শিক্ষাদান – অঞ্জলি দে নন্দী

শিক্ষাদান   (ছোটোগল্প)

অঞ্জলি দে নন্দী


বউটি উত্তরপ্রদেশে থাকতো তখন। ছোট ননদের বিয়েতে গিয়ে পৌঁছল স্বামীর সাথে গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে। আগে থেকে চিঠিতে পাঠানো ননদের লিস্ট অনুযায়ী প্রায় দশ হাজার টাকার জিনিস কিনে নিয়ে ওরা এলো। বউটির উত্তরপ্রদেশে থাকার সময় টাকার অভাবে কষ্টে কাটতো। তবুও বিয়ের পর থেকেই সে টাকা জমিয়ে রাখতো। কারণ সে অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল যে ননদের বিয়েতে টাকা চাইবে আর তা দিতেও হবে। আর যদি টাকা না দেয়, আরও দুর্দশা ভোগ করতে হবে।

বিয়ের আগে বউটির ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে পাকা কথার সময় ওরা বলেছিল, বিয়ের পরেই তাদের ছেলে, বউকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশে নিয়ে চলে যাবে। আর এজন্যই মেয়ের বাবা-মা ওই পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। তারা কন্যাকে অনেক যত্নে কোলকাতার হোস্টেলে রেখে মানুষ করেছিল। নইলে গ্রামে থাকা পাত্রকে কখনোই জামাই করতো না।

কিন্তু বৌ যেই না বাসর ঘরে ঢুকলো, অমনি মেজ ননদ বেশ কায়দা করে বলল যে বউটিকে এই গ্রামেই থাকতে হবে। আর বর থাকবে উত্তরপ্রদেশে। কনের সবাই ভেঙে পড়ল, এ কি রকম প্রতারণা? স্তব্ধ হয়ে গেল বাবা মা ভাইবোন। এরপর শুরু হল ছোট ননদদের জ্বালানো। বড় এবং মেজ ননদ তাদের বুড়ো বরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে বসে নববিবাহিতা বৌদির আনন্দ শেষ করে দিল। এবার কনের ছোট পিসি অর্থাৎ তার শাশুড়ির ছোট ননদ এসে বাসর ঘরে বিছানায় শুয়ে পড়ে বললেন যে তার চোখে আলো লাগছে, তাই আলো অফ করে দিলেন। বাসরঘরটা অন্ধকার গেল। এই ছোট পিসির মেয়ে হয়েছিল নিতকনে। তিনি দুপুরে তাঁর মেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন গায়ে হলুদের সময় কনের শাড়িটি পড়ে গায়ে হলুদ করবে বাচ্চা মেয়েটি। তাই সে তো বায়না ধরে রইল। উপায় কি? কনের শাড়ি পড়ে নিতকনের আর নিতকনের শাড়ি পড়ে কনের গায়ে হলুদ হল। আবার রাতে তিনি নিজে বাসরঘরটা অন্ধকার করে দিলেন। আর ননদরা মিলে যেসব ছোট কাজ করল তা বলে লাভ নেই।

বউটি কেন ছোট ননদের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছিল তার কারণও আছে। তার স্বামী বিয়ের পর বউকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশে আসবে বলে বিশ হাজার টাকা জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু যেই বিয়ে করতে এলো, অমনি তার বাবা সে টাকা চেয়ে নিলেন। বললেন ইনকামট্যাক্স নাকি দিতে হবে। বাবা স্কুলের টীচার। ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয়, অথচ সে ট্যাক্স দেবার টাকা নাকি তাঁর নেই। আবার তিনি কনের বাবার কাছ থেকে কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে দু’তলার ঘর শেষ করলেন। যদিও বৌ-ছেলে সেখানে স্থান পেল না। সেখানে সে নিজে থাকতেন, আর থাকত তার বুড়ো দু জামাই ও দু মেয়ে, আর অবিবাহিতা ছোট মেয়ে। তারাও আবার টীচার। সেইসময় তার স্বামী টাকা না থাকার জন্য বউকে গ্রামে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো। আর বউটিকে তার কাছে আনতেও চায় নি। কারণ সে তিন মাসের মাইনে ধার করে নিজের বিয়ের খরচ করেছিল। একথা বউটি তার পতির কাছেই শুনেছে। তাই তখন ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে বউটি টাকা জমাচ্ছিল। অনেক পরে বউটির বাবা-মা নিজেদের টাকা দিয়ে মেয়েকে জামাইয়ের কাছে উত্তরপ্রদেশে পাঠিয়েছিল।

এবার এলো ছোট ননদের বিয়ের এতো জিনিস কিনে নিয়ে। সে জানত আবার টাকা চাইবে, আর তার স্বামী আবার ধার করে বাড়িতে দেবে, আর বউকে টাকার অভাবে গ্রামে রেখে আসবে। তাই ভবিষ্যৎ আন্দাজ করেই সে টাকা জমিয়েছিল বউটি। তাও অনেক যুঝতে হয়েছিল তাকে! কারণ তার স্বামী টাকা জমাতে দিত না। বন্ধুদের বাহাদুরি দেখানোর জন্য অকারণ টাকা উড়িয়ে দিত। কিন্তু তাও সে পেরেছিল।

গ্রামে এলো। ননদের বিয়েও হল। একদিন এই ননদ কনেটি বিয়ের পিঁড়িতে দাঁড়িয়েও বড়বৌদিকে অপমান করছিল, আজ সেই বৌদিই উপবাস করে সব নিয়ম পালন করে ননদের বিয়ের সব কাজ করে দিল। শুধু কি তাই? সেদিন মাকে দিয়ে অর্থাৎ বউটির শাশুড়িকে দিয়েও অপমান করিয়েছিল সবার সামনে। আজ বিয়ের রাতে নিজের বাবার দেওয়া খাট-ঘর ছেড়ে দিল বউটি, ননদ ও নন্দাই-এর বাসর করার জন্য। নিজে কোনও শোবার জায়গা সে পেল না। বসে বসে বাড়ির দালানের এক কোণে সে আর তার স্বামী রাত কাটিয়ে দিল। অথচ ওই ননদই একদিন বউটির নিজের বাসরের আনন্দ নষ্ট করেছিল। তারপর আবার ফুলশয্যার রাতে ছোট ননদের বাড়ি গেল বউটি। সেখানেও সে নন্দাই ও ননদের কাছ থেকে খুব একটা সম্মান পেল না।
অষ্ট মঙ্গলায় ছোট ননদ ও নন্দাই এল। ছোট নন্দাই বলল যে, সে কেন ননদকে তার মত শিক্ষা দিয়ে পাঠায়নি, বড়দের কোন কথাই মানছে না সে! আর সে যেন ছোট ননদের নাক বিঁধিয়ে পাঠায়। সবাই বলেছে, নাক না বেঁধান থাকলে বরের গায়ে বৌয়ের নিঃশ্বাস লাগলে নাকি অমঙ্গল হয়। বউটি বলল, হ্যাঁ, এরকম কিছু সেও বিয়ের আগে তার ওখানে শুনেছিল। আর তাই তার মা তার নাক বিঁধিয়ে দিয়েছিল। যাক একমাস পরে বউটি আবার উত্তরপ্রদেশে চলে এল।  

এরপর প্রায় দেড়বছর পর, স্বামীটি জব ছেড়ে বউকে নিয়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে সেই গ্রামের বাড়িতে এল। ততদিনে, তার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। অপারেশনও হয়েছে। টাকা নেই তাই, বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালের ট্রিটমেন্টের অবহেলায় তার বাঁচারও আশা ছিল না। সারা দেহ তখন ফুলে ছিল। তবু কি করে জানি বেঁচে গিয়েছিল। কারণ তার মা উত্তরপ্রদেশে এসে মেয়েকে খুব সেবা করেছিল। সেজন্য আবার বড় ননদ চিঠি পাঠাল, কেন বউটির মা তার ভাইয়ের ওখানে গেছে? এদিকে তার স্বামী তার বন্ধুদের নিয়ে টাকা ধার করে মাংস-ভাতের ফিস্ট করছে, আর ওদিকে বউ মিসক্যারেজ হওয়ার পর সেপটিক হয়ে গিয়ে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে তড়পাচ্ছে।

সেইরাতে প্রায় আট ঘণ্টা শীতের দিল্লির রাতে প্ল্যাটফর্মে বসে কেঁপে কেঁপে কাটিয়ে তারপর ট্রেনে এসে বসল। তারপর হাওড়ায় এসে একটি লরিতে উঠে বউকে নিয়ে গেল ওই অত দূরের গ্রামে। বউটি প্রায় আধ জ্ঞানহীনা ছিল। গ্রামের বাড়ির সামনে আসতেই শুরু হল স্বামী, ননদ, শাশুড়ির নির্যাতন। আড়াই দিন ধরে রাস্তায় আসার ফলে সিঁদুর হালকা হয়ে গিয়েছিল। তাতে মেজ ননদ বলল, তার দাদার মঙ্গল করতে হবে না? সিঁদুরের এরকম অবস্থা কেন? শাশুড়ি ধাক্কা মেরে উঁচু দুয়ার থেকে নিচু উঠোনে ঠেলে ফেলে দিল। বলল, “তুই পাপী, তাই পেটের প্রথমটাকে খেলি! আর আমার পেটেরটার মঙ্গল করতে পারছিস নি?” বউটির কোমরে এবং মাথায় খুব জোরে আঘাত লাগল। আর ছোট ননদ, সেও ওখানে ছিল, সে তো থামছেই না…. ওরা মা-মেয়েরা মিলে, বউটির স্বামীকে টেনে ধরে রেখে, যত খুশি অত্যাচার করে চালাল বউটির ওপরে। পতিদেবও চুপ। এবার বাইরে থেকে শ্বশুর এলেন। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। মামা শ্বশুররাও এলেন। স্বামী লোকটি তার মায়ের, বাবার, ছোট বোনের, মামাদের সবার পায়ে ধরে বউটিকে ক্ষমা চাওয়াল। বউটি বুঝতেই পারল না যে, সে কি দোষ করেছে? এরপর ছোট ননদ ও শাশুড়ি দুজনে মিলে শ্বশুর এবং তার স্বামীকে বুঝিয়ে বউটিকে তার বাবামায়ের বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিল। আর বউটির পতিদেবও বউকে বাপের বাড়িতে রেখে এল।

বউটির মাথা তখনও ফুলে আছে। কিছুদিন পর তার শ্বশুর বউটার বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে তার গ্রামের বাড়িতে ডেকে পাঠাল, কারণ তার স্ত্রীকে নাকি তার ছেলের বউ অপমান করেছে। বউটি তখন নিজের বাবার ভিটায় বাবার বাড়িতে বসে বাবাকে বলল, “সব মিথ্যে কথা বাবা! তোমরা কেউই যাবে না। আমি চাকরি করব। আমি ডিভোর্স করে দেব বাবা!” বাবা বোঝাল মেয়েকে। মাও। মেয়ে হয়তো সাময়িক কালের জন্যে কিছু একটা বুঝল। কিন্তু পরে শুনল যে, ওদের প্ল্যান করা ছিল যে, বউ ঘরে ঢুকলেই তাকে তাড়িয়ে দিয়ে এবং ছেলের সব টাকা নিয়ে বড় জামাইকে দিয়ে দেবে।

বউটি ভেবেই পেল না, এই পরিবারের শ্বশুর এবং জামাইরা যারা শিক্ষকতা করেন তারা কীভাবে স্কুলে শিক্ষাদান করেন! যারা একজন সাধারণ মানুষকে আপন করে নিতে পারে না তারা কেনই বা শিক্ষাদান করেন?