মেস মেসবাড়ি মেসজীবন – সদানন্দ সিংহ

মেস মেসবাড়ি মেসজীবন

সদানন্দ সিংহ

মেস হল এমনই একটা ব্যবস্থা যেখানে একের বেশি পরিবারের বাইরের সম কিংবা অসম বয়সের বা বিভিন্ন পেশার বা শিক্ষার্থী লোক মিলে জীবনের তাগিদে একসঙ্গে মাসের পর মাস খাওয়া-দাওয়া করে থাকেন নিজেদের দায়িত্বে এবং সেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যয়ভার নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে বন্টন করে নেন।
একসঙ্গে একই ঘরে থেকে বা একই বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন ঘরে থেকে বা ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে থেকেও মেস করা যায়। সাধারণত মেসের খরচ দু রকমের হয় — ফিক্সড এবং রেকারিং। ফিক্সড খরচের মধ্যে আছে রান্নার লোকের খরচ, বাড়িভাড়া (যদি সবাই একই বাড়িতে সম পর্যায়ের ঘরে থাকেন) ইত্যাদি আর রেকারিং খরচের মধ্যে আছে মাছ, মাংস, দোকান, বাজারের খরচ ইত্যাদি। মেসের মেম্বার কেউ যদি মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকেন তাহলেও তাকে ফিক্সড খরচের মাসিক টাকা দিতে হয়, আর রেকারিং খরচের টাকা ভাগ করা হয় কোনো মাসে কে ক’টা মিল খেলেন তার ওপর ভিত্তি করে।
কোনো বাড়ির বেশির ভাগ অংশই যদি মেস ব্যবস্থায় চলে আসে তাহলে সেই বাড়িটাই মেসবাড়ি। আর মেসে যাঁরা থাকেন তখনকার মতো তাঁদের জীবনটাই মেসজীবন বা মেস-কালচার।
দেশের প্রায় সব শহরে, আধাশহরে এখন মেস ব্যবস্থা বর্তমান। এমন কি গ্রামাঞ্চলেও যেখানে অফিস, কোর্ট-কাছারি, ইন্ডাস্ট্রি আছে সেখানেও মেস ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে প্রয়োজনের তাগিদে।
তবে প্রাচীনকালে এই মেস ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের দেশে বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মেস ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল শহরে। কারণ তখন অফিস, কোর্ট-কাছারি, শিল্প সবই গড়ে উঠেছিল শহর এবং শহর সংলগ্ন অঞ্চলে। তখনই কলকাতায় গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন মেসবাড়ি। কলকাতায় তখন ছিল মেসবাড়ির এক রমরমা। সেটা আমরা বসন্ত বিলাপ বা সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমায় দেখেছি।
কলকাতার মেসবাড়ি পৃথিবী খ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গ্রামগঞ্জ, বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহার থেকে প্রচুর লোক কাজকর্মের উদ্দেশ্যে কলকাতায় পদার্পণ করেছিল। আর দিল্লিতে ১৯১১ সালে রাজধানী স্থাপিত করার আগে পর্যন্ত কলকাতাই ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থাকায় কাজকর্মে সুবিধার জন্য প্রচুর লোক কলকাতায় আসতো। তখন থেকেই কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় মেসবাড়ি গড়ে উঠেছিল। কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট, হ্যারিসন রোড (এখনকার মহাত্মা গান্ধী রোড), শিয়ালদা, মানিকতলা, বউবাজার ছিল মেসবাড়িগুলির প্রধান ঠিকানা। সেই সময় মেসবাড়ি বলতেই সবাই বুঝতো দোতলা বা তেতলা বড় দালানবাড়ি যেগুলির কোনোটাতে বারান্দা থাকতো, কোনোটাতে থাকত না এবং ঘর জুড়ে পাতা থাকতো তক্তপোশ, আর সেই ঘরে দশ-বারোজন লোক থাকতো। পরবর্তী কালে তক্তপোশগুলি পরিণত হয়েছিল সিঙ্গল বেডে। খেলাধুলা, সাহিত্য, রাজনীতি সবই ছিল এই মেসবাড়িতে। এমন কি ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীদের ঘাঁটিও ছিল এই মেসবাড়ি। সত্তর দশকে দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ দলের অন্যতম ঠিকানাও ছিল এই মেসবাড়ি।
সাহিত্যেও মেসবাড়ির অবদান কম নয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর জীবন থেকে মেসবাড়িকে আলাদা করা কোনোদিন যাবে না। তাই শিবরাম চক্রবর্তী বলেন, মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়েই তিনি শিবরাম হয়েছেন।
ফুটবলার পি কে ব্যানার্জিও জামশেদপুর থেকে কলকাতায় এসে মেসবাড়িতেই থাকতেন। শোনা যায় ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহা এবং অশোক দিন্দাও কিছুদিন শিয়ালদা কোলে মার্কেটের মেসে কাটিয়ে গেছেন।

এখনো কলকাতায় মেসবাড়ি বর্তমান এবং তা সংস্কারের অভাবে এখন খুবই জীর্ণ দশায়। কালের প্রভাবে এখন মেসবাড়ির বদলে পেয়িং গেস্টের রমরমা। কলকাতা বাদে দেশের অন্যান্য জায়গায় মেস আছে, মেসজীবন আছে, কিন্তু কোথাও মেসবাড়ি বলে কোনো বাড়ি বা তার ঠিকানার অস্তিত্ব নেই। মেসবাড়ির ঠিকানা আছে একমাত্র কলকাতাতেই। আগামী দিনে হয়তো থাকবে না। ইতিহাস হয়ে থাকবে।