাহায্য করতে বা খারাপ বাধাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিরতির মতো কারণগুলি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত, যদিও এগুলি রূপান্তরমূলকও হতে পারে, ব্যক্তিকে পরিবর্তন করতে পারে, যেমন যখন একজন কাপুরুষ সাহসীভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংগ্রাম দেখানো এবং স্বাধীন ইচ্ছার অনুশীলন গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তবে সমালোচনামূলক সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই গল্পের মাধ্যমে তৈরি হয়, প্রতিটি আগেরটির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ক্লাইম্যাক্স (Climax)
একটি গল্পের ক্লাইম্যাক্স ঘটে যখন অনুসন্ধান, মোচড় এবং সমালোচনামূলক সিদ্ধান্তগুলির মাধ্যমে নির্মিত হয়ে গল্পের সবচেয়ে উচ্চতর পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায়। এটি এমন একটি বিন্দু যেখানে উত্তেজনা সমাধান করতে হবে। এটি প্লটের চূড়ান্ত উত্তেজনা তৈরি করে, দ্বন্দ্ব অথবা উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায়, গল্পের মূল চরিত্র অজানার সাথে দেখা করতে বাধ্য করে গল্পের সমস্ত দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বিন্দুতে উপনীত হয়ে।

গল্প-উপন্যাসের মধ্যে অনেকগুলি প্রধান এবং অপ্রধান ক্লাইম্যাক্স থাকতে পারে, যা সমাধানের কাছাকাছি বা শেষের দিকে নিয়ে যায়। যদিও ছোট বা অপ্রধান ক্লাইম্যাক্সগুলি ছোটখাটো টেনসনের সমাধান করে এবং প্রধান ক্লাইম্যাক্সে বড় রকমের টেনসন, অন্তর্নিহিত টেনসন ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করা হয়। ক্লাইম্যাক্সের এই সিকোয়েন্সের মাধ্যমেই এক-একটা গল্পের স্তম্ভ তৈরি হয়।

রিভার্সাল (Reversal)
রিভার্সাল এমনই একটা অবস্থান যেখানে গল্পের প্রধান চরিত্র বা চরিত্ররা স্ট্যাসিস, ট্রিগার, অনুসন্ধান, মোচড়, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, ক্লাইম্যাক্স ইত্যাদি পর্যায়গুলিতে বাধা এবং প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও সমস্ত পর্যায়গুলি একত্রিত করতে সক্ষম হয়, নিজেকে না পাল্টে আগের মতই থাকে; ফলে কোনো আকর্ষণ ও ব্যক্তিত্ব না হারিয়ে চরিত্রগুলি এক-একজন নায়ক হয়ে ওঠে। আবার গল্পের কারণে যদি চরিত্রগুলির রূপান্তর ঘটে তবে তার রূপান্তরটা যেন যৌক্তিকতাপূর্ণএবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

রেজোলিউশন (Resolution)
রেজোলিউশনকে বলা যেতে পারে গল্পের চূড়ান্ত পরিণতি বা সমাধান। এতে কোনো গল্পের শেষে এক নতুন স্ট্যাসিস বা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। আর এই নতুন স্ট্যাসিস যেন প্রথম যে স্ট্যাসিস ছিল তার ঊর্ধ্বে চলে যায় তারই চেষ্টা করা হয়। এজন্যে মূল চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতার পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্রগুলির বড় ভূমিকা থাকে। হয়তো এক নতুন ট্রিগারের ইঙ্গিতও থাকতে পারে যা নিয়ে বিদগ্ধ পাঠকেরা ভাবতে বাধ্য হবেন।

উপরোক্ত গল্পের কাঠামো বা স্তম্ভের পর্যালোচনাঃ-

উপরোক্ত গল্পের আট কাঠামোগুলি খুব সুন্দরভাবে ক্রমপর্যায়ে বর্ণিত, কিন্তু এগুলি গল্পের জন্যে যতটুকু না দরকার তার চেয়েও বেশি দরকার উপন্যাসের জন্যে, এবং এর সবগুলি অনুসরণ করে একটা ভাল উপন্যাস লেখা যেতে পারে। হয়তো কিছু কিছু কাঠামো বাদ দিয়েও একটা নভেলেট বা বড় গল্প লেখা যেতে পারে। কিন্তু ছোটোগল্প এবং অনুগল্প লেখার জন্য সবগুলি কাঠামোর দরকারই নেই। শুধুমাত্র স্ট্যাসিস, ট্রিগার এবং ট্যুইস্ট দিয়ে একটা ছোটোগল্প ও অনুগল্প লেখা যেতে পারে বা শুধু ট্রিগার এবং ট্যুইস্ট দিয়ে একটা অনুগল্প লেখা যেতে পারে। তবে গল্প লিখতে বা আলোচনা করতে এই কাঠামোগুলির অবস্থান জানা থাকলে ভালো হয়।

উপসংহারঃ-

বিষয়বস্তু হিসেবে গল্পের উপাদান অনেক — অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার, জীবনী, কমেডি, অপরাধ, গোয়েন্দা, ডিস্টোপিয়া, উপকথা, ফ্যান্টাসি, ইতিহাস, হরর, রহস্য, দর্শন, রাজনীতি, রোম্যান্স, ব্যঙ্গ, বিজ্ঞান, কথাসাহিত্য, অতিপ্রাকৃত, থ্রিলার, ট্র্যাজেডি প্রেম, ভৌতিক ইত্যাদি। হতে পারে গল্পগুলি বাস্তবভিত্তিক, কল্পনাভিত্তিক বা পরাবাস্তবভিত্তিক। সেখানে আসতে পারে Modernism, Postmodernism, Minimalism অথবা Magical realism যা কিনা বাস্তববাদী আখ্যানে surrealism, dreams, fantasy-র সমন্বয়। কিন্তূ প্রশ্ন হছে ভৌতিক বা হরর গল্প থেকে শুরু করে জীবনভিত্তিক লেখা সমস্ত গল্পগুলি কি সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে? এক কথায় উত্তর, না। যে লেখায় মানব ও সমাজ জীবনের দর্পণ হয়ে চিরন্তন সত্যের মাঝে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আবেগ-অনুভূতি ও সৌন্দর্যের সমন্বয়ে জীবন প্রবাহের যে অপরূপ শিল্প তৈরি হয়, সেই লেখাকেই সাহিত্য বলা যেতে পারে। সেই গল্পটা হতে পারে জীবন ভিত্তিক বা রহস্য গল্প ভিত্তিক বা অন্য কোন ভিত্তিক। আর সে শিল্পের সৃষ্টিটাও হওয়া উচিত মানব কল্যাণের জন্যেই এক পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যেখানে নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গির কোনো মূল্য না রাখাই উচিত।