গোবর্ধনের ট্রেনিং (ছোটদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
মা বলেছিল, প্রফুল্ল দোকান থেকে আড়াইশ গ্রাম মুড়ি কিনে আনতে। আমি সেদিকেই যাচ্ছিলাম। এই দোকানের মালিকের নাম প্রফুল্ল। সবাই এই দোকানকে প্রফুল্ল দোকান বলেই ডাকে। আমাদের এখানে আরো কিছু দোকান আছে। যেমন বুড়া দোকান, নতুন দোকান, অবিনাশ দোকান, নারু দোকান ইত্যাদি। এই নামগুলি আসলে লোকজনদের দেওয়া নাম।
দোকানে যাবার পথে দেখলাম দুটো ক্র্যাচ নিয়ে গোবর্ধনদা রাস্তায় এক পায়ের ওপর ভর করে কষ্ট করে হেঁটে চলেছেন। দেখে আমার ভারী কষ্ট হল। আহা, উনি কোথায় আবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট করে বসলেন।
আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে কাছে গিয়ে বললাম, গোবর্ধনদা, আপনার এ অবস্থা হল কী করে? আপনার তো ভারী কষ্ট হচ্ছে দেখছি।
গোবর্ধনদা যেন করুণ সুরে হেসে বললেন, হ্যাঁ হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে বৈকি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন এখন?
গোবর্ধনদা বললেন, এক কেজি আলু আর এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে যাচ্ছি।
আমি বললাম, আমিও দোকানে যাচ্ছি মুড়ি কিনতে। আপনাকে কষ্ট করে আর যেতে হবে না। আমি আপনার জিনিস এনে দিচ্ছি । আপনি কোথাও গাছতলাতে বসুন। ব্যাগ আর টাকাটা আমাকে দিন।
— খুব ভালো কথা, বেঁচে থাকো ভাই।
গোবর্ধনদা আমাকে ব্যাগ আর টাকা দিয়ে দিলেন।
আমি দোকানে গিয়ে মুড়ি, আলু, পেঁয়াজ সব কিনে ফিরে এলাম। গোবর্ধনদা তখন এক গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন।
কাছে গিয়ে গোবর্ধনদাকে ধরে উঠিয়ে দিলাম। আলু-পেঁয়াজের ব্যাগটা এবং ফেরত আসা টাকাপয়সাগুলি গোবর্ধনদাকে দিলাম। কিন্তু ব্যাগ সহ ক্র্যাচ দিয়ে এক পায়ের ওপর ভর করে হাঁটতে গিয়ে একটু মুশকিলে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু অনুরোধ করলেন, ব্যাগটা একটু পৌঁছে দিয়ে সাহায্য করবে হাবু ভাই ?
— হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন পৌঁছে দিচ্ছি। বলেই আমি গোবর্ধনদার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। তারপর দুজনে হাঁটতে লাগলাম।
গোবর্ধনদার হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী করে পায়ে চোট পেলেন?
গোবর্ধনদা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলেন, আমার কিছুই হয়নি। চোট লেগেছে দাদার পায়ে। বাড়ির বারান্দা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। এক পায়ে বেশ চোট পেয়েছে। এখন বিছানায়।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না, পায়ে চোট পেয়েছেন হর্ষবর্ধনদা, অথচ ক্র্যাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন গোবর্ধনদা।
গোবর্ধনদা আবার বললেন, এরকম আগেও একবার দাদার পায়ে চোট লেগেছিল। তখনই এই ক্র্যাচ দুটো কেনা হয়েছিল যেটা এখন আমার হাতে আছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হর্ষবর্ধনদার পায়ে চোট, অথচ আপনার কিছুই হয়নি তবু ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটছেন।
গোবর্ধনদা আরো গম্ভীর হয়ে বললেন, দাদা বলেছে, ভবিষ্যতে আমারও পায়ে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে, তাই আগে থেকে এক পায়ে চলার ট্রেনিং নিয়ে রাখতে। তাই দাদার কথামতো ক্র্যাচ নিয়ে চলছি।
কিছুক্ষণ চলার পর গোবর্ধনদা বললেন, ধুত্তোরি, এভাবে চলতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এক কাজ করি, ব্যাগটা আমার কাছে দাও, তোমাকে আর যেতে হবে না। আমি দু পায়েই হেঁটে যাচ্ছি। বাড়ির কাছে এলে আমি আবার ক্র্যাচ দিয়ে এক পায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকবো। তুমি বাড়ি চলে যাও।
দেখলাম, গোবর্ধনদা ক্র্যাচ দুটোকে বগলে চেপে ব্যাগ হাতে হন হন করে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আমিও বাড়ির পথ ধরলাম। মা হয়তো আমার অপেক্ষা করছে।