ফুটবলে অনন্ত প্রেম (ছোটোগল্প)
শুভংকর নিয়োগী
চমকাইতলায় ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’-এর ফুটবল মাঠটি বড়োই উপযুক্ত। ঘন সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ, যেন সবুজ গালিচা পাতা। প্রতি বছর বর্ষার শেষে আরম্ভ হত শিল্ড-টুর্নামেন্ট। সেখান থেকেই ফুটবলে প্রেম অনন্তর। সে সুযোগ ও সময় পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা-একাই বল নিয়ে প্র্যাকটিস করত। সে এক অনাবিল, অনির্বচনীয় আনন্দে কী এক অমোঘ নেশায় অবশ হয়ে থাকত তার মন! ফুটবলে কিছু একটা করতে হবে, এই ভাবনায় ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে মন কেমন ব্যাকুল হয়ে থাকত!
ফুটবল বডি-কন্টাক্ট গেম। তাকে ভালোবেসে, শ্রদ্ধা-ভক্তি করে দেবতার আসনে মনে মনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। তারপর নিজের মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অদম্য জেদ, নিরলস পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় প্রয়োগ করে ক্ষিপ্রতা, স্কিল, কন্ট্রোল আর টেকনিক আয়ত্ত করতে পারলেই ফুটবল হয়ে যায় অনুগত; এমনকি জানা যায় তাৎক্ষণিক কী ঘটতে চলেছে!
তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে ‘নেতাজী নগর শ্রীপতি শিক্ষা সদন’ স্কুলে পড়ত অনন্ত। স্কুল লাগোয়া সন্ধিপুর গ্রাম আরম্ভ করল একটি ‘শিল্ড টুর্নামেন্ট।’ প্রথম তিনটি খেলাতেই জয়লাভ করে স্কুল পৌঁছে গেল সেমি-ফাইনালে। সেমি-ফাইনাল খেলা পড়ল ‘স্কুল’ বনাম ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’। মানে অনন্তর স্কুলের বিরুদ্ধে অনন্তর গ্রাম। আবার ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’-এর অধিনায়ক অনন্তর বড়দা। সে সদর্পে ঘোষণা করে অনন্তকে বলল, ‘তুই আমাদের ক্লাবের হয়ে খেলবি!’ অনন্ত স্কুলের অধিনায়ক হওয়ার সুবাদে ‘নেতাজী নগর শ্রীপতি শিক্ষা সদন’-এর এত এত স্টুডেন্টস তার মুখের দিকে আছে তাকিয়ে। তাদের এত ভলোবাসা, এত আনন্দ, এত কৌতূহল উপেক্ষা করে কী করে! স্কুলের সব শিক্ষক মহাশয়রা, এমনকি স্কুলের বর্ষীয়ান, স্বনামধন্য, প্রণম্য গেম-টিচার, স্বয়ং কেশববাবু এতবড়ো একটা দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিয়েছেন, তাঁদের সকলের কথা অমান্য করে কী করে!
পুরো ঘটনাটি অনন্ত তার বাবাকে জানানোর পর, বাবা বললেন, ‘তুই স্কুলের হয়েই খেলবি।’ তার বাবার মুখ থেকে অনন্তর মনের কথাটি জানার পর, দাদাকে তার বাবার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে জানিয়ে দিল।
পরিণামে অনন্তকে ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’ এবং কাদড়ার চমকাই-তলার ফুটবল মাঠ থেকে বহিষ্কৃত হতে হল।
প্রথম সেমি-ফাইনাল খেলা। ‘স্কুলকে’ হারাবে বলে ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’, বিষ্ণুপুর ও তার লাগোয়া খড়কেশুলি থেকে কয়েকজন বেছে বেছে ভালো ফুটবল খেলোয়াড় বরো করে নিয়ে এল। খেলা শেষে ফলাফল দাঁড়াল 0-0; অর্থাৎ ড্র।
খেলার নিয়মানুযায়ী প্রথম নব্বই মিনিট ড্র থাকলে পরের ত্রিশ মিনিট খেলা হবে। তাতেও ড্র থাকলে টাই-ব্রেকারের মাধ্যমে জয়-পরাজয় নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সেদিন সন্ধিপুরের কর্মকর্তারা ঘোষণা করেছিলেন, ‘এত ভালো খেলা সাধারণত দেখা যায় না গ্রামে-গঞ্জে! যতদিন না নব্বই মিনিটে খেলার নিষ্পত্তি হয় ততদিন এই খেলা চলবে! তাই এই খেলা আজকের মতো স্থগিত। পরে খেলার তারিখ জানানো হবে।’ মনটা যেন জয়োল্লাসে উন্মত্ত হয়ে নাচতে লাগল অনন্তর।
কাদড়া গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। প্রতিদিন এই পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হয়। স্কুল যাওয়ার পথে অতিক্রম করতে হয় অনেকটা ডাঙা। সুশান্ত ও নব তার অন্তরঙ্গ সহপাঠী বন্ধু। ডাঙার মাঝে সুশান্ত প্রশ্ন করল, ‘তোর মতলবটা কী রে?’ অনন্ত দোটানায় ভুগছিল। প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল! আমতা আমতা করে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কঠিন সমস্যায় পড়েছি! গোল দেওয়া এবং খাওয়া দু’টোই কষ্টকর। গোল দিলেও আমার গায়ে লাগবে আবার গোল খেলেও আমার গায়ে লাগবে!’
অনন্তর কাতর বাক্য শুনে সুশান্ত বলল, ‘হে ফুটবল-প্রেমী-অনন্ত! বল খেলার মাঠ একটি যুদ্ধক্ষেত্র, সেখানে হারজিত তো আছেই! খেলার মাঠে ভালো খেলে জেতাটাই আসল কথা। সেখানে বিপক্ষ কে এসব দেখলে চলে না। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের মাঠে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথাগুলো একবার ভেবে দ্যাখ! রণাঙ্গনে ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বলে কেউ নেই। জয়-পরাজয় চিন্তা না করে যুদ্ধ করাই যেমন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, তেমনি জয়-পরাজয় চিন্তা না করে ভালো খেলাটাই প্রকৃত ফুটবলারের ধর্ম। কর্মফলের স্পৃহা ত্যাগ করে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করাটাই একপ্রকার ধর্ম। কাজেই তোর উচিত নিজ কর্মে নিবিষ্ট হওয়া। তোর ঐ দুরন্ত স্কিল, দুর্দান্ত গতি, অসাধারণ ড্রিবলিং স্কিলস আর মাথার জাদু দেখার জন্যে হাজার হাজার লোক তাকিয়ে আছে! মন থেকে দুর্বলতা দূর করে ফুটবলের প্রতি একাগ্রতা হয়ে অনুশীলন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোই একমাত্র কর্তব্য ও কর্ম বলে আমার মনে হয়!’
নব এতক্ষণ সুশান্তর কথাগুলো মন্ত্র-মুগ্ধের মতো শুনছিল। আর থাকতে না পেরে বলল, ‘তুই যে অনন্তকে ওভাবে তাতাচ্ছিস, একবারও কী ভেবে দেখেছিস, যে ফুটবল খেলাটার কথা বলছিস; সেই খেলাটা কাদড়া গ্রামের চমকাইতলা ফুটবল মাঠ থেকে শিখেছে! কাদড়াতে ওর জন্ম, কাদড়াতে ওর খেলার জন্ম, কাদড়া ওর হৃদয়, কাদড়া ওর প্রাণ, আজ কাদড়া হেরে গেলে লোকে ওকে ছি-ছি করবে! নেপাল-কা, অজিত-দা, মথুর-দা এনাদের ফুটবলের অবদানগুলো ভুললে চলবে! লক্ষ্মী-কা না থাকলে ও বুট কিনতে পারত! অবশ্য ও তাকে একটা নাইলন সুতো দিয়ে মাছ ধরার জাল বুনে দিয়েছিল। প্রতিবছর চমকাইতলা ফুটবল মাঠে শিল্ড-টুর্নামেন্ট না হলে এ-খেলার অনুপ্রেরণা পেত কোথা থেকে?
নবর মুখ থেকে একরকম কথা কেড়ে নিয়ে সুশান্ত বলল, দ্যাখ্ নব, দুটো দল শক্তিশালী না হলে সাধারণত জিনিয়াসদের চেনা যায় না, ভালো খেলাটা বেরিয়ে আসে না! হাজার হাজার দর্শক শুধু যে তাদের প্রিয় দলের জয় দেখতে আসে তা নয়; ফুটবলে বিভিন্ন স্কিল ও টেকনিক দেখার জন্যে মাইলের পর মাইল হেঁটে আসে কত দর্শক। ফুটবলে পায়ের জাদু কিছু কিছু দেখা যায় গ্রামে-গঞ্জে। কিন্তু মাথার জাদু কী জিনিস, ক’টা লোক দেখেছে! বলটা মাথায় নিয়ে ক্রু…ক্রু…ক্রু…ক্রু…ক্রু.. ড্রাম বাজানোর মতো ঢু…ঢু…ঢু…ঢু…ঢু.. করে বলটা মাথায় নাচানো, ক’টা লোক দেখেছে! তারপর বলটা মাথায় নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হেড দিয়ে, মাথা চেলে নিজেদের ও বিপক্ষদলের খেলোয়াড়দের মাথার ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার ইউ-আকৃতির টার্ন নিয়ে নিজের মাথায় নিয়ে আসা, এরকম অবিশ্বাস্য অথচ বাস্তব ঘটনা, ক’টা লোক দেখেছে! একবার নয় বারবার। বারবার। বায়ুর প্লবতাকে কেন্দ্র করে, প্রাণায়ামের সাহায্যে কীভাবে বাতাসে ভেসে থাকা যায়, ক’টা লোক দেখেছে! সেজন্যেই কেশববাবু দুঃখ করে বার বার বলেছেন, ‘অনন্তর বল খেলায় যা দক্ষতা, তা সে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা রাখে! কিন্তু আমাদের সে সুযোগ নেই। আমরা দুঃখিত, অনুতপ্ত।’
মোক্ষম চালটা চেলে বসল নব, ‘তবু বলব, কাদড়া গ্রাম আমাদের মায়ের সমান। কথায় বলে, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী, আমি শুধু একবার তোদেরকে মনে করিয়ে দিলাম।’
অনন্ত ওদের দুজনকে থামাবার জন্যে বলল, ‘ধর, যদি গোল না দিই এবং গোল না খাই, তাহলে কেমন হয়!’ ওরা দু’জনেই তার কথাটা লুফে নিয়ে বলল, ‘দারুণ সিদ্ধান্ত।’ অনন্ত মনে মনে বলল, ফুটবলে কখন যে কী হয় কেউ জানে না! মুখে বলল, ‘দেখা যাক কী হয়!’
দ্বিতীয় দিনেও ড্র।
তৃতীয় দিনে ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’ মেদিনীপুর থেকে ‘ইলেভেন বুলেটস’-এর পনেরো জনের একটি টিম বরো করে নিয়ে এল খেলার একদিন আগে। পুকুরের মাছ, মাঠের শাকসবজি আর বাড়ি বাড়ি চাল, ডাল, তেল, নুন নিয়ে তাদেরকে চর্ব্য, চষ্য, লেহ্য, পেয় করে দু’দিন ধরে খাওয়াল। তা শুনে হেডস্যার শ্রী ভাস্কর রায় মহাশয় ক্লাসে ঘোষণা করে বললেন, ‘অনন্ত যদি স্কুলকে কোনও শিল্ড এনে দিতে পারে তাহলে আমি তাকে কলকাতায় ভালো কলেজে ভরতি করে দেব।’ সে এক অসাধারণ খেলা হল গোলশূন্য। পরের বার ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’ আর খেলতে আসেনি। ফলে ওয়াকওভার পেয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেল স্কুল অনায়াসেই। কিন্তু সন্ধিপুর গ্রাম থেকে শিল্ড আনতে পারেনি মূলত অনন্তর দুর্বলতার জন্যেই। সে জন্যে সে ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে তার লক্ষ ছিল ‘জগন্নাথপুর’ মাঠ।
সেই বছরেই ‘জগন্নাথপুর’ মাঠে দুর্দান্ত ড্রিবলিং স্কিলস আর দুরন্ত গতিতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্সকে চুরমার করে অসাধারণ ফুটবল খেলে স্কুলে এনেছিল ‘শিল্ড’। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট-আউটের পর হেডস্যার তাঁর কথা মতো কলকাতায় ‘সিটি কলেজ অব কমার্স এন্ড বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন’ কলেজে ভরতি করে দিলেন অনন্তকে। তারপর তিনি ফিরে গেলেন গ্রামে। অনন্ত ও তার সহপাঠী অজিত রয়ে গেল। কারণ অজিতের ভর্তির জন্যে কেমিস্ট্রি-অনার্সের রেজাল্ট আউট হয়নি তখনও ‘সিটি কলেজ’ মেন-এ। তারপরের দিন থেকেই শুরু হল অবিরাম বৃষ্টি। ১৯৭৮ সালের সেই বন্যার দিন কুড়ি পরে গ্রামে ফিরে বরো হয়ে বল খেলতে গেল মহেশপুর মাঠে। খেলার মাঝে তার বাম পায়ের পিছনে, হাঁটুর নিচে মানে কাফ মাসেলে বুটের ডগায় করে সজোরে মারল লাথি বিপক্ষ দলের এক খেলোয়াড়। সে তীব্র আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। রেফারী ও লাইন্সম্যান চ্যাংদোলা করে রেখে দিয়ে এল মাঠের বাইরে। সে দাঁড়াতে পারছিল না কিছুতেই। বুঝে ওঠতে পারছিল না যে কী করে বাড়ি ফিরবে। এমন সময় কোথা থেকে হঠাৎ এসে হাজির সেই অজিত! প্রথমে সে তার সাইকেলে করে তাকে নিয়ে গেল শিলাবতী নদীর ধারে। তারপর কাঁধে করে প্রায় ত্রিশ ফুট খাড়া উঁচু শিলাবতী নদীর পাড় কী করে যে পার করিয়েছিল তা ভাবলে আজও তার শরীর শিউরে ওঠে! সেখান থেকে আবার সাইকেলে তাদের ‘গড়বেড়িয়া’ গ্রামের বাড়িতে। সেখানে তাদের বাড়িতে চার দিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল, কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি। বেঁচে থাকো অজিত। তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
কলেজে ক্লাস শুরু হল কলকাতায়। এখানে স্নেহ নেই, মায়া নেই, মমতা নেই, থাকার জায়গা নেই, খাবার পয়সা নেই, অসুস্থ হাঁটু নিয়ে দেখাতে যায় ‘মেডিকেলে,’ তারপর ‘স্টুডেন্টস হেলথ হোমে।’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘অপারেশন করাতে হবে। বাড়ির লোককে নিয়ে এস।’ কিন্তু মূলত বাড়ির লোকের সম্পূর্ণ অসহযোগিতায় তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বস্তুত ঘরের শত্রু যদি বিভীষণ হয় সেখানে জেতা প্রায় অসম্ভব! নিজের অজান্তেই হার নামক শব্দটি কপালের লিখন হয়ে যায়। মহাকাব্যে রামায়ণের পরম পরাক্রমশালী শিবভক্ত রাবণ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেননি ঘরশত্রু বিভীষণের জন্যে, আর অনন্তের ঘরে ছিল তিন তিনটে বিভীষণ! ভাবা যায়! কাজেই সর্বক্ষেত্রে হার অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াল!
ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অন্তহীন হতাশায় আর অব্যক্ত বেদনায় ঘুরে ফেরে ভবঘুরে উদ্ভ্রান্ত অনন্ত।
১৯৯৪ সালে যেদিন বিশ্ব সুন্দরী হলেন সুস্মিতা সেন, সেদিন সাংবাদিকরা জিঞ্জেস করলেন, ‘আপনার মতো আরও অনেক সুন্দরী ছিলেন কিন্তু তাঁরা হতে পারলেন না, তাঁদের সম্বন্ধে কী বলতে চান?’ সুস্মিতা সেন উত্তর দিলেন, ‘যাঁরা বিশ্ব-সুন্দরী হতে পারলেন না, তাঁরা যেন একটুও ভেঙ্গে না পড়েন! অনেক লাইন আছে! কোনো একটা লাইন চুজ করে যেন সেদিকে চলে যান।’ কথাটা শুনে অনন্ত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মনে মনে ভাবল, এই সহজ সরল বাস্তব সত্যি কথাটা যদি আজ থেকে পনেরো বছর আগে কেউ শোনাত তাহলে তাঁর জীবনটা অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে পারত!
কখনো-কখনো জীবনে একটা ভুল সিদ্ধান্ত, একটা ভুল কাজ, একটা ভুল জেদ এবং কাছের তৃতীয় জন থাকলে জীবনকে বিপর্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট! আসলে টিন-এজ বয়সের সুস্থ চিন্তা-ভাবনার আংরাগুলিকে উস্কিয়ে দেবার জন্যে কমপক্ষে এমন একজনের প্রয়োজন; সে বাবা, মা, ঠাকুমা, দাদু, ভাই, বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা কোচ, যে কেউ হোক না কেন, পিঠে হাতটি রেখে, সঠিক পথটি দেখিয়ে দিয়ে বলবে, তুমি এগিয়ে চল, আমি আছি। যাদের কপালে জোটে তাদের জীবন তরতর করে এগিয়ে যায়; যাদের কপালে জোটে না তাদের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, কটাক্ষ, বিদ্রূপ এসব সহ্য করে, উপেক্ষা করে, এগোতে এগোতে অনেক দেরী হয়ে যায়। তখন তার আর কিছু করার থাকে না। অনন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর হতভাগা একজন।
অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে যখন ব্যর্থতার কারণগুলি খোঁজার চেষ্টা করছিল অনন্ত, ঠিক সেই সময় কানাই এসে হাজির। কানাই-মানে কানাই শীল। যে ছিল ফুটবল মাঠের রাইট উইঙ্গার, অনন্তর প্রধান ভরসা। তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে আগমন। প্রায় আটত্রিশ বছর পরে মুখোমুখি দেখা। চেহারার আমূল পরিবর্তন। চেনা যায় না বললেই হয়। কথার স্বর শুনে চিনল।
রাত্রিবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে শুতে যাবার সময় কানাই বলল, ‘তোর কাছ থেকে আমার কয়েকটা কথা জানার আছে! যা আমি প্রায় আটত্রিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি!’ অনন্ত শুতে শুতেই বলল, ‘তা তোর প্রশ্নগুলো আগে শুনি!’
— গড়বেতার মাঠে খেলার শেষার্ধে শূন্যে বলটাকে তিন-চারবার পাক খাইয়েছিলি কী করে? যেটা গোলে ঢুকবে ঢুকবে করেও ঢুকল না!
— সন্ধিপুর মাঠে সেমি-ফাইনাল খেলাতে তুই যখন থ্রো-ইন করতে গেলি তখন এক মুসলমান ভদ্রলোক তার সাদা লম্বা দাড়ি, মাথায় সাদা টুপি, পরনে সাদা পাজামা, সাদা পাঞ্জাবী পরা দাদু, তোকে কী বলেছিলেন?
— তুই বলটা আমাকে থ্রো-ইন করে তোর মাথায় রাখতে বললি! আমি তাই করলাম। কিন্তু আমি দেখলাম যে তুই বলটা মাথায় নিয়ে একের পর এক খেলোয়াড়দের মাথার উপর দিয়ে পাঠিয়ে বলটা আবার ইউ-টার্ন নিয়ে তোর মাথায় ফিরিয়ে নিয়ে এলি কী ভাবে? প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে একুশ জন প্লেয়ারের যে-যার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না! এটা কী করে সম্ভব? তারপর বলটা মাথায় নিয়ে ক্রু…ক্রু…ক্রু…ক্রু…ক্রু… ড্রাম বাজানোর মতো ঢু…ঢু…ঢু…ঢু…ঢু… করে বলটা অতক্ষণ ধরে মাথায় নাচিয়ে ছিলি কী ভাবে?
— আর!
— আর সন্ধিপুর মাঠে সেমি-ফাইনাল খেলার দিনে তুই আমাদের গোল-লাইনে গিয়ে একটা গোল বাঁচানোর পর, কেশববাবু যখন ‘আক্রমণ’ বলে একটা হুঙ্কার ছাড়লেন তখন তুই বাঁ-পায়ে বলটাকে ধরে ‘কানাই’ বলে একটা ডাক দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে পাঠালি। এই ডাকটার অর্থ শুধুমাত্র আমিই জানি। আমি গতিবেগ বাড়িয়ে বিপক্ষ দলের টাচ-লাইন ও গোল-লাইনের সংযোগস্থলে গিয়ে হাজির হয়ে বলটাকে ধরে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে বলটাকে উঁচুতে ভাসিয়ে মারলাম। তুই দুরন্ত গতিবেগে ছুটে গিয়ে মাটিতে ভর দিয়ে গোলপোস্টের বারের ওপর লাফিয়ে শূন্যে চিৎ হয়ে ভেসে রইলি। আমি বলটা তোকে উদ্দেশ্য করে পাঠালাম। তুই বলটা বুকে করে ধরে যখন সোজা হলি তখন বলটাকে পায়ে করে একটু ঠেলে দিলেই গোল হত, কিন্তু তুই তা করলি না কেন? একবার বলটা ড্রপ খেল তুই তখনও শূন্যে, দ্বিতীয়বার ড্রপ খাওয়ার পর গোলকিপার বলটা ধরল। মানে কিছুই ভাবতে পারছি না! একটু খোলসা করে বল!
অনন্ত একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগল, ‘আর্কিমিডিসের নীতি ও প্লবতাকে কেন্দ্র করে জলের প্লবতা ও প্রাণায়ামের বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে উপলব্ধি করে যে জলের মতো বায়ুও একটি ঊর্ধ্বমুখী ঘাত বা বল প্রয়োগ করে। এই বায়ুর প্লবতাকে ফুটবল মাঠে প্রয়োগ করার জন্যে নিজের মনে মনে চিন্তা করে। দেখা যায়, বাতাসের অভিমুখে বল মারলে বাতাসের গতিবেগ ও বলের গতিবেগ একসঙ্গে মিশে বলের গতিবেগকে বাড়িয়ে দেয়, তখন বল দ্রুতবেগে ধাবিত হয়। পক্ষান্তরে বাতাসের বিপরীত অভিমুখে বল মারলে বলকে বাধা দেয় বাতাস। এখন বাতাস যদি জোরে প্রবাহিত হয় এবং বলকেও যদি বাতাসের বিপরীত অভিমুখে সজোরে মারা হয় তাহলে জোরে প্রবাহিত বাতাস বলকে বাধা দেয়! বলও যেহেতু প্রবল গতিবেগে ধাবিত হয়, সেহেতু বল বাতাস ভেদ করে যাবার চেষ্টা করে! দুটি বস্তুর মধ্যে প্রবল গতিবেগ থাকায়, কেউ কাউকে হারাতে না পেরে বল তর্ তর্ করে ওপর দিকে ওঠতে আরম্ভ করে, একদম রকেটের মতো, হাঁ করে দেখার মতো! একসময় বলের গতিবেগ শেষ হয়ে যায়, কিন্তু বাতাসের গতিবেগ থাকে, তখন পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের জন্যে বল মাটির দিকে নামতে আরম্ভ করে। যখন জোরে বাতাস দেয় তখন তার গতিবেগ কিন্তু এক থাকে না। কিছুটা কমে তো পরক্ষণেই আবার বাড়ে। আবার কমে, আবার বাড়ে। এই কমা, বাড়া, বায়ুর প্লবতা এবং পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের ফলে, বল একরকম পাক খেয়ে খেয়ে নিচে নামতে আরম্ভ করে। সেদিন এভাবেই গড়বেতার মাঠে গোলপোস্টের অনেক উঁচু থেকে বলটা পাক খেয়ে খেয়ে নিচে নামতে নামতে ক্রসবারের ওপর এসে যখন বলটা গোলে ঢুকব ঢুকব করে, গোলকিপার দু’-তিন বার লাফিয়েও যখন বলটাকে কব্জা করতে পারে নি; ঠিক সেই সময় একটা দমকা বাতাস এসে বলটাকে ঠেলে ক্রসবারের বাইরের গায়ে স্পর্শ করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। গোল হয়নি ঠিকই; কিন্তু অসংখ্য করতালি আর বাহবা ধ্বনিতে সারা মাঠ মুখরিত হয়। তারপর দর্শকরা আনন্দ আর বিষ্ময় নিয়ে কী দেখলাম, কী দেখলাম বলে বাড়ি ফেরে!’ আর একটা ঘটনা বলি! চমকাইতলার ফুটবল মাঠটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এক শিল্ডটুর্ণামেন্ট ম্যাচে সেমি ফাইনাল খেলার দিনে মাঠের উত্তর দিকের পেনাল্টি বক্সের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটু বাইরে একটি ডাইরেক্ট ফ্রি কিক পেল অনন্ত। সে বলটিকে দু’হাতে করে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ধরে ঠিক জায়গায় বসাল। এবার বলটি থেকে সোজা দক্ষিণে দশ হাত দূরে কিক করবে বলে উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়াল। এ পর্যন্ত বলে কানাইকে জিজ্ঞেস করল, ‘বলতো যদি গোল করতে হয় তাহলে সে বলটিকে কোন পায়ে মারবে?’ কানাই একটুও সংকুচিত না হয়ে বলল, ‘কেন, বাম পায়ে!’ অনন্ত একটু থেমে বলতে লাগল, ‘শুধু তুই কেন! বিশ্বের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়রাও একবাক্যে বলবে বাম পায়ে কিক করবে?’ কানাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাম পা দিয়ে মারেনি?’ অনন্ত বলল, ‘না, শোন তাহলে! তখন সে বাতাসের গতিবেগটা দেখে নিয়েছে! বায়ু কোণ থেকে অগ্নি কোণে বইছে বাতাস! শ্রী নেপাল ঘোষ মহাশয়, সম্পর্কে আমার কাকাবাবু, যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খেলা পরিচালনা করছেন। মানে তিনি রেফারি ছিলেন। কিক করার জন্যে বাঁশি বাজালেন।
অনন্ত দুরন্ত গতিবেগে ছুটে এসে বামপাটাকে বল থেকে এক হাত পশ্চিমে রেখে ডান পায়ের গোড়ালিটাকে ঘুরিয়ে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে সজোরে মারল। তার সেই কিক দেখে সারা মাঠ অট্টহাসিতে ভরে গেল! বল বাতাসে তর তর করে ওঠে গেল গোললাইনের ওপরে। তখনো দর্শকবৃন্দ অট্টহাসিতে মশগুল। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে অট্টহাসি মানেই কিছুক্ষণের জন্যে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ! সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার আগেই গোলকিপার সহ সব খেলোয়াড়রা এবং দর্শকবৃন্দ দেখল যে বাতাসে বাঁক খেয়ে ইনসুইং করে ঠিক পুব দিকের গোল পোস্ট ঘেসে গোলে ঢুকে গেল বল! তা দেখে সারা মাঠ বিষ্ময়ে নিস্তব্ধ, পরক্ষণেই অনুধাবন করে হাততালিতে ভরে গেল মাঠ! রবীন্দ্রদা ছুটে এসে অনন্তর পিঠে হাত চাপড়ে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘সাবাশ, অসাধারণ গোল।’ এই সেই রবীন্দ্রদা যার কথা না বললেই নয়! রবীন্দ্রদা ছিল এক অনবদ্য নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার। যার ওপর ভরসা করা যায়। অনন্ত সময় পেলেই একা একাই বল নিয়ে কঠোর অনুশীলন করত। ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীলন করছে দেখে রবীন্দ্রদা বাড়ি থেকে পানীয় জল বয়ে নিয়ে এসে অনন্তকে পান করাত।’ বেঁচে থাকো রবীন্দ্রদা। তোমার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
আরও একটা ঘটনা! গোল দেওয়ার পর যে গোল করে তার তখন আনন্দে সারা শরীর উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটে ওঠে তারুণ্যের রক্ত। এমন সময় দুরন্ত গতিবেগে ছুটে প্রথমে দম ভরে শ্বাস নিয়ে তারপর পুরো শ্বাস ছেড়ে রণাঙ্গনের ভূমিকায় বায়ুর প্লবতাকে ভর করে মাটি থেকে প্রায় পাঁচ ফুট ওপরে লাফিয়ে বাতাসে দাঁড়িয়েছিল ওই অনন্ত। বংশী পাল অনন্তর বাম পায়ের পাতা দু’ হাতে করে ধরে ঝুলেছিল, তবুও অনন্তকে বাতাস থেকে নামাতে পারেনি! খানিক পরে অনন্ত নিজেই মাটিতে নেমে এসেছিল। নেপালকা সমেত সব খেলোয়াড়রা তা দেখে বিষ্ময়ে হতবাক!
কানাই কথাগুলো কেমন ভাবে নিচ্ছিল তা বোঝার উপায় নেই। কারণ লাইট অফ করে দুজনেই শুয়ে। দুজনের নিস্তব্ধতা ভেঙে অনন্ত ডাকল, ‘কিরে কানাই! ঘুমিয়ে গেলি নাকি!’ কানাই তার ভুল ভেঙে দিয়ে বলল, ‘এরকম কত অলৌকিক ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছি! আর যেগুলো দেখিনি সেগুলো তোর মুখ থেকে না শুনলে আমি বিশ্বাসই করতাম না! কাজেই এসব কথা শোনার পর আর ঘুম ধরে!’ অনন্ত, ‘হুঁ’ বলে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই কানাই জিজ্ঞেস করে বসল ‘দ্বিতীয় প্রশ্নটা?’
‘মুসলমান ভদ্রলোক দাদু বলেছিলেন, ‘ভাই তোমার নাম আমি অনেক শুনেছি, তোমার খেলা দেখব বলে আমি দশ মাইল রাস্তা হেঁটে এসেছি। আমায় একটু খেলা দেখাও ভাই?’ অনন্ত তার মাথার ভেল্কি দেখিয়েছিল মাত্র। যেটা শুধু ঠিক টাইমে মাথা চেলে বলটিকে প্রথমে দাদুর মাথার ওপর দিয়ে পাঠিয়ে ইউ আকৃতির টার্ন নিয়ে আবার নিজের মাথায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, এভাবে এক এক করে নিজেদের ও বিরুদ্ধ দলের কয়েকজন খেলোয়াড়দের মাথার ওপর দিয়ে বল পাঠিয়ে আবার নিজের মাথায় নিয়ে এসেছিল যেটা অবিশ্বাস্য অথচ বাস্তব যা বার বার অভ্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মনোযোগ সহকারে বার বার অনুশীলন করা। তারপর বলটি মাথায় নিয়ে বার বার মাথায় একই জায়গায় ড্রপ খাওয়ানোর ফলে বলটি একরকম হয়ে যায় অনুগত। ঠিক সেই সময় দম ভরে শ্বাস নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলটিকে মাথার একই জায়গায় রাখলে ক্রু…ক্রু…ক্রু…ক্রু..করে ড্রাম বাজানোর মতো ঢু…ঢু…ঢু…ঢু…ঢু…. করে নাচতে থাকে। শুধু লক্ষ্য স্থির রেখে অনুশীলনের পর অনুশীলন করা।
‘অবিশ্বাস্য, অথচ বাস্তবে আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা কেমন করে অবিশ্বাস করি?’ কানাই কথাটি বলতে বলতে বিছানায় ওঠে বসে বলল, ‘আর শূন্যে অতক্ষণ ভেসে থাকা?’
‘ওটা বায়ুর প্লবতা ও প্রাণায়ামের সংমিশ্রণ। প্রাণায়াম মানে শ্বাস নেওয়ার থেকে শ্বাস ছাড়ার টাইমটা বাড়াতে হবে আর শূন্যে চিৎ হয়ে শুতে হবে। বলা-বাহুল্য বায়ুর গভীরতা বাড়ালে বায়ুর প্লবতাও বাড়বে, ভাসতে সুবিধা হবে।’
কানাইয়ের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা নেই দেখে অনন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে! কিছু বলছিস না যে!’
কানাই একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘মান্নাদের সেই গানটাই মনে পড়ছে, ‘কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম’, তোর এত বড়ো স্বপ্ন, এত বড়ো স্কিল, এত বড়ো দক্ষতা, ফুটবল যার প্রাণ, ফুটবল যার হৃদয়, একসঙ্গে সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল!’
অনন্ত নিজের অবচেতন মন থেকে বলতে লাগল, ‘মায়ের অভিশাপ এভাবে তার গায়ে লাগবে বুঝতে পারেনি!’ কানাই তড়াক করে বিছানা থেকে ওঠে বসে বলল, ‘মানে!’ অনন্ত কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, বলল, ‘ছাড়!’ কানাই একরকম জেদ ধরে বলল, ‘তা কেন? এটাও তো জীবনের অঙ্গ!’
অনন্ত একটু থেমে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতে লাগল, ‘মহেশপুর মাঠে বল খেলতে যেতে দিতে চায়নি মা। ফুটবলে অনেক বড়ো হতে হবে এই স্বপ্নে সে বিভোর ছিল। কলকাতায় বড়ো ক্লাবে খেলবে এই ভাবনায় সে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছিল সেটা বাড়ির কেউ কোনোদিন বোঝার চেষ্টাই করেনি। ফুটবল খেলেও যে অনেক বড়ো হওয়া যায় সেটা তাদের মাথায় কোনোদিন আসেইনি। ফুটবলের যে একটা বৃহৎ জগৎ আছে সেটা তাদের একেবারে চিন্তা-ভাবনার বাইরে। কাজেই মায়ের কথা অমান্য করে যাবার জন্যে উদ্যত হতেই মা বলেছিল, ‘এই যেন তোর শেষ খেলা হয়।’ এর আগেও তো মায়ের কত কথা অমান্য করেছে, কোনোদিন কিছু হয়নি। কিন্তু সেদিন অভিশাপে জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
মায়ের কথা যখন উঠল তখন একটা কথা না বললেই নয়! মহাদেববাবু ক্লাসে অংক করাচ্ছেন। ফুলুই সংলগ্ন কয়াপাট ও বদনগঞ্জ থেকে পড়তে আসা স্বপন ও রামপ্রসাদ নামে দুই সহপাঠী অনন্তর পাশে বসে। স্বপন চুপি চুপি বলল, ‘ফুলুই ক্লাব থেকে পাওনা তোর অনেকগুলো প্রাইজ আছে!’ প্রাইজের কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে ওঠল অনন্তর। ক্লাস শেষ হতেই রামপ্রসাদও বলল, ‘তোর নামে অনেকগুলো প্রাইজ আছে। কাদড়া ক্লাবের ক্যাপ্টেনকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আগামী রবিবার বিকাল চার টার সময় পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান হবে, চিঠি না পেলেও তুই চলে যাবি।’
অনন্তর বড়দা ক্যাপ্টেন। মানে নামেই ক্যাপ্টেন। কোন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার মতো দক্ষতা ছিল না। অনন্তর প্রতি হিংসায় সে অন্তরে অন্তরে কুটিল চক্রান্ত করত যেটা অনন্ত কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। বাড়িতে এসে বড়দাকে জিঞ্জেস করতেই সে অস্বীকার করে বলল যে ওসব বাজে কথা। রবিবার দিন পাড়ার সুকুমারদা মানে ‘কাদড়া ফুটবল ক্লাব’ এর লেফট উইঙ্গার হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে বলল যে সে কয়াপাট গিয়েছিল। ফুলুই ক্লাবের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা হল, বলল যে তোকে তাদের ক্লাবের মাঠে নিয়ে যেতে, সেখানে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনি হবে। ‘চল আমি তোকে সাইকেলে করে নিয়ে যাব।’ সেকথা শুনে বড়দা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘আমি ক্যাপ্টেন আমি জানি না!, কাজেই তুই যাবি না।’ সুকুমারদা বড়দাকে লক্ষ্য করে বলল যে তুই সত্যি করে বলতো কোনো চিঠি পাসনি! বড়দা সেরকম দীপ্ত কণ্ঠে বলল যে সে কোনো চিঠি পায়নি। সুকুমারদা একরকম ঘৃণার স্বরে বলল যে তোর মতো দাদা যেন কেউ না পায়, বলে সে চলে গেল।
প্রায় চল্লিশ বছর পরের ঘটনা। অনন্ত কলকাতা থেকে মাঝে মাঝে বাড়ি যায়। মাটির বাড়ির নিচের এক আলমারিতে দেখে যে এক কাপড়ের বান্ডিলে মোড়া চার পাঁচটা মেডেলের মতো! বান্ডিলটা নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা এটা কিসের বান্ডিল?’ মা পঁচাশি বছর বয়সে ফোগলা মুখে আনন্দে গদগদ হয়ে এক গাল হেসে বলল, ‘হায়রে, তোকে আমি বলতে ভুলে গেছি, ওগুলো লক্ষী পাল দিয়ে গেছে আর বলেছে, তুই ছোটোবেলায় যখন ফুলুই-এ বল খেলতে গিয়েছিলি তখনকার প্রাইজ। তোর বড়দা ওগুলো তার বাড়িতে রাখতে বলেছিল।’ অনন্ত কিছু বলতে যাবার আগেই আবার হেসে হেসে বলতে লাগল, ‘ওগুলো বাড়িতে রেখে কি হবে? আমি এক ফেরিওয়ালকে দেখিয়েছি, ওগুলোর দাম আড়াইশো টাকা দেবে বলেছে, বিক্রি করে দিই বল!’ সব ছেলেই তো চায় যে তার মা সারাজীবন এরকম মুখে মধুর মিষ্টি হাসি নিয়ে বেঁচে থাকুক। তার জন্যে সব ছেলে নিজের সব সুখদু:খ জলাঞ্জলি দিয়ে হাজার কষ্টের বোঝা অনায়াসে সারাজীবন বইতে পারে। কোনো বড়ো কাজ একদিনে হয় না মা, এক মাসেও হয় না, এক বছরেও হয় না। কিন্তু একদিন ঠিক হয়। বছরের পর বছর ধরে দীর্ঘ অনুশীলন করতে হয়। তার জন্যে দরকার জেদ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, একাগ্রতা আর সঠিক অনুশীলন। আর সব বড়ো কাজের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে বৃহৎ ও মহৎ শিল্পের বীজ মা! সে সেই জায়গাটা খোঁজার ও পাওয়ার চেষ্টা করেছিল মা, মনে মনে আরো বলল যে, যদি একটু ছেলের মনের খবর রাখতে মা তাহলে প্রাণটা আজ এত না পাওয়ার হতাশায় হা-হুতাশ করত না! একটা প্রাইজ জীবনে যে কতবড়ো স্বর্গসুখ এনে দেয় যদি বুঝতে মা! এই প্রাইজগুলোর পেছনে কত মেহনত, কত পরিশ্রম, কত ঘাম ঝরাতে হয়েছে মা, যদি একটু খবর রাখতে! এই প্রাইজগুলো তার কাছে এক একটি বুকের পাঁজর। কিন্তু কী অবহেলায়, কী অনাদরে, কী অবজ্ঞায়, কী অযত্নে গড়াগড়ি খাচ্ছে মা! অবশ্য এর জন্যে অর্থনৈতিক দুরবস্থাও অনেকখানি দায়ী। একরাশ সুগভীর হতাশা ও অনন্ত দুঃখ নিজের বুকে চাপা দিয়ে, প্রণাম করে মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, মা তাই করো!’ বলে প্রাইজের বান্ডিলটা আর হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে কলকাতায় ফিরে গেল।
গরীবদের জীবনসংগ্রামে চলার পথে অভাব, অপুষ্টি, অসহযোগিতা এবং কুটিল চক্রান্ত সব একটি একটি মস্ত বড়ো বাধা। তবুও নিজের মনের অদম্য জেদ, নিরলস পরিশ্রম আর নিষ্ঠায় এগুলোকে অতিক্রম করা যায়; কিন্তু মানব মনে কু-প্রবৃত্তি আর হিংস্র মনোবৃত্তি থাকলে তাকে রোধ করবে কীভাবে?
ছোটোবেলা থেকে অনন্তর মনে বড়ো আশা ছিল; বড়ো স্বপ্ন ছিল; বড়ো ফুটবলার হবে; তাহলে যশ হবে; খ্যাতি হবে; সম্মান বাড়বে; বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে; সর্বোপরি একজোড়া বুটের জন্যে কারও দয়ার ওপর তাকিয়ে থাকতে হবে না! সব কুঁড়িরই তো স্বপ্ন থাকে যে সমাজে ফুল হয়ে সৌন্দর্যে বিকশিত হবে! সহাস্যে পরিস্ফুষ্ট হবে! সুবাসে ভরে উঠবে মঠ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা! নামের সুবাসে পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে উজ্জ্বল নক্ষত্র! কিন্তু তা আর তার হল না। তার সুনিপুণ, অবিশ্বাস্য অথচ বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনাগুলি সযত্নে বড়ো আশায় ভরা স্বপ্নের থলির মধ্যে হৃদয়ের অন্তস্থলের এক কোণে গচ্ছিত রেখেছিল! হঠাৎ এক লহমায় যেন এক অনামি সুনামি এসে বড়ো আশায় ভরা স্বপ্নের থলিটিকে করে দিল লণ্ডভণ্ড! আশা-হতাশায়, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নে, আর হতাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল ভবিষ্যৎ! ব্যর্থতার দুর্বিষহ যন্ত্রণায় জীবনে নেমে এল বিভীষিকা! সে জানতে পারল না তার কী অপরাধ! ফুটবল থেকে হয়ে গেল নির্বাসন-দণ্ড! তখন থেকে দুঃখ, বেদনা আর সুগভীর হতাশায় সব যেন শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছিল তাকে! কিছুতেই পারছিল না সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে! আজ আটান্ন বছর বয়সে বল নিয়ে প্র্যাকটিস করতেই শৃঙ্খল-মুক্ত হয়ে যেন ফিরে পেল সেই ‘ফুটবলে অনন্ত প্রেম!’