হর্ষবর্ধনের স্বদেশীয়ানা (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
মা আমাকে চা পাতা কেনার জন্যে দোকানে পাঠিয়েছিলেন। আমি বুড়োর মুদি দোকানে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছি তাই। আমার সামনে তিনজন ক্রেতা। এইসময় টের পেলাম কেউ আমার কাঁধে হাত রেখেছে। পেছনে তাকালাম। দেখলাম আমার পিছেই গোবর্ধনদা। হেসে গোবর্ধনদা বললেন, দাদার জন্যে সাগুদানা নেবো।
উত্তরে বললাম, আমার ঠাকুর্দাও খেতেন। একাদশীর দিনে।
গোবর্ধনদার উত্তর শুনলাম, না না, দাদা একাদশী করে না। দাদা স্বদেশী করে।
কথাটা শুনে আশ্চর্য হইয়ে বললাম, স্বদেশী! কী করে করেন?
— সাগুদানা খেয়ে।
আমি জানি না কেউ সাগুদানা খেয়ে কীভাবে স্বদেশী করে থাকেন। সবসময় আমার জানার আগ্রহ প্রবল। আমি তাই গোবর্ধনদাকে চেপে ধরলাম, স্বদেশী কীভাবে করা হয় আমি দেখবো।
আমার কথা শুনে গোবর্ধনদা মাথা নাড়লেন, উহু সেটা তো দেখা যাবে না।
— কে-কেনো?
— কারণ, তখন একটা ভর হয় কিনা।
— ভর? কীসের, কখন, কেনো?
— সব কথা তো বলা যাবে না।
উত্তর শুনে বেশ নিরাশ হলাম। আমার অবস্থা দেখে গোবর্ধনদা নীচু স্বরে বললেন, তবে একটা ব্যবস্থা করতে পারি।
— কী ব্যবস্থা?
— তোমাকে জানালার এক কোণে ঘরের বাইরে চুপিচুপি দাঁড় করিয়ে দেব। কিন্তু কোন আওয়াজ করা চলবে না। পর্দার আড়ালে তুমি বাইরে থেকে দেখবে, মানে যতটুকু দেখা যায় তাই দেখবে।
আমি রাজী হয়ে গেলাম। চা পাতার ঠোঙাটাকে পকেটে ভরে নিলাম। মা হয়তো আমার অপেক্ষা করছে। বাড়ির দিকে না গিয়ে আমি গোবর্ধনদার সঙ্গে চললাম। যেতে যেতে গোবর্ধনদা আমাকে বোঝাতে লাগলেন, দাদা বলেছে যে স্বদেশী মানে হচ্ছে অহং। মানে সব নিজের। নিজের স্তোক, নিজের আচার, নিজের বিচার, নিজের উত্থান, নিজের পতন, নিজস্ব ভর — এইসব আর কি। একদিন দাদার কাছে সব বুঝে নিও।
গোবর্ধনদার বাড়ির সামনে আসতেই দেখলাম, গোবর্ধনদাদের প্রধান দরজার পাশের দেয়ালে একটা কাগজ টাঙানো রয়েছে। সেই কাগজে লেখা আছে, খাসবাব। এই কাগজটা আগে ছিল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি বাড়ির নাম?
— হ্যাঁ।
— কিন্তু খাসবাব। এর অর্থ কী আমি তো জানি না।
— সে আরেকদিন বুঝাবো। এখন আমার সঙ্গে আস। বলে গোবর্ধনদা হাত ধরে টেনে নিয়ে আমাকে এক জানালার বাইরে দাঁড় করিয়ে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁকে দেখো। তবে সাবধান, দাদা যেন তোমাকে না দেখে। বলে গোবর্ধনদা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন।
আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পনের-কুড়ি মিনিট হয়ে গেল। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজই পাচ্ছিলাম না। একটু অধৈর্য হয়ে উঠলাম। আমি জানালার পর্দাটা একটু তুলে ভেতরের দিকে তাকালাম। দেখলাম হর্ষবর্ধনদা সাদা গামছা পরে খালি গায়ে চোখ বন্ধ করে সিদ্ধাসনে বসে আছেন। সামনে একটা লাল ছোট্ট গামছার ওপরে একটা পাথর। হয়তো এই পাথরটা হর্ষবর্ধনদার ইষ্ট দেবতা। তারও সামনে একটা প্রদীপ আর একটা ধূপকাঠি জ্বলছে।
হঠাৎ গোবর্ধনদা বাটি হাতে ঢুকলেন। হয়তো এই বাটির মধ্যেই সাগুদানা দিয়ে তৈরি কোনো কিছু আছে।
গোবর্ধনদা বাটিটা প্রদীপের কাছে রাখলেন। তারপর বললেন, রাখলাম দাদা, এবার শুরু করো। হর্ষবর্ধনদা চোখ খুললেন। বললেন, গোবরা রে, আজ তো আমার একদম ভাবই হচ্ছে না। ভর হবে কী করে ?
— তাহলে কী হবে দাদা। এত কষ্ট করে তুমি স্বদেশীটা আবিষ্কার করলে।
— বোকা কোথাকার, আমি আবার আবিষ্কার করলাম কবে। এসব তো সব আমার স্বপ্নাদেশ।
— ওই একই হল। তাহলে এখন কী করব বলো।
— সব গুটিয়ে নিতে হবে। তারপর বেশ করে কষা মুরগির মাংস খেয়ে আচ্ছা করে একটা ঘুম দেব।
— তাহলে স্বদেশী কি বাদ?
— আরে না না। আরেকদিন হবে। তার আগে একটা যজ্ঞ করতে হবে। দেখি সেজন্যে আজ কোনো স্বপ্নাদেশ আসে কিনা।
যজ্ঞের কথা শুনে গোবর্ধনদা মহাখুশি। বলল, যজ্ঞ? সে দারুণ ব্যাপার হবে দাদা। তুমি তাড়াতাড়ি স্বপ্নটা দেখে ফেল। সেদিন আমি চার-পাঁচজনকে নেমতন্ন করবো। সবাই মিলে পাঁঠার মাংস খাবো।
গোবর্ধনদা বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে বললেন, আজ স্বদেশী হচ্ছে না। তুমি এখন বাড়ি যাও। যজ্ঞের আয়োজন হচ্ছে একদিন। সেদিন তোমাদের নেমতন্ন।
ভেতরের সব কথাই আমি শুনেছিলাম, তাই জিজ্ঞেস করলাম, কবে আসব?
— কবে সেটা তো বলতে পারছি না।
— ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
বাড়ির পথে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম, স্বদেশী মানে হচ্ছে অহং। মানে সব নিজের। নিজের স্তোক, নিজের আচার, নিজের বিচার, নিজের উত্থান, নিজের পতন, নিজস্ব ভর — এইসব।