গান গাওয়া পাথর – ভাসিল বাইকোভ

গান গাওয়া পাথর

ভাসিল বাইকোভ

               (রাশিয়ান গল্প, ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ সদানন্দ সিংহ)

আমি পাশের দ্বীপের চারপাশে হেঁটেছি, মাঠের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করেছি এবং খাড়া ডান পাড় ধরে দৌড়েছি। সেখানে উজ্জ্বল বসন্তের সূর্যালোক পৃথিবীকে প্লাবিত করেছে, সেখানকার নদীটি তীক্ষ্ণ সোনালি তারার মতো ঝলমল করছে, স্বচ্ছ বাতাস উষ্ণ এবং সদ্য চাষ করা মাঠের উপরে কম্পন ধরাচ্ছে যেখানে কিছু সাদা-চঞ্চুযুক্ত রুক পাখিরা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং ব্যাঙগুলি সবুজ রঙে আচ্ছাদিত পুকুরে ঘ্যাঙরঘ্যাং করে ডেকে যাচ্ছে। কোল্টসফুট গাছের হলুদ মাথাগুলি সমস্ত ঘাসগুলির মাথা ছাড়িয়ে তাজাভাবে উজ্জ্বল করে ছড়িয়ে পড়েছে।

আমি আমার স্যুটকেসে বসে উচ্ছল তৃণভূমির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়েছিলাম। ওহ, আমি বসন্তের বন্যাকে কতটা অবর্ণনীয়ভাবে মিস করেছি। আমি কতবার স্বপ্ন দেখেছিলাম এই নীল নদীটি — তৃণভূমির গাছ, বেড়া, উভয় তীরের ধোঁয়ায় সিক্ত সব স্নানঘর, কাঠের তক্তা যেখান থেকে মহিলারা তাদের ধোয়াধুয়ির কাজ করে, ডিম্বাকৃতির নৌকা এবং তার মাটির ওপর ডিম্বাকৃতি দাগ – সবগুলি প্লাবিত করেছে।

জল উভয় দিকে বহু মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, তার ছলছল শব্দ ছাড়া অন্য শব্দ শোনা যাচ্ছে না এবং এই পটভূমির মধ্য দিয়ে একটি ট্র্যাক্টরের গর্জন বাতাসের সাথে ভেসে এসে সাদা পায়ের বার্চ গ্রোভের ওপারে হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে মাত্র তিন মিটার উপরে একটি লার্ক পাখিকে গুলি করা হল। যেন বসন্তের সুখে দমবন্ধ হয়ে আসার মত পাখিটি ডানা নাড়তে নাড়তে একবার নামছে নিচের দিকে এবং আবার উঁচুতে উঠছে, তারপর ছোট থেকে ছোট হতে হতে একসময় এটি সাদা-নীল আকাশে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়। আমি আর লার্ক পাখিটিকে দেখলাম না, শুধুমাত্র অবিশ্বাস্যভাবে নীল আকাশ আমার চোখের উপর জোরে চেপে ধরল। তারপর অদ্ভূতভাবে, লার্কটি জোরে এবং আরো জোরে আওয়াজ করল। আমার বোধগম্য হল না যে এই ক্ষুদ্র পাখিটি কীভাবে এত শক্তিশালী, অবিরাম শব্দ করতে করতে একসময় সুরেলা হয়ে এক ধরনের আনন্দময় শিস হয়ে দেখা দিল। কিন্তু ছোট্ট পাখিটি কখন এই নীল আকাশের হাওয়া মুখে তুলে নিল ? কীভাবে তার এই অনিচ্ছাকৃত গান তার ক্ষুদ্র হৃদয়টাকে ফাটিয়ে দিল না? তার এই ঐশ্বর্য কোথা থেকে পেল? আমি উপরের দিকে তাকালাম: আরেকটা লার্ক আমার বাম দিকে উড়ে গেল, তারপর তৃতীয়টি। প্রতিটি পাখি অন্যদের গানে হস্তক্ষেপ না করে নিজের গান গাইতে লাগল, মনে হল যেন পুরো নীল আকাশ নিজেই গান গাইছে।

নদীটিও একই রকম বিস্তৃত ছড়িয়ে পড়া আওয়াজ তৈরি করছিল এবং এক তীক্ষ্ণ সোনালি স্ফুলিঙ্গ  জ্বলজ্বল করে ছড়িয়ে পড়ছিল। আমি সাদা-শীর্ণ গ্রামের ছাদের দিকে তাকালাম, লার্কের গান শুনলাম, এবং আমার শৈশব আমার স্মৃতিতে ফিরে এল। ওখানে সেই টিলা আছে যেখানে আমি মূর্খ ভেজা ঠোঁটওয়ালা বাছুরগুলোকে চারণ করেছিলাম এবং যেখানে আমার বন্ধুদের সাথে আগুন জ্বালাতাম। সেই উষ্ণ মাটির গন্ধ এখনও পাচ্ছি এবং সেই একই নদী একপাশে বয়ে চলেছে। এখানে সবুজ পাইক মাছগুলি এখনও জল-আগাছায় ডিম পাড়তে আসে। আর এই মাঠ, বহু পা দিয়ে মাড়ানো হাজার হাজার বছর ধরে লাঙ্গল করা বরফ যুগের ফেলে যাওয়া পাথর এবং তাতে অসংখ্য লার্কের বাসা — এটি কি আগের মত একই নয়? বসন্তের জমির উপর নদীর শব্দ যেন প্রবাহিত সময়ের শব্দ। এটি আমার পূর্বপুরুষদের কথা মনে করায়, এটি আমাকে উত্তেজিত করে এবং আমার পুনরুজ্জীবিত হৃদয়ে কিছু নাড়া দেয়, এবং এইসব বাস্তব চিত্র আমার অতীত পটভূমিতে ঠেলে দেয়। কিছুদূর গিয়ে দেখি একটি নৌকা আংশিকভাবে জল থেকে টেনে বের করা অবস্থায় আছে, যার একপাশে একটি হালকা বৈঠা আটকে আছে এবং নৌকোর ওপরে মাছ ধরার জাল শুকানোর জন্য ঝুলছে। এটি সেই একই নৌকা হতে পারে যেটিতে আমি নদী পার হয়েছিলাম, আমার প্রথম প্রিয়তমার সাথে দেখা করতে, যখন কোল্টসফুট গাছের চোখ, সেই প্রথম প্রেমের চোখের মতো, উজ্জ্বলভাবে জ্বলজ্বল করছিল নদীর পাড়ের সঙ্গে।

আমি আমার মাথায় আমার হাত রেখেছিলাম, আমার শেষ সিগারেটটি ফুঁকছিলাম। লার্করা একই শক্তিতে গান করছিল, অক্লান্তভাবে। আমি মে মাসের এইরকম আনন্দের বিকেলের কথা মনে করছিলাম, যখন আমি নদীর ওপারে একটি মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম, তখন কীভাবে আমার প্রতিবেশী, একজন বৃদ্ধ, যার ছিল এক মেয়েলি ডাকনাম, ওকুল্যা, আমাকে তার নৌকা ধার দিয়েছিল। নদীতে নৌকা ঠেলে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন কিভাবে আমার প্রিয়তমার সাথে কথা বলতে হবে। “বাছা, তোমার প্রথম যে জিনিসটি দরকার তা হল একটি অ্যাকর্ডিয়ন। অ্যাকর্ডিয়ন দিয়ে তুমি তাদের যে কাউকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করতে পারো। সঠিক শব্দচয়নও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রধান জিনিসটি হল তুমি যে প্রথম কথাটি বলবে সেটা। যদি তুমি সঠিকভাবে মাথায় টোকা দিতে পার তাহলে সেখানে তুমিই বিজয়ী হবে। তবে তোমাকে সঠিক কি বলতে হবে তা অন্যান্য সব ধরনের জিনিসের উপর নির্ভর করে।”
আমি প্রেমে পড়া যুবকের মত তীব্র কৌতূহলের সাথে তার কথা শুনলাম, লজ্জায় আমার চুলের গোড়া লাল হয়ে গেল, আর দেখলাম দূরে তখনও ওকুল্যা তার গল্পগুলি চালিয়ে যাচ্ছিল, আমার সাফল্যে আন্তরিকভাবে সে আগ্রহী। মনে পড়ে, মাঝরাতের পর, কাক ভোরে ভালো ভাবে নৌকা ফিরিয়ে আনার কথা ছিল। আমি যখন ওপারে ছিলাম, তখন পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল এবং গ্রামটি তখন হালকা বসন্তের হাওয়ায় শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিল। ওকুল্যা বাথহাউসের সামনে, জলের একেবারে প্রান্তে একটি কাঠের লগে বসে ধূমপান করছিল।
“কি ভাবছো বাছা, সকালের মধ্যে কি জমে যাবে?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বলল. “আমি দুটো চিন্তায় আছি — অবাঞ্ছনীয়গুলিকে ঢেকে দেবো, নাকি থাকতে দেবো। কিছু মনে করো না, নৌকাটি ওখানেই রেখে দিও। আমি চাইয়ের ফাঁদের মধ্যে মাছ পড়ল কিনা দেখতে যাচ্ছি।”

আমার এত দেরিতে ফিরে আসার বিষয়ে সে একটি কথাও বলে নি, এবং আশেপাশের কেউ নদীর ওপারে আমার প্রেম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম তার কাছে। লার্কের গানের মতো সেই স্মরণীয় বসন্তটি একটি সুখী দিন ছিল এবং দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল, কিন্তু তারপরে আরেকটি বসন্ত এসেছিল, একেবারে অন্যরকম, — অন্য তীরে যাওয়ার আর কোনও কারণ ছিল না, কারণ সেখানে যাবার জন্য কেউ ছিল না. আর তাছাড়া আমি তাড়াতাড়ি গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। আমি শেষবারের মতো এই জমিতে চাষ করছিলাম এবং ওকুল্যা শস্যের বস্তা তুলছিল, এবং আমরা এখানে এই টিলায় বিশ্রামের জন্যই থামতাম। তারপর, ঠিক এখনকার মতো, আমাদের পায়ের নিচ থেকে একটা লার্ক উড়ে এসে গান গাইতে শুরু করল এবং ওকুল্যা তার সিগারেট নামিয়ে দিল।

“এই ছোট্ট শয়তানের কথা শোন! সে কি চালাক নয়! পৃথিবীতে তার কোন যত্ন নেই, শুধু বাঁচে এবং তার পছন্দ মতো গান গায়। তুমি কি এই সুখী পাখির গল্প জান? তুমি যদি এটি কখনও শুনোনি তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা অনেক আগে ঘটেছিল, আমি বলতে পারব না কতদিন আগে। একদিন নদীর এই ধারে এক যুবক কৃষক বাস করত। সে জমি চাষ করত, গাছ কাটত এবং বার্লি বপন করত। তখন এখানে জঙ্গল ছিল না। গাছগুলি এখনকার মতো ছিল না; গাছগুলি গুঁড়ির চারপাশে অন্তত দ্বিগুণ বড় হয়ে গেছে এখন। তাই এই লোকটি এখানে বাস করত, এবং তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি একটি মাছিকে আঘাত করতেন না, কিন্তু কাউকে ভয়ও পেতেন না। তার এক যৌবনবতী স্ত্রী ছিল। স্ত্রী ঘরে থাকতেন এবং কাপড় বুনতেন যখন তার স্বামী ক্ষেতে কাজ করতেন। তিনি একজন ভাল স্ত্রী, তার পুরুষের মতো কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। এক বসন্তের দিন, এখনকার মত, কৃষক তার ক্ষেতে এসে তার লাঙ্গল চাষ করছিল। এক চক্কর চাষ করার পর আবার আরেক চক্কর দিচ্ছিল ঘাম মুছতে মুছতে। তার লাঙ্গল সারাক্ষণ পাথরের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছিল এবং পাথরগুলি এমন লাফাতে থাকে যে তার মুখে লেগে দাঁত প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল। সেই জমিটা পুরোটাই পাথর, একটার ওপরে আরেকটা পাথর। প্রতিটি ধাপে তার লাঙ্গল এক-একটি পাথরের সঙ্গে টক্কর খাচ্ছিল, এবং তার প্রতিটি লাঙলের মাটি বৃথা হয়ে যাচ্ছিল। তাই কৃষক ক্লান্ত হয়ে এই টিলায় বসে পড়েছিল। তখন হঠাৎ বনের এক রাজকন্যা বন থেকে বেরিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখ দুটি গভীর জলাশয়ের মতো, তার বিনুনি তার হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছেছিল, তার হাত ধপধপে সাদা এবং তার মাথার মুকুটটি সোনার জালের তৈরি। লম্বা ঘাসের পাতাগুলি খুশিতে তাকে স্পর্শ করছিল। ‘কৃষক, তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে? নাকি আমি তোমার জন্য যথেষ্ট ভালো নই?’ সে বলেছিল। আশ্চর্য হয়ে লোকটি তার লাঙ্গল ধরে দাঁড়িয়ে গেল। কৃষক তাকে বলল: ‘অবশ্যই তুমি সুন্দর! কিন্তু এটা ভাল না. আমি তোমার সুন্দর চোখের দিকে তাকাতে আসিনি। জমি শুকিয়ে যাচ্ছে, এখানে অনেক পাথর, আর সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সময় আমার জন্য অপেক্ষা করবে না।’ তারপর সে মাটির গভীরে লাঙল চাষ করতে লাগল, কিন্তু তার লাঙল শীঘ্রই আরেকটি পাথরে আঘাত করল। বনের রাজকুমারী লোকটির দিকে চাইল এবং শিশিরের ফোঁটার মতো অশ্রু তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল। ‘তাহলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে না?’ সে জিজ্ঞেস করেছিল। ‘প্রিয়, নিজের স্ত্রী ফেলে অন্য নারীদের পেছনে ছুটে চলা, এটা কৃষকের ব্যবসা নয়।’ ‘যদি এমনই হয়, আমাকে বল, কৃষক, তোমার পুরুষালি বিশ্বস্ততার প্রতিদান দেওয়ার জন্য আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’ ‘আমি কিছু চাই না সুন্দরী, আপনার সদয় কথার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ তারপর সেই রাজকন্যা নিচে থেকে একটি পাথর তুলে তার চোখের জলে ধুয়ে দিল, তার নরম বিনুনি দিয়ে মুছে দিল, লোকটিকে দিল এবং বলল: “এই পাথরটিকে নীল আকাশে উঁচুতে ছুঁড়ে দাও এবং ভালো করে লক্ষ্ কর।’ কৃষক তাই করল এবং দেখল, পাথরটা একটা খুশি লার্ক পাখিতে পরিণত হল, ডানা ঝাঁকিয়ে বিসর্জন দিয়ে গান গাইতে লাগল, আর ঠিক তখনই মাঠ থেকে সমস্ত ছোট ছোট পাথর ঝরনার জলের মতো বুদবুদ হয়ে আকাশে উঠল, আর মাঠ পাথর মুক্ত হল, এবং মাটি লাঙলের নীচে কালো হয়ে গেল। কৃষক চারপাশে তাকালো কিন্তু রাজকন্যা চলে গেল, শুধু সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল কেবল সেখানকার বাতাস কাঁপছিল। কিন্তু সেই ছেলে আর সেই সুখী লার্কটি কোথা থেকে এসেছিল, কেউ জানে না। লার্ক প্রতি বসন্তে গান গায়। তারপর একবার কিছু সম্ভ্রান্ত লোক বন্দুক নিয়ে এই পথ দিয়ে চলে গেলেন এবং যাওয়ার পথে তারা নিজেকে আনন্দ দেওয়ার জন্যই লার্ক পাখিগুলিকে গুলি করতে শুরু করলেন, তখন হঠাৎ এক শিলাবৃষ্টি শুরু হল। প্রতিটি শিলাবৃষ্টি ছিল মানুষের মুষ্টির আকারের।”

এখন, বহু বছর পর, আমি আমার স্যুটকেসে বসে তৃণভূমির বন্যার দিকে তাকিয়ে লার্কের রোমাঞ্চকর গান শুনে ওকুল্যার গান গাওয়া পাথরের গল্প মনে করিয়ে দেয়। বসন্ত আমার চারপাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, নদী প্রবাহিত হয়, সূর্য মাথার অনেক ওপরে অসহনীয়ভাবে উজ্জ্বল।

গান গাওয়া পাথরগুলো নীলাভ আকাশে স্নান করছিল। তারপর ঝরে পড়ছিল। আবার সূর্যের দিকে উড়ে যাচ্ছিল।

তুমি এখন কোথায়, ওকুল্যা? তুমি কি বেঁচে আছো? তোমার নৌকাটি কি আজো আছে? হয়তো তুমি আমাকে আরেকবার ওপারে নিয়ে যাবে এবং আমি সেই অবিস্মরণীয় চোখগুলো আবার দেখতে পাব; হয়তো ওপারে কেউ একজন এখনো আমাকে মনে রেখেছে।

(Vasil Bykov –19 June 1924 – 22 June 2003)