
মা, মাটি ও মানুষের গল্প (ছোটোগল্প)
সোমা গঙ্গোপাধ্যায়
টুটাফাটা আকাশ, ইতস্তত ছড়িয়ে আছে কালো-সাদা মেঘের টুকরো, আপন খেয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। অনেক নিচুতে, জলে তারই ছবি ফুটে উঠেছে কোনো নিপুণ চিত্রশিল্পীর হাতে আঁকা জলরঙের ছবির মতো। কিন্তু না, এ কোনো নিপুণ চিত্রশিল্পীর হাতে আঁকা ছবি নয়, এ বড় বাস্তব, নির্মম সত্যের, বাস্তবতার ছবি। বলরামের বাড়ির চারদিকে জল থই থই করছে। ‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত হয়েছে বিকল’। গত কয়েকদিনের অবিরাম ভারী বর্ষণের ফলশ্রুতি এই বন্যা। অথচ, বর্ষা মরসুমের শুরুটা মোটেই আশাপ্রদ ছিল না। দেশের আবহাওয়া দপ্তরের বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদরাও শংকিত ছিল বর্ষার খামখেয়ালি মনোভাব দেখে। জলের অভাবে এতদিন ধরে সযত্নে রোপন করা কচি ধানগাছগুলো, ধানশিশুরা তখন যেন ইনটেনসিভ কেয়ারের মুমূর্ষু রোগীর মতো ধুঁকছিল। ধুকপুক করছিল তাদের প্রাণ। জীর্ণশীর্ণ নদীর বুক থেকে সংগ্রহ করা সামান্য জলের ওপর নির্ভর করছিলো ওদের জীবন। কংকালসার গাছেদের স্পন্দনহীন নীরবতা, খটখটে শক্ত মাটি। ক্রমশ হতাশার মেঘ পুঞ্জীভূত হয়েছিলো ত্রিপুরার পূর্ব বগাবিল গ্রামের গরিব উদবাস্তু, ছিন্নমূল মানুষদের মনে। কাজ নেই, রুজি-রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। বুনো আলু আর জংলি গাছের ফলমূল, শেকড়-বাকড় খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা। তারপর প্রকৃতির এই দানও এক সময় ফুরিয়ে যায়। পেটের জ্বালা তো আর মেটে না।
বৃষ্টি চাই, বৃষ্টি! নইলে যে জীবন থেমে যাবে। ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে রে’–ওদের এই আর্তনাদ আকাশের কাছে পৌঁছাবে কি কোনদিন? বরুণ দেবতা বড়ই নিষ্ঠুর। ওইদিকে দূরদর্শনের পর্দায়, আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বারবার বলা হচ্ছে যে মনসুন এতক্ষণে এসে গেছে দেশে। কবে, কোথায়, কি ভাবে আসছে? অশিক্ষিত, সরল গ্রামবাসীরা দপ্তরের খবর বুঝতেই পারে না। বলরাম, গিরীন্দ্র, নেপালদের মতো সত্তরোর্ধ্ব ছিন্নমূল উদবাস্তুরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে — অজন্মার প্রেত গ্রাস করেছে তাদের গ্রাম। ছেলে-পুলে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভুখা পেটে মরতে হবে এবার। ওদের কংকালসার বুকের পাঁজরায় বাসা বাঁধে গভীর অসুখ। ভারতবর্ষের অনগ্রসর, অবহেলিত অঞ্চল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত রাজ্য ত্রিপুরায়, ততোধিক প্রত্যন্ত গ্রাম পূর্ব বগাবিল, লোকচক্ষুর অন্তরালে ক্রমশ ধুঁকতে থাকে। শহরবাসী মানুষদের কাছে এসব মনুষ্যেতরদের কোনো খবরই পৌঁছায় না।
নদীর চরে বালির মাঝে তখন কাঁকড়ার গর্ত খুঁজছে বাপি, পরাণ, অতুদের দল। ওদের ধলধলে প্যান্ট আরো যেন নিচে নেমে আসতে চাইছে। দু’একটা কাঁকড়া শামুক, গেঁড়ি-গুগলি পাওয়া গেলে একবেলার খাওয়াটা হয়ে যাবে। সাধুচরণ বলরামের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে — হেই, সাবধানে হাত দিস, সাপ-টাপ গর্তে থাকতে পারে।
ছেলেরা সবাই চমকে ওঠে।
বলরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে — এমনতর অজন্মার পেরেত আর কয় বচ্ছর দ্যাখছ্ সাধু ?
— হ, সাধুচরণ কোমরের লুঙ্গিতে গোঁজা আধ পোড়া বিড়ির সন্ধান করে, পায় না। অন্যমনস্কভাবে সায় দেয় — হগ্গলই আমরার পুড়া কপাল, ইডা তুমি মানবা নি ? নিজেরার বাড়িঘর, জায়গা জমিন, হগ্গলতান ফালাইয়া চুরের মতন পলাইয়া আইলাম ইহানে, হেই কত বচ্ছর আগে। হেই বেদনা কইলজাডারে অহনো পুড়াইতাসে। নইলে, ভাইব্যা দ্যাহো, আইজ কত সুখে থাকতে পারতাম।
— অয় না ? খুউব অয়। পুষ্কুনির মাছ, খেতি ভরা ধান আর বাগানভর্তি সবজি। আমরার কিতা আসিলো একদিন আর কিতা অইয়া গ্যালো!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলরাম আকাশের দিকে তাকায় — মাইঝে মাইঝে ভাবি, আবার ফিরা যাইমু গিয়া বাপ ঠাকুদ্দার ভিটায়। মরুম তো মরি গিয়া চৌদ্দ পুরুষের ভিটাত্ গিয়া। কিতা কও হে তুমি ?
সাধুচরণ বলে — হ, হক্ কতাই কইলা তুমি। তবে এতদিনে কি আমরার জায়গা জমিন খালি পইড়্যা আসে! হগ্গলই তো হেই মুসলমানেরা বেবাক দখল কইরা লইসে। অহন আবার যাইতা হেরার ঠ্যাঙনি খাওনের লাইগ্গা ?
শুনে বলরাম চুপ করে থাকে। সাধুচরণ ভুল কিছু বলেনি।
বাংলাদেশ এখন সুদূর অতীত, তবু পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো আজো তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই কবে ওরা চলে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। দেশভাগের পরই পোঁটলাপুটলি নিয়ে ওরা পালিয়ে এসেছিলো সীমান্ত পেরিয়ে। এই অজানা, অচেনা, পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরার মাটিই তখন ধাত্রী মা হয়ে, ওদের মতো দুর্ভাগা, অভাগাদের আশ্রয় দিয়েছিল সেদিন। আজো ওরা তা অস্বীকার করতে পারে না। এই দেশ এখন ওদের নিজের দেশ। তবু মাঝে মাঝে শেকড় উপড়ানোর বেদনা ওদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। কি ছিল একদিন আর কি থেকে কি হয়ে গেল! যে হিন্দু মুসলমান ছিল ভাই ভাই, একদিন এক জাতি এক প্রাণ হয়ে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করেছিল, বুকের রক্ত দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের মাটি, তারাই কিনা পরে হয়ে গেলো পরস্পরের শত্রু! আব্বাস, করিম, রেজানুল — ওরা কত দ্রুত বদলে গেলো! মৌলবাদের প্রেত তাড়া করেছিলো ছেলেবেলার সাথীদের। তাই একদিন তার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলো সহজ সরল ভোলাভালা মানুষগুলো। কেন এমন হয়? ধর্মের বর্ম পরে, স্বৈরাচারী, ক্ষমতালোভী, রক্তপিপাসুদের সদম্ভ আস্ফালন একদিন সত্যি সত্যি অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তাদেরকে দুই জাতি, দুই ধর্ম, দুই সম্প্রদায় বলে। অথচ একই মায়ের ভাষা দু’জনের। হারাধন মাস্টারের হাত ধরে সেদিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো বৃদ্ধ ইউনিস মিয়া। আর বহুদিনের প্রেমিকা ছোটবেলার সাথী করিমের বোন লায়লার কাছ থেকে বিদায় নিতে যেতে পর্যন্ত সাহস পায়নি সেদিন বলরাম। রাতের অন্ধকারে, চোরের মতো লুকিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছিলো ওরা সবাই। বুক ভরা বেদনা নিয়ে পেছন ফিরে বারবার দেখছিলো ফেলে আসা বাড়িঘর, সবুজ ধানে ভরা জমি আর পুকুর। প্রাণ বাঁচানোই দায় যেখানে বিষয় সম্পত্তির চিন্তা করে কোন লাভ নেই, এই ভেবে ওরা মনকে প্রবোধ দিচ্ছিলো। ওরা জানে না কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যত ওদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক যুবতি, বয়স্ক মানুষ দলে দলে দেশ ছেড়ে যাচ্ছিলো। লায়লার মুখটা বারবার চোখে ভাসছিলো বলরামের। যাকে প্রতিদিন একবার করে না দেখতে পেলে তার মন খারাপ থাকতো, তাকে ছেড়ে, তাকে ভুলে বাকি জীবন কাটাবে কি করে, যুবক বলরাম ভেবে পাচ্ছিলো না সেদিন। খুব সন্তর্পণে সীমান্ত পেরিয়ে ওরা ঢুকে পড়েছিলো ভারতে। কেউ কেউ চলে গেছিলো শিলঙে, অধিকাংশই চলে গেছিলো আসামে। বলরামরা ঢুকে পড়েছিলো ত্রিপুরাতে কুমিল্লা থেকে। ত্রিপুরার তিন দিক ঘিরে আছে বাংলাদেশ। তখন যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। দেশ ছেড়ে আসার পর কেউ কারোর খোঁজ খবর রাখেনি, বলা যায়, পায়নি। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, তা কেবল ভগবানই জানেন।
আজ এসব কথা, ঘটনা, শুধুই স্মৃতি যা বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে। অতীত তো আর ফিরে আসবে না, কখনোই না। সব কিছু খুইয়ে নতুন আশায় ঘর বেঁধেছিলো ওরা আবার। সহায় সম্বল, ভিটেমাটি সব কিছু খুইয়ে, উদবাস্তু, ছিন্নমূল মানুষগুলো নতুন আশা নিয়ে পেছনে ফেলে আসা রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে থাকতে চাইছিলো। অবশেষে ওরা এই পূর্ব বগাবিল গ্রামে আশ্রয় পেয়েছিলো সেদিন। বন-জঙ্গলে ঘেরা পূর্ব বগাবিল গ্রাম তার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে ওদের বুকের জ্বালা প্রশমিত করেছিলো। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খোয়াই নদী। এই নদী ওদের অনেক কিছুই দিয়েছে, আবার নিয়েও গেছে অনেক কিছু। কিন্তু এবারের মতো এত ভয়ঙ্কর, করালরূপে নদীকে ওরা আগে কখনো দেখেনি, ভাবতেও পারেনি যে কখনো এমনটা হতে পারে। বর্ষার মরসুম শুরু হবার পর অনেকদিন পর্যন্ত আকাশে, জলভরা কালো মেঘের আনাগোনা কারোর চোখে এ যাবত পড়েনি।
তারপর, সহসা আকাশে জলভরা কালো মেঘ ভিড় জমাতে শুরু করলো। খুশির হাওয়া বয়ে গেলো সবার ওপর দিয়ে। অবশেষে করুণাময় ঈশ্বর দয়া করেছেন সবার ওপর। ওরা সবাই আনন্দে মেতে উঠলো। গ্রামে নেই কোন রিং ওয়েল, মার্ক টু টিউবওয়েল। নদীর জল আর ছড়রার জলই ভরসা।
শীর্ণকায় খোয়াই নদী হঠাৎ চনমনে চঞ্চল তরুণীর মতো টগবগ করে উঠলো। বলরাম, সদাশিব, হারাধন, সাধুচরণ, বঙ্কিমের মতো সত্তরোর্ধ বুড়োদের ফোকলা দাঁতে তখন খুশির ঝিলিক। মনে মনে ওরা ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানায়। ঈশ্বর বর্ষার জলভরা কালো মেঘ পাঠিয়েছে। তা না হলে, জলের অভাবে এই পূর্ব বগাবিল শ্মশানপুরী হয়ে যেত, লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যেত এই গ্রাম।
তারপর ঝমঝম করে নামলো মুষলধারায় বৃষ্টি। উৎসাহী ছেলেপিলেরা মহানন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে এখন। কে থামাবে ওদের? ওরা কারোর কথাই শুনবে না। জলই জীবন। জল ছাড়া মাছ বাঁচে না, গাছ বাঁচে না। তাই দীর্ঘকাল ধরে নিদাঘ যন্ত্রণায় তপ্ত, কাতর মানুষগুলো আজ আবার নতুন করে বাঁচার আগ্রহ ফিরে পেল। ভিজছে মানুষ — আবালবৃদ্ধবণিতা। আদ্যকালের বুড়ি ঠানদিদির ফোঁকলা দাঁতেও খুশির ঝিলিক। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাততালি দিয়ে সুর করে গান ধরে — “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে”।
আবার কখনো কখনো বদলে যায় গানের কথা —
“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এলো বাণ,
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল
তিন কন্যে দান।”
না, কোনো বুনিয়াদি স্কুলে ওরা এসব ছড়া শেখেনি কারণ ওদের মতো হতদরিদ্র গ্রামে যে কোনো স্কুলঘরই নেই। এসব ছড়া ওরা ওদের দাদু, ঠাকুর্দা, ঠাকুরমার মুখে শুনে শিখেছে। রবি ঠাকুরের নামও ওরা কখনো শোনেনি।
— এই ছড়াটা কার রে বুল্টি? জিজ্ঞেসা করলে বুল্টি অম্লানবদনে বলে দেবে — কার আবার? আমার বুড়াদাদু হেই বানাইসে। দাদু এমনতর কত তা বানাইসে।
বুল্টি আপনমনে ঘুরপাক খায় বাড়ির চারধারে। পেছনের পচা ডোবাটা আস্তে আস্তে সতেজ হয়ে উঠছে। মৃতপ্রায় লাউগাছের চারাটাও নধর হয়ে উঠছে বৃষ্টির জল পেয়ে। এই চারাগাছটা বুল্টির মেজদি লাগিয়েছিল। সেই মেজদি কিছুদিন আগে পেটের অসুখে ভুগে মারা গেছে। লাউয়ের ডগা মেজদির খুব প্রিয় ছিলো। প্রায়ই বলতো — এই লাউগাছে একদিন অনেক লাউ ধরবে। বাবা শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবে, অনেক টাকা পাবে তারা। লাউয়ের বিঁচি পুঁতেছিলো তারও অনেক অনেক আগে কিন্তু তখনো গাছ উঠেনি। গাছ উঠেছিলো মেজদিটা অসুস্থ হবার পরে। বুল্টি বেড়া থেকে একটা ভাঙা কঞ্চি এনে লাউগাছটার পাশে পুঁতে দিলো। পরে মা’কে বলতে হবে গাছটার কথা, কেউ হয়তো এটাকে খেয়াল করেনি। বুল্টি তার বাপ সদানন্দকে ডেকে এনে গাছটা দেখায়।
— দ্যাহো বাপ্, কেমনতর অইসে হেই গাছডা।
সদানন্দের মন তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন। এই কয়েকদিনের মধ্যেই খেতের কাজকর্ম সেরে নিতে হবে। ধানের চারাগুলো এমন শুকিয়ে গেছে যে, এবার আর ভালো ফলনের আশা করা যায় না। তাও এই ধানের সামান্য খেতটুকু কারো একার সম্পত্তি নয়। আসলে এই গ্রামে চাষের জমি তেমন নেই, যেটুকু আছে তাতে সবাই মিলেই চাষ করে। তাতে ধান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ হয়, যে যার মতো করে তাতে চাষাবাদ করে। কেউ আপত্তি করে না। সদানন্দ শুনতে পায় তার বুড়ো বাপ বলরামের গলা — কই রে সদু, খুরপিটা এট্টু লইয়া আয়সে।
বলরাম এখন ধানখেতে নামবে, আগাছা পরিষ্কার করবে। মানা করলেও শুনবে না, এমনই একরোখা বুড়ো এই বলরাম। সদানন্দ ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়, অন্ধকারে খাটের তলায় হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকে খুরপি।
— কই গ্যালো কওসে? কই খুরপিডা? সদানন্দ অধৈর্য হয়ে বউকে ডাকে।
সবিতা ভেজা চুলে জট ছাড়াতে ছাড়াতে উত্তর দেয় — ইডা তো বুল্টির হাতঅ দ্যাখসিলাম মনে অয়।
বুল্টি বাপের হাতে খুরপিটা এনে দেয়। সদানন্দ জিজ্ঞেস করে — কিতা করতাসিলা ইডা লইয়া?
বুল্টি আগ্রহভরে উত্তর দেয় — হেই লাউ গাছডার গুড়িত কুপাইতাসিলাম, তলাত মাডি নাই ত।
সবিতার হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার মৃতা মেয়ের কথা। মরে যাবার আগে পুঁটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলেছিল — মাগো, আমারে এট্টু ভাত দিবানি লাউশাক দিয়া?
পুঁটির লাউচারা তখন সবেমাত্র ভীরু চোখে উঁকি দিচ্ছিল সূর্যের দিকে। গাছটা আস্তে আস্তে বড় হল কিন্তু পুঁটি আর তা দেখার জন্য বেঁচে রইলো না। আসলে সময়মতো ওষুধপথ্য কিছুই পড়েনি, তাই একসময়ে পুঁটির ছোট্ট দেহটা নিথর হয়ে গেলো। সবিতা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সদানন্দর বুক থেকে। বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিল অনেক আগেই, মেজ পুঁটি অকালেই মারা গেল। ছোটোমেয়ে বুল্টিই আজ তাদের একমাত্র অবলম্বন। ছেলের আশা করে এতগুলো বছর পার করে দিয়েছে তারা। অনেক তাবিজ-কবচ, মাদুলি নিয়েছে সবিতা, কিছুই হয় নি। সদানন্দ ভাবে, সে মরে গেলে বংশে বাতি দেবার কেউ থাকবে না। প্রথমটায় এসব ভাবলে খুব মন খারাপ হতো তার, আর মন খারাপ হলেই চোখের জল বাধা মানতো না। বৃদ্ধ বাবার মুখ চেয়ে সে ধীরে ধীরে নিজেকে সংযত করে রেখেছে নিজেকে।
— সবই ভগবানের বিচার, সদানন্দ নিজের মনে বিড়বিড় করে।
প্রথম বর্ষণের আনন্দটুকুর রেশ গ্রামবাসীদের মন থেকে মিলিয়ে গেল দ্রুত। আকাশে মেঘের ঘনঘটা বেড়ে যায় আবার। কয়েকদিন বিরতির পর জলভরা কালোমেঘেরা আবার ফিরে আসে পূর্ব বগাবিল গ্রামের দিকে। শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। গ্রামের দু’একজনের ঘরে কম দামি, শস্তা ট্র্যানজিস্টার ছিল। তারা আবহাওয়ার পূর্বাভাস শুনতে পেল — এই ভারী বর্ষণ আগামী কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হবে কারণ বঙ্গোপসাগরের বুকে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। তা সহসা অন্যদিকে সরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আপাতত নেই।
চিন্তিত, শঙ্কিত হয়ে পড়লো পূর্ব বগাবিল গ্রামের মানুষজন।
প্রথম বর্ষণ ওদের মনে আশা ও আনন্দ দুটোই সঞ্চার করেছিলো। ওরা ভেবেছিলো বৃষ্টি ওদের নতুন জীবন দান করেছে, ওরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো কিন্তু…..
অবিরাম বর্ষণের ফলে শুকনো ডোবা, পুকুর, ভর্তি হয়ে জল গড়িয়ে এল উঠানে, কচি ধানশিশুরা জলমগ্ন হতে শুরু করলো। ধান ক্ষেতে থই থই করছে জল, শুধু জল। উঠানে জল, বাগানে জল, চারদিকেই শুধু জল। বৃষ্টি বন্ধ হবার নাম নেই। ভরে গেছে শীর্ণ নদী। খোয়াই নদী ফুঁসতে আরম্ভ করেছে প্রবল আক্রোশে।
এত জল! একদিন একটু বৃষ্টির জন্য ওরা আকুল হয়ে আর্তি জানিয়েছিল ভগবানের কাছে! আর ভগবান এত বৃষ্টি দিলো!! বিপন্ন ভয়ার্ত মানুষজন দেখলো প্রথমে ডুবলো পায়ের পাতা, তারপর হাঁটু সমান জল। ক্রমশ জল বাড়তে বাড়তে কোমরের সমান প্রায়। খ’সে পড়তে লাগলো ঘরের ছনের চাল, ধসে পড়লো মাটির দেয়াল কারো কারো। ওরা আস্তে আস্তে আরো ভেতরে সরে যেতে শুরু করলো, নদীর কাছ থেকে আরো আরো অনেক দূরে। জল শুধু জল, চারদিকে থই থই করছে। এমন বর্ষা তো কেউই কামনা করে নি। এবার কেন বৃষ্টির দেবতা রুষ্ট হল তাদের ওপর? খোয়াই নদী ক্রমশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। নদীর গর্ভে একটু একটু করে জমি এ কয়দিনে তলিয়ে গেছে। এখন বাকিটুকু চেটেপুটে খেতে সহস্র জিহ্বা নিয়ে ধেয়ে আসছে রাক্ষুসী নদী। নদীর এই করাল রূপ দেখে আতংকিত হয়ে পড়লো সবাই।বৃ ষ্টি যদি একটু বন্ধ হতো!
— “আয় বৃষ্টি ঝরে যা,
নেবুর পাতা করমচা।”
বুল্টি চেঁচিয়ে বলতে থাকে বৃষ্টির উদ্দেশ্যে। ওদের সবার ঘরেই এখন কোমর সমান জল। খাটের ওপর এখন সংসার। কি যে হবে! সবিতার বুক অজানা আশংকায় কাঁপতে থাকে। বুল্টিকে খাটের ওপর থেকে নামতে দেয় না সে। একদিকে অবিরাম বৃষ্টি অন্যদিকে বন্যার জল। তাই জল কমছে না, বরং তা বাড়ছে। সদানন্দ বিপন্ন হয়ে বাপকে বলে — বাবা, আর কত্ত দেরী করতেন? চলেন আমরা অন্য কুনখানে চইল্যা যাইগা, জল নামলে আবার আইয়া পরুম নে। চলেন বাবা।
বলরামের দৃষ্টি স্থির হয়ে বাইরের দিকে — জল নামব। এট্টু ধৈর্য ধরস না রে বাপ।
সদানন্দ সবিতার মুখের দিকে তাকায়, সবিতা তার পুঁটলি গোছাতে শুরু করে। নেবার মতো যা যা আছে, সব নিয়ে চলে যেতে হবে কোন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। আশেপাশের বাড়িঘর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। তারা আরো ভেতরে সরে গেছে। এই বুড়োর জেদের জন্য সবাইকে জলে ডুবে মরতে হবে। সবিতা স্বামীকে তাগাদা দেয় বারবার। সদানন্দ আবার আসে তার বুড়ো, জেদী বাপের কাছে — বাবা, চলেন এই বার। দ্যাখতাসেন না চাইরদিকের অবস্থা? গেরামে আমরা ছাড়া আর কুনঅ মানুষ আছে নি? ইহানে পইরা থাকলে জলে ডুইব্যা মরণ লাগব। জল আর নামতো না। দ্যাখতাছেন তো?
বলরাম হতাশ ভাবে মাথা নাড়ে — গোরু বাছুরগুলারে খুইল্যা দিছস নি? অবোলা জীবগুলানরে ছাইড়্যা দিয়া যা, পলাইয়া যাক গা।
সদানন্দ বলে — আমরা হগ্গলতানরেই ছাইড়্যা দিসি বাবা। আপনে অহনে আমরার লগে চলেন।
বলরাম হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যায় — কই যাইতাম আমি? একবার বাপ ঠাকুর্দার দ্যাশ ছাইড়া পলাইয়া আইসিলাম এই দ্যাশে। ইডারেই মায়ের মতন ভাইব্যা মনে লইসিলাম। এই দ্যাশ এই মাডি ছাইড়া আমি আর কুনখানেই যাইতাম না বাপ। মরণ আয়ে তো মরুম ইহানই। তুরা যা গিয়া, তাড়াতাড়ি চইল্যা যা। নইলে হগ্গলেরই মরতে লাগব।
শুনে সদানন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবার কথাটা মিথ্যে নয় কিন্তু তারা তো আর চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে না। বন্যার জল নেমে গেলে আবার ফিরে আসবে। বাবা বড় অবুঝ, কিচ্ছু বুঝতে চায় না।কেন যে জেদ ধরে বসে আছে! আশেপাশের বাড়িঘর প্রায় জনশূন্য। বাবা একলা থাকবে কি করে!
সবিতা বুল্টিকে কোলে নিয়ে আবার ডাকে — চলেন না বাবা, দেরী অইতাসে তো!
বুল্টিও তার কচি গলায় ডাকে — অ ঠাকুর্দা, যাইতানা নি? আমরা হগ্গলে তুমারে ফালাইয়া যাইতাসি গিয়া। আইয়ো না তাড়াতাড়ি।
বলরাম নড়ে না, উত্তর ও দেয় না। কিছুক্ষণ পরে, সে লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ায়। বলরামের একমাত্র ছেলে সদানন্দ, ছেলের বউ আর নাতনি আর দেরী করে না। সদানন্দ নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে — বুড়া হইয়া বাপের মাথাডা এক্কেবারে গ্যাছে। পাগলের মত ভিটামাডি আঁকড়াইয়া বইয়া রইলো। আরে, আগে তো মাইনসে নিজের প্রাণের কথা চিন্তা করে। তারপরে না ভিটামাডি! বাপের জন্য তার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাপ এত জেদ করছে কেন?
সবিতা বুল্টিকে কোলে নিয়ে আর সদানন্দ পুঁটলি মাথায় নিয়ে, খুব সাবধানে জল ভাঙতে ভাঙতে এগোতে থাকে। অনেকটা দূর যেতে হবে তাদের। তাদের মতো আরো অনেকেই শেষ সম্বলটুকু আঁকড়ে বেরিয়ে পড়েছে কোন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। সদানন্দের মন খারাপ হয়ে গেছে। সে বেশ বুঝতে পারছে এ জীবনে আর বাপের সাথে তার দেখা হবে না। বুড়ো নিজের জেদেই জলে ডুবে মরবে। তবু শেষবারের মতো বাপকে দেখার জন্য সে পেছন ফিরে তাকায়।
বলরাম তার লাঠি হাতে ঘরের দাওয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে কারোর ঘরের চাল, ঘর গেরস্থালির জিনিসপত্র, গাছের ডাল, আরো কত কি। সদানন্দরা ক্রমশ দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। বুড়ো আর দেখতে পায় না তাদের। ওরা চলে গেছে, বেঁচে গেছে। যখন জল নামবে, তখন ফিরে আসবে। বলরাম ভাবতে থাকে কবে যে এই জল নামবে, কবে যে আবাদী হবে মাটি! কবে যে জীবনের চেনা ছন্দে ফিরবে তাদের গ্রাম! ভগবান কেন বারবার তাদের পরীক্ষায় ফেলছে? ওদেশে থাকতে দাঙ্গা আর এ দেশে ভয়াল ভয়ংকর বন্যা।
বলরাম এখন একেবারে একা, অসহায়, নিঃসঙ্গ। সে দেখতে পায় চারদিকে শুধু জল আর জল। দেখতে পায় রাক্ষুসী নদী একে একে সব কিছু গিলে নিচ্ছে — একের পর এক বাড়িঘর, ধানক্ষেত সব কিছুই। বড় বড় কয়েকটা গাছ কোনোমতে গলা সমান জলে মাথা তুলে ধুঁকছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে। বিড়বিড় করে বলে — ঠাকুর, একবার নিজের দ্যাশ ভিটা সব ছাইড়া আইসিলাম। এই মাডি, দ্যাশডারে জনমভূমির মত মনে করসিলাম। আইজ, হেই মাডিরে ছাইড়া আবার কুন দ্যাশে যামু? হেই মাডিই তো আমরারে এত বচ্ছর খাওয়ন দিসে। মরতে অইলে মরুম হেই মাডিরে আঁকড়াইয়া, আমার মা’র বুকেই।
বলরামের কাছে এই মাটিই তার মা। এই দেশের এই মাটিই তাকে মায়ের মত এতগুলো বছর আগলে রেখেছে, মুখে দু’ মুঠো অন্ন তুলে দিয়েছে। হোক না খাসের জমি। সরকার তো তাদের এখান থেকে তুলে দেয়নি। ওদের মতো হাজারো উদবাস্তুদের তো এই দেশ ফিরিয়ে দেয়নি বহিরাগত বলে। ওরা এই মাটিতেই এতগুলো বছর বেঁচে রয়েছে। সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও যেটুকু পেয়েছে, তাতেই ওরা খুশি। ভাত কাপড় আর মাথা গোঁজার আস্তানা, মানুষগুলো এতেই সন্তুষ্ট। তার ছেলের জন্মও এই মাটিতেই। আর তার স্ত্রী এই মাটিতেই মিশে গেছে।
কি থেকে কি হয়ে গেল! একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে বলরাম। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশে ফেলে আসা ঘরবাড়ির ছবি, বাবা মায়ের মুখ, হারাধন মাস্টার, করিম, লায়লার মুখ। এ জন্মে আর তাদের সাথে দেখা হবে না। একমাত্র ছেলের মুখও আর কি সে দেখতে পাবে!
বলরামকে ঘিরে ঘুরপাক খায় উদ্দাম জলরাশি। তার কোমর ছাপিয়ে জল আরো ওপরে উঠতে থাকে। বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে বলরাম টের পায় তার পায়ের তলার মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। রাক্ষুসী নদীর গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে পুরো গ্রাম। গত কয়েক বছর ধরেই নদীর দু’পাড়ে ভাঙন ধরেছিল, নদীর গর্ভে তলিয়ে গেছিলো তাদের অনেক জমি। যেটুকু অবশিষ্ট ছিলো, আজ তাও চলে যাচ্ছে। হয়তো এভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই উদবাস্তুদের গ্রামটা, অতীতের গর্ভে। তবু মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে বলরাম। এই মাটিই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল একদিন। এই ত্রিপুরার জল, মাটি, বাতাস তাকে নতুন জীবন দিয়েছিল। তাকে ফেলে সে আর কোথায় চলে যাবে? মরতে হলে মরবে এই মাটিতেই, অন্য কোথাও নয়।
বন্যার জল আরো বাড়তে থাকে। ক্রমশ বলরামের সত্তরোর্ধ দীর্ঘ শরীর ডুবে যেতে থাকলো। তবু বলরাম বাঁচার জন্য শেষ অবলম্বন, সামান্য খড়কুটো পর্যন্ত আঁকড়ে ধরলো না।
— মা! মাগো মা! বলরামের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার আগে শেষবারের মতো শুধু এই দুটো শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়েছিল। তারপর সব মিলিয়ে গেল চারদিকে বুদবুদ তুলে।
উদ্ধারকারী নৌকাটা যখন এসে পৌঁছালো, ততক্ষণে কিছুই নেই। বলরাম তলিয়ে গেছে।
— কই? কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। কোন মানুষজনের চিহ্নই নেই। মনে হয় সবাই সরে গেছে, একজন বলে ওঠে।
— কিন্তু লোকটা যে বলছিলো একটা বুড়ো মানুষ বাড়িতে জলবন্দী হয়ে আটকে রয়েছে!
— কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না! খালি জল। চল, সামনে গিয়ে দেখি।
চারদিকে শুধু জলোচ্ছ্বাসের আওয়াজ। তীব্র আক্রোশে ছুটে চলেছে দুরন্ত নদীর উদ্দাম জলরাশি।