ডিজিটাল কয়েন – সদানন্দ সিংহ

ডিজিটাল কয়েন

সদানন্দ সিংহ

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি, ডিজিটাল কয়েন কি – এইসব প্রশ্ন যখন সামনে আসে তখন পাশাপাশি আরেকটা প্রশ্ন এসে পড়ে, সেটা হল বিটকয়েন কি। কারণ বিটকয়েনের নাম এখন বেশির ভাগ লোকই জানে, কিন্তু সেটা কি এবং কীভাবে সেটা কাজ করে – এটা অনেকেই জানেন না। সোজা কথায় বলা যায়,
ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক বেসরকারিভাবে উদ্ভূত ডিজিটাল ভার্চুয়াল মুদ্রা কিংবা মুদ্রার মতন সম্পদ যা কম্পিউটারের নেটওয়ার্কের সাহায্যে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এক ব্যক্তির একাউন্ট থেকে আরেক ব্যক্তির একাউন্টে চলে যায় এবং এখানে যে ট্র্যানজেকশন হয় তা কোনো জায়গায় কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে না অর্থাৎ ক্রিপ্টোকারেন্সির কোনো সরকারি বা ব্যাঙ্কের মতো কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক নেই। ডিসেন্ট্রালাইজড বা বিকেন্দ্রীয়ভাবে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ট্র্যানজেকশনের ভেরিফিকেশন হওয়ার পর সুরক্ষিতভাবে ডিজিটাল মুদ্রা স্থানান্তরিত হয় যেখানে ব্যাঙ্কের মত কোনো মধ্যস্থতাকারী থাকে না।
এই বিট কয়েনের উৎপত্তির প্রধান কারণ হচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অসন্তোষ। প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় যেমন ডলারের গ্রহণযোগ্যতার কথা বাদ দিলে এক কোনো দেশের মুদ্রা সমস্ত পৃথিবীব্যাপী অর্থাৎ সব দেশে ব্যবহার করা যায় না। যেমন উগান্ডা বা পাকিস্তানের মুদ্রা ভারতে অচল। এছাড়া আছে বিভিন্ন সরকারি নিয়মকানুনের বেড়াজাল। বিট কয়েন এবং অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রাগুলি বাধাহীনভাবে এক ব্যক্তি থেকে অন্যের কাছে হস্তান্তর হয়ে যায়।
বিটকয়েনই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম ডিজিটাল মুদ্রা। এটা প্রথম চালু হয়েছিল ২০০৯ সালে। চালু হওয়ার প্রথম দিনগুলিতে নাকি আমেরিকায় একটা পিৎজা কিনতে কয়েক হাজার বিটকয়েন ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়া চালু হওয়ার দিনগুলিতে নাকি ফ্রী-তে বিট কয়েন অনেককে এয়ার ড্রপ করা হয়েছিল লোকজনের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য। পরে ২০১৮ সালের দিকে একটা বিটকয়েনের মূল্য ৬০০০ আমেরিকান ডলার হবার পর ২০২১ সালে সেটা বেড়ে ৬৫০০০ আমেরিকান ডলার হয়। আর এখন জানুয়ারি ২০২৩ সালে এক বিটকয়েনের মূল্য ১৬৭০০ আমেরিকান ডলার যা ভারতীয় মুদ্রায় ১৩৭৮০০০ টাকা। এই বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি লাখ লাখ লোককে কোটিপতি বানিয়ে দিয়েছিল।
মূলত ব্লকচেইন প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই বিটকয়েন এবং অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রাগুলির উদ্ভব হয়েছে। আর এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি তৈরি করেছিল একজন জাপানি, নাম সতোশি নাকামোটো। সতোশি নাকামোটো হয়তো একজন ডেভেলপার বা ডেভেলপারদের গ্রুপ যারা এই ব্লকচেন টেকনোলোজি উদ্ভাবন করেছিল। বিটকয়েনের এই সাফল্য দেখে পরে আরো অনেক ডিজিটাল মুদ্রার উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেটে প্রচলিত ডিজিটাল কয়েন, অল্ট কয়েন এবং টোকেন মিলিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির সংখ্যা নয় হাজারের ওপর।
ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির ভেতর বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। একসময় পৃথিবীর প্রচুর নামিদামি কোম্পানিগুলি তাদের কর্মীদের বেতন বিটকয়েনের মাধ্যমে দিয়েছে। গাড়ি-বাড়ি সহ অনেককিছুর বিনিময়ের মাধ্যম বিটকয়েনে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। বিটকয়েন বিনিময়ের এটিএম ব্যবহার করে এনক্যাশ করার ব্যবস্থা অনেক দেশে চালু আছে। বিটকয়েনের মতো আরো কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেছে, যেগুলি হল ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন, রিপল, ডজকয়েন, ড্যাশ ইত্যাদি যেগুলিকে ডিজিটাল কয়েন হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যদিও এদের মূল্য বিটকয়েনের তুলনায় অনেক কম। বাকি ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলিকে অলট কয়েন এবং টোকেন নামে অভিহিত করা হয়। বর্তমান এক ইথেরিয়ামের মূল্য ১২৬১ আমেরিকান ডলার, এক লাইটকয়েনের মূল্য ৭৫ আমেরিকান ডলার, এক রিপলের মূল্য ০.৩৪ আমেরিকান ডলার, এক ডজকয়েনের ০.০৭ মূল্য আমেরিকান ডলার এবং এক ড্যাশকয়েনের মূল্য ৪৫ আমেরিকান ডলার। অনেকটা স্টক এক্সচেঞ্জের মত বাজারের উত্থান পতনের সাথে সাথে এই ডিজিটাল কয়েন, অলট কয়েন এবং টোকেনগুলির মূল্য ওঠানামা করে।
টোকেন এবং কয়েন-এর মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা হল কয়েনগুলির নিজস্ব ব্লকচেইন টেকনোলোজি বর্তমান। আর টোকেনগুলির নিজস্ব ব্লকচেইন টেকনোলোজি নেই, বরং টোকেনগুলি অন্য কয়েনের ব্লকচেইন টেকনোলোজি ব্যবহার করেই টোকেন রিলিজ করে।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে ব্লকচেইন টেকনোলোজি ব্যাপারটা কী? আসলে এই প্রযুক্তি নিয়ে সহজ ভাষায় বলতে গেলে এইটুকু বলা যায় ব্লকচেইন হল এক ধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলজি যাতে ক্রমবর্ধমান রেকর্ডের তালিকা থাকে, যাকে ব্লক বলা হয়, যেগুলোকে ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে নিরাপদে একত্রে সংযুক্ত করা হয়। প্রতিটি ব্লকে পূর্ববর্তী ব্লকের একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ, একটি টাইমস্ট্যাম্প এবং লেনদেনের ডেটা থাকে যেটা সাধারণত একটি মার্কেল ট্রি হিসাবে উপস্থাপিত করা হয় এবং ডেটা নোডগুলি পাতা দ্বারা উপস্থাপিত করা হয়। টাইমস্ট্যাম্প প্রমাণ করে যে ব্লক তৈরি করার সময় লেনদেনের ডেটা বিদ্যমান ছিল। যেহেতু প্রতিটি ব্লকে পূর্ববর্তী ব্লক সম্পর্কে তথ্য রয়েছে, তাই তারা কার্যকরভাবে একটি চেইন তৈরি করে, প্রতিটি অতিরিক্ত ব্লক তার আগের ব্লকের সাথে লিঙ্ক করে। ফলস্বরূপ, ব্লকচেইন লেনদেনগুলি অপরিবর্তনীয় যে, একবার সেগুলি রেকর্ড করা হলে, পরবর্তী সমস্ত ব্লকগুলিকে পরিবর্তন না করে যেকোন প্রদত্ত ব্লকের ডেটা পূর্ববর্তীভাবে পরিবর্তন করা যায় না। ব্লকচেইনগুলি সাধারণত একটি পিয়ার-টু-পিয়ার কম্পিউটার নেটওয়ার্ক দ্বারা একটি পাবলিক ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার হিসাবে ব্যবহারের জন্য পরিচালিত হয়, যেখানে নোডগুলি সম্মিলিতভাবে নতুন লেনদেন ব্লক যুক্ত এবং যাচাই করার জন্য একটি ঐক্যমত্য অ্যালগরিদম প্রোটোকল মেনে চলে।
শেয়ার মার্কেটের যেমন স্টক এক্সচেঞ্জ আছে, তেমনি ক্রিপ্টো মার্কেটেরও এক্সচেঞ্জ আছে। শেয়ার মার্কেটের মত ডিজিটাল কয়েনের মূল্যও মুহূর্তে মুহূর্তে ওঠানামা করে। অবশ্য শেয়ার মার্কেট খোলা থাকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, অফিস বন্ধের দিনগুলিতেও শেয়ার মার্কেট বন্ধ থাকে। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেট বছরের সব দিনই খোলা থাকে। তবে উড়ো খবর, ভাল-খারাপ খবর, চাহিদা-যোগান, মার্কেট অপারেটরদের কিছু কারসাজি – ইত্যাদির ফলে যেমন স্টক মার্কেট ওঠানামা করে তেমনি ঐ একই কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেটও ওঠানামা করে। তবে এই দুই মার্কেটের মধ্যে একটা আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। শেয়ারগুলি হচ্ছে একটা আইনগত হস্তান্তরযোগ্য সম্পদ, যেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি হচ্ছে এক ভার্চুয়াল কয়েন যার আইনহীন এক বর্তমান ভার্চুয়াল মুল্য আছে।
স্টক মার্কেটে কোনো নতুন শেয়ার বের হওয়ার আগে প্রথম বের করা হয় IPO (Initial Public Offerring), ঠিক তেমনি নতুন কয়েন বা টোকেন বের করার আগে বের করা হয় ICO (Initial Coin Offerring)। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে যে মূল পার্থক্য তা হল আইপিওগুলি বাস্তব সম্পদ এবং একটি ব্যবসায়িক ট্র্যাক রেকর্ড সহ কোম্পানিগুলি দ্বারা জারি করা হয়। এটা সব একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে আইসিও হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে কোনো ব্যবসার জন্য সাদা কাগজে প্রস্তাবিত একটি ধারণার উপর ভিত্তি করে রচিত যা চালু করার জন্য কোনরূপ সম্পদ ছাড়াই পাব্লিক ফান্ডিং-এর মাধ্যমে তহবিল খুঁজছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করতে গেলে প্রথমেই কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির এক্সচেঞ্জে KYC-র ডকুমেন্ট এবং ফটো জমা দিয়ে একাউন্ট খুলতে হয়। তারপর সেই একাউন্টে ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ডের বা ইউপিআই-এর মাধ্যমে টাকা জমা করতে হয়। তারপর সেখানে জমা টাকা দিয়েই কয়েন কিনতে হয়। প্রয়োজনে কয়েন বিক্রি করে আবার ব্যাঙ্কে টাকা ফেরত নেয়া যায়। এই এক্সচেঞ্জের একাউন্টের হট ওয়ালেটেই ব্যক্তিগত কয়েনগুলি রাখতে হয়। এই ওয়ালেটগুলি যেহেতু ইন্টারনেটের সঙ্গে সবসময় যুক্ত থাকে তাই এটাকে হট ওয়ালেটও বলা হয়। আরেক প্রকার ওয়ালেট আছে যেটাকে কোল্ড ওয়ালেট বলা হয়। বস্তুত এটা একটা হার্ডওয়ার ও সফটওয়ারের সমন্বয়ে তৈরি একটা ডিভাইস। হট ওয়ালেট থেকে কোল্ড ওয়ালেটে ট্র্যান্সফার করে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করার ফলে কোল্ড ওয়ালেট থেকে হ্যাকাররা ডিজিটাল কয়েন চুরি করতে সক্ষম হয় না। আরেক ধরনের ওয়ালেট আছে যেটা কয়েন ইস্যুকারীদের দ্বারা সফটওয়ারের মাধ্যমে তৈরি যেটা কোনো হার্ড ড্রাইভে বা ইউ এস বি ড্রাইভে বিনামূল্যে রাখা যায়।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজেই ডিজিটাল কয়েন পাঠানো বা বিনিয়োগের মত সুবিধার সাথে, সত্যি বলতে কি, ডিজিটাল কয়েনে বিনিয়োগের বেশ কিছু রিস্ক বর্তমান। হ্যাকারদের সমস্যা প্রবল। এই হ্যাকাররা অনেক এক্সচেঞ্জ থেকে বিটকয়েন চুরি করে দেউলিয়া করেছে। স্ক্যামারও অনেক। ডিজিটাল কয়েনের মাধ্যমে পাব্লিক ফান্ডিং করে স্ক্যাম করেছে। Money laundering হচ্ছে। যেহেতু ডিজিটাল কয়েনের জগৎটাই অনিয়ন্ত্রিত, তাই ক্রেতা সুরক্ষার কোনো ব্যাপার চোখে পড়ার মত নয়। ক্রিপ্টো স্পেসের সুবর্ণ নিয়ম হল ‘caveat emptor’, ক্রেতাকে সতর্ক থাকতে দিন।
কিছু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ব্লকচেন অ্যাপ্লিকেশনগুলির জন্য একটি হ্যান্ডস-অফ নীতি গ্রহণ করেছে, সরাসরি স্ক্যামের উপর নজর রাখছে এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। তবুও অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রকগণ ডিজিটাল কয়েনের সুবিধার চেয়ে ক্ষতির চিন্তায় বেশি উদ্বিগ্ন। তবে নিয়ন্ত্রকেরা এখন একটা ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। ভারতের মত কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর কীভাবে নিয়ন্ত্রণ আনা যায় সেজন্য বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক করছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ব্লকচেন প্রযুক্তি সত্যিই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেই ভারত সরকার ব্লকচেন প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই ডিজিটাল রুপি প্রবর্তন করেছেন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সহ। মনে হয় ভারতের নীতি অনুসরণ করে অনেক দেশই অদূর ভবিষ্যতে সেন্ট্রালাইজড ডিজিটাল সরকারি মুদ্রার প্রবর্তন করবেন।