লোডশেডিং — বিজয়া দেব

লোডশেডিং     (ছোটোগল্প)

বিজয়া দেব


অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে মোমবাতিটা বের করলাম। ক’দিন থেকে লোডশেডিং হচ্ছে। দিদিটা ঘুমোচ্ছে। একটা ভ্যাপসা গরম আর চাপা অস্বস্তি। এই সময়ে এক আওয়াজ কানে এলো। গোঙানোর মত আওয়াজ। সতর্ক হয়ে উঠলাম। দিদিকে জাগাতে ইচ্ছে হল না। আমার নার্স দিদি সারাদিন হাসপাতালে অকথ্য খাটুনির পর বিছানায় শুয়ে পড়লেই চটজলদি ঘুমের দেশে। রোজ রাতে তার ঘুমোবার সুযোগ মেলে না। আমি একটা কলেজে পড়ি। কষ্টের রোজগার থেকে দিদি আমার পড়ার খরচ জোগায়।

মোমবাতি ও দেশলাই খুঁজে পেলাম। ওটা জ্বালিয়ে টেবিলে দাঁড় করাতে বেশ খানিকটা কসরৎ করতে হল। আবার গোঙানোর আওয়াজ।
ওদিকটায় দুটো ছাত্র ভাড়া থাকে। অভিষেক ও পার্থজিৎ। এখানেরই পলিটেকনিক কলেজে পড়ে। ওদের কারো শরীর খারাপ? এই জায়গাটা একটি জনবিরল এলাকা। শহরতলি। থেকে থেকে কারেন্ট চলে যায়। যারা এই এলাকায় থাকে এবং মোটামুটি সম্পন্ন তারা ইনভার্টার কিনে রাখে। কারেন্ট চলে গেলে আলো জ্বলে ওঠে। আমাদের ওসব নেই।. দরজা খুলে বাইরে লম্বা বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। এই বারান্দার ওপাশটার লাগোয়া ঘরে থাকে অভিষেক ও পার্থজিৎ আর এপাশের ঘরটাতে থাকি আমি ও দিদি।

অথৈ অন্ধকারে চারপাশ ডুবে আছে। রাস্তার কুকুরগুলো একযোগে ডাকছে। একটা ফোন করব অভিষেককে কিংবা পার্থকে? এটা ওটা কথা বলে বলে আমার সঙ্গে ওদের বেশ বন্ধুত্বের কাছাকাছি মত একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু এখন কত রাত?

মনে হল কাঁধে কেউ হাত রেখেছে। চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি অভিষেক।
₋₋ রাকা! ঘুমোওনি?  অভি আমাকে বলল।

আমি পাল্টা বললাম ₋₋ তুমিও তো ঘুমোও নি দেখছি।
অভি বলল ₋₋ কী ঘোর কাপালিক অন্ধকার।
বললাম ₋₋ কাপালিক অন্ধকার?
₋₋ হ্যাঁ, এই মোমবাতির আলো যেন কাপালিকের সামনে রাখা ধুনি। এই যে আমার রুমমেট পার্থজিৎ ঘুমিয়ে আছে যেন কাপালিকের সামনে শবদেহ।
অভির কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে আমি শিউরে উঠলাম। তবু কষ্ট করেই একটু হেসে বললাম ₋₋ বাপরে, তোমাকে তো কবি মনে হচ্ছে।আচ্ছা একটু আগে একটা গোঙানোর আওয়াজ পাচ্ছিলাম। তুমিও কি পেয়েছ? কিন্তু এখন আর শুনতে পাচ্ছি না কেন কে জানে।
₋₋ ওটা পার্থ।
₋₋ মানে? কী হয়েছে পার্থের?
₋₋ চারপাশে অন্ধকার হয়ে গেলে কাপালিক আসে। সে তার নিজের মত করে শবসাধনায় মেতে ওঠে। মানুষের আদিম ইচ্ছেগুলোর সাথে এই কাপালিক অন্ধকারের নিগূঢ় সংযোগ আছে। তুমি টের পাও?
আমার কেমন অদ্ভুত একটা অনুভব হলো।
অভি আমার কাছে ঘন হয়ে এল। তার উষ্ণ শ্বাস আমার কাঁধে এসে পড়ছে। তার হাত আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরছে। ওর উষ্ণ স্পর্শ আমাকে অন্ধকারের ভাষা চিনিয়ে দিচ্ছে। ঘোর তমসার ভেতর থেকে মনে হলো ঘন জলজ স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। অভি আমাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল ₋₋ এটা ঘনঘোর রাত। কাপালিক অন্ধকার। চারপাশে আঁধার জমাট বেঁধেছে। অন্ধকার ভেদ করে জ্বলছে ধুনির রক্ত আলো। রাকা, তোমার কি মনে হচ্ছে না আমরা দুজন আদিম নর নারী। আমাদের এখন মিলিত হওয়ার সময়। অভির চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেলাম। মোমবাতির মৃদু আলোর কাঁপা কাঁপা রেখা অভির মুখে রহস্যের মত খেলছে। আমার বাকশক্তি লোপ পেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব! দিদিকে ডেকে তুলব কি না ভাববার মত অবস্থাও যেন হারিয়ে ফেললাম। অভি আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল আর লম্বা বারান্দার ও কোণটায় একটা ছড়ানো মাদুর ছিল সেখানে এনে আমাকে বসিয়ে দিল। আমার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে, আর অভির দেহের জ্বরো উত্তাপ আমার দেহের শিরা উপশিরায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অভি আমাকে শুইয়ে দিল।

এই সময়ে ঝপ করে জ্বলে উঠল আলো। আমরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলাম। জোরালো আলোর ভেতর থেকে আমাদের অন্ধকারে জেগে ওঠা শরীরী চাহিদাগুলো অদ্ভুতভাবে কটাক্ষ করছিল।
অভি এখন মাথা নিচু করে বসে। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
বললাম ₋₋ পার্থজিৎ এর গোঙানো?
অভি মৃদু হেসে বলল ₋₋ ওটা সম্ভবত রাতজাগা পাখির ডাক। রোজ রাতে শুনতে পাই।

আলোর উৎসারের ভেতর আমরা পরস্পরের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা যেন চরম অবাস্তব ও অলৌকিক মনে হচ্ছিল।

অতঃপর দুজনেই নিজ নিজ ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলাম।