অ্যাডভান্টেজ আনম্যারেড দেশপ্রেমী – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

অ্যাডভান্টেজ আনম্যারেড দেশপ্রেমী    (রম্যরচনা)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

গল্প লিখেছে নীলুদা।
নায়ক কোন এক রামচন্দ্র। দেশপ্রেমী। অবিবাহিত। দেশই তার ধ্যান, জ্ঞান। এবং যৌবনও।
দেশকে ভালোবাসে প্রাণ দিয়ে। প্রচুর স্ট্রাগল করে গ্রাম থেকে উঠে এসেছে রাজপথে। গল্পে তেমনই আছে।
ছেলেবেলায় রামচন্দ্র স্বপ্ন দেখত স্বপ্নের মতো দেশ তৈরি করবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্রের নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশবাসীর মুখে মুখে। সারা দেশ জুড়ে তৈরি হয়েছে তার স্বচ্ছ ইমেজ।
রামচন্দ্রের নামে পথে নামে দেশবাসী, তার কথা শুনে দেয় তালি। কখনও শঙ্খ, কখনও বাজায় থালি।
নীলুদার গল্প যেন এক রূপকথার কাহিনি।
সেই রামচন্দ্র দেশবাসীকে একটা দেশের মতো দেশ উপহার দিতে চায়। তার নানান কর্মকাণ্ড। প্রাণ উজাড় করে লিখেছে সব কথা নীলুদা।
অবশেষে সেই অবিবাহিত রামচন্দ্র সফল হয়। দেশবাসী ধন্য এমন এক মানুষকে পেয়ে।
খুব সহজ কথায় এটাই নীলুদার গল্পের সারমর্ম। এ গল্প আমাকে শুনিয়েছিল দিন কয়েক আগে।
গল্প শুনছিলাম মন দিয়ে। মাঝে মধ্যে ‘অবিবাহিত’ শব্দটি নায়ক রামচন্দ্রের নামের আগে পরে এসে বসছে অনেকটা পাকা ফজলি আমে মাছি বসার মত। একবার নয়, বারবার। বহুবার।
বাধ্য হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিলাম নীলুদা রামচন্দ্র অবিবাহিত হবার প্রয়োজন কি? মানে বিবাহিতরা কি দেশপ্রেমী হতে পারে না?
সেই মুহূর্তে গল্পে ছিল ইমোশন। নীলুদার পাঠে ভীষণ মোশান। তবুও ব্রেক কষে।
খাতা থেকে চোখ না তুলেই বলে, দেখ সংসারী লোকের দ্বারা কিছুই হয় না। হবেও না লিখে রাখ।
এইটুকু বলেই থেমে যেতেই পারত। তা না করে আরো দু চার কথা আনে টেনে।
বলে, সারা দিন ছেলে, বউ, সংসার, নেই নেই, আন আন, কোথায় গেলে, ফোনে কার সঙ্গে অত গল্প, বাড়ি ফিরতে দেরি কেন, কথা কাটাকাটি তাতেই হাল শোচনীয়। তা দেশের কাজটা কখন করবে শুনি?
একটা আচ্ছা দেশ তৈরি করতে গেলে কয়েক কাঠা বাড়িতে জীবন সীমায়িত হলে চলবে না। সে জীবনের ব্যাপ্তি কোথায়?
সংসারী লোক যেন পাথর চাপা ঘাস। বউয়ের দাস।
রক্ত নেই শরীরে। সাদা। নিষ্প্রাণ।
হবে সে রামচন্দ্রের মত অকুতভয়, নির্লোভ আর উদার প্রাণ?
যুক্তি দারুণ। নীলুদার মুখে হাসি। তৃপ্তির প্রতিভাস। মানে আমার প্রশ্ন স্ট্রেট ব্যাটে খেলে ভীষণ খুশি।
বললাম, বেশ বেশ।
পড়ে চলেছে নীলুদা।এইবার কাহিনি পাঠে আরো উৎসাহী। আমার প্রশ্নের জব্বর উত্তর দেওয়ার ব্যাপারটা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ এর কাজ করেছে। তাই গলার স্বর কিছুটা উঁচুতেই হাঁটছে। নিখাদ দেশপ্রেমের কাহিনি বর্ণময়। চড়াই উতরাই পার হয়ে অবশেষে রামচন্দ্র দেশনেতা হয়। গল্প শেষ হল। নটে গাছটা মুড়োল। বল কেমন হোল? জিজ্ঞাসা আমাকে।

যদি এক কথায় বলতে বল তাহলে বলব নিতান্তই সাদামাটা সেকেলে কাহিনি। আমি বললাম।
মানে? নীলুদার প্রশ্ন।
মানে তোমার এই গল্প কেমন সেই অজ গ্রামের বারোয়ারি পুজোর মতো। বোধন, আছমন, কলাবউ, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, হালোজিনের আলো।
রাতে দুটো পটকা ফুটলো। দুগ্গা পুজো শেষ।
বড্ড সাবেকি। ঝা চকচকে ব্যাপারটা নেই। মানে একদমই নেই।
তাছাড়া দেশপ্রেম বিষয়টাও ঠিক আধুনিক মোড়কে আসেনি। সেই কবেকার পুরানো ভাবনা। ব্রিটিশ তুমি ভারত ছাড় মার্কা। সে সব এখন আর চলে না।
মানে গতের ভাবনা। তোমার রামচন্দ্র ব্রিটিশ দেখলো। দুম করে বোমা ছুঁড়লো। দুহাত আকাশে তুলে দেশের নাম নিল। এটা কি দেশপ্রেম?
নয়! বলে নীলুদা।
দুর। ম্যারমেরে গল্প। এখন ওই সব কথা কেউ শুনবে? রাশি রাশি নীতিকথা গল্পে উপুড় করে দিয়েছ।
মর্ডান ছাঁচে ফেল। তবেই না লোকে আজকাল যা দেখছে তার সঙ্গে কাহিনি রিলেট করতে পারবে। নয়তো লাভ কি লিখে।
বলি, তুমি কাহিনির মুখ ঘোরাও অন্যদিকে। অবিবাহিত আর দেশপ্রেমী এই দুই শব্দের আধুনিকীকরণ করলেই হবে। তাহলে তোমার ভাবনা অন্য মাত্রা পাবে।
অবিবাহিত আর দেশপ্রেমের আধুনিকীকরণ? ট্রেনের টাইম টেবিল নাকি, যে এইসব পরিবর্তন হবে?
প্রশ্ন ছুঁড়ে নীলুদা চেয়ে আছে আমার দিকে।
অবশ্যই, দেশপ্রেমের কনসেপ্ট কি আছে আর আগের মতো?
— নেই?
— ধুর। কবেই বদলে গেছে।
— বেশ বল, শুনি।
হাত গুটিয়ে বসে নীলুদা।
আমি বলি, নীলুদা দেশপ্রেম এখন অনেকটা শেয়ার বাজারের মতো। চেঞ্জ করে এবেলা ওবেলা। দেখতে পাবে যদি রাখ চোখ খোলা। তবুও বুঝিয়ে বলি।
দেখ আমার দেশে এখন অনেক ‘মত’ পাশাপাশি চলছে। ধর রামচন্দ্র, বীরেন্দ্র, যোগেন্দ্র, ইকবাল সাহেব এরা সবাই দেশের কথাই বলছে। তবে নিজেদের মতন করে। এরা সবাই দেশপ্রেমী আপন আপন ঘরে।
এখন দেখতে হবে এই মতের মেলায় তুমি আছ কার সাথে। যদি তুমি রামচন্দ্রের সঙ্গে থাক, তবে রামচন্দ্র আর তার অনুগামী ছাড়া বাকিরা দেশদ্রোহী।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ। তুমি দেশপ্রেমীর দলেই রইলে।
এইবার ধর বিকাল বেলায় বীরেন্দ্র রামচন্দ্রের মতে হ্যাঁ দিল। মানে বেকায়দায় পড়ে রামচন্দ্রের হাত ধরল। দুপুরেও হতে পারে ব্যাপারটা। তাহলে সেও এবার দেশপ্রেমীদের দলে ঢুকলো। বুঝলে? মানে সকালে যাকে রসিয়ে দিয়েছিলে গালি, দুপুরে ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে মেনে নিলে সে দেশপ্রেমী, দিলে তালি। আর আনন্দ হলে বাজাতে পারো থালি।
মানে দেশপ্রেমী আর দেশদ্রোহী এই ট্রানজিসনটা যখন তখন হতে পারে। আনপ্রেডিক্টেবল অ্যান্ড রিলেটিভ। তোমার কাছে ভালো, আমার কাছে মন্দ।
নীলুদা চুপ। ভাবছে কিছু।
আমি বলি এখানেই শেষ নয়। যদি ইকবাল সাহেব, রামচন্দ্র, বীরেন্দ্র, যোগেন্দ্র সবাই একই ভাবনা ভাবে, হবে না কোনো দিন, তবুও ধর। ধরতে কি আছে ক্ষতি, তবে জানিনা সেইদিন দেশের কি হবে গতি। কারণ সবাই মিলেছে তো, বোঝা অসম্ভব কি স্বার্থ আর কিই বা মতিগতি।
নীলুদা, ছেলেবেলায় বইতে পড়েছ যা, দিন বদলের হওয়ায় দেশপ্রেম নয় তা। দেশ আর প্রেম বহু দূরে দূরে গায়ে গায়ে নেই তারা। দেশ আজও আছে প্রেম নেই শুধু, কবেই হয়েছে হওয়া।
কাজেই পুরনো ভাবনা ছাড়। তোমার চিন্তা ভাবনা মডিফাই ও ম্যাগনিফাই কর। মানে মোদ্দা কথাটা হোল, চোখ কান সব খোলা রেখে লেখালিখি কর। তবেই ছবিটা পারফেক্ট হবে। রিয়াল এসেন্সটাও আসবে।
নীলুদা গম্ভীর। মুখে চিন্তার মেঘ।

— আর তোমার আইবুড়ো রামচন্দ্র নিয়ে যেটা বলবো যে…।

— এই, আইবুড়ো শব্দে আমার আপত্তি আছে।

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে নীলুদা। বরং অবিবাহিতই থাক। ওটাই গল্পে ভাল যাচ্ছে। আইবুড়ো বলিস না।
বেশ তাই থাক। তবে অবিবাহিত রামচন্দ্রকে তুমি যেভাবে দেখেছ, সেটাও চেঞ্জ করতে হবে। ভিশনটা মডিফাই করে এমন ভাবতে পরো, শোন…।
আনমারেড-রামচন্দ্র। অ্যাডভান্টেজটা তোমায় নিতে হবে। নয়তো তোমার গল্পে লোকটাকে শুধু শুধু অবিবাহিত রেখে লাভ কি তবে।
এইবার আমার কথা শুনে দৃশ্যতই অবাক নীলুদা। বলে অবিবাহিত হবার সুবিধা আছে সে তো তোকে বললাম। এর পরেও সুবিধা! সেটা কেমন?
আরে তোমার ওই সব পলকা যুক্তি! বলি আমি।
সময়ের সাথে চল এগিয়ে, তাতেই ছাঁচে ছাঁচে সব মিলেবে। তোমার ভাবনা ভেরি সিম্পল। কেন বলি। দেশপ্রেমিক বলতেই আমাদের চোখে ভেসে আসে একটা ছবি।
মিথ্যের সাথে নয়কো আপস, সত্যের পথে চলা।
নিজের স্বার্থ ভুলে থেকে শুধু দেশের কথাই বলা।।
থাকবে না স্ত্রী, না থাকে ঘর, থাকবে না তার সন্তান। দেশবাসী হবে প্রিয়জন তার আর এ দেশটাই সংসার।।
এক্সাক্টলি, এক্সাক্টলি এটাই তো আমি বলেছি গল্পে।
স্মিত হাসির উঁকি নীলুদার মুখে।
হ্যাঁ, বলেছ। তবে সে মান্ধাতার আমলের কথা। লোকে কেন শুনবে সেটা!
বিষয়টা অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে হবে ভাবতে। নতুন কোন কনসেপ্ট যদি নাই দিলে তবে আর পাঁচটা গল্পের থেকে তোমার কাহিনি আলাদা কোথায় রাখলে। এই সব পাট পচানো গল্প পড়বে কে। আচ্ছা ধর যদি এই ভাবে…।
নীলুদার দৃষ্টি স্থির আমার মুখে।
বিবাহ মানেই সংসার। ছেলেপিলে। ভবিষ্যত। চিন্তা। দুশ্চিন্তা। দুর্বলতা। বন্ধন এবং অবধারিত বদনাম।
অর্থাৎ বিবাহ আর দেশপ্রেমের মাঝে বদনাম ব্যাপারটা চোর কাঁটার মতই চলেই আসে। নিঃশব্দে। তখন লোকে আঙুল তুলবে। তুলবেই। অন্তত আমাদের দেশে তো বটেই। বলবে যতই দেশপ্রেমী হোক, সঞ্চয় নিশ্চয় আড়ালে আছে। সে দেশে না হলেও বিদেশে। মোট কথা সংসার যখন আছে, সঞ্চয় তো থাকবেই। আর অবধারিত চরিত্রে কালি। রামচন্দ্র কলঙ্কিত। বিরোধীরা দুর্নীতির অভিযোগে তুলে আনন্দিত। স্বাভাবিক।

নীলুদা কিছুটা তাল হারিয়ে ফেলেছে। বলে এখানে বিরোধী আসবে কোথা থেকে!
বাহ, তুমি দেশ তৈরি করছ। সবাই কি তোমার সঙ্গে থাকবে নাকি?
থাকবে না! ভালো কাজ। সবাই রামচন্দ্রের পাশেই দাঁড়াবে।
না। রামচন্দ্র একা হিরো হবে, বাকিরা কি ঘাস কাটবে? ওই সব দিন শেষ। তখন বীরেন্দ্র, যোগেন্দ্র, ইকবাল সাহেব সবাই তোমার বিরোধী।
আচ্ছা, একটা কথা বল এই যাদের নাম করলি বীরেন্দ্র আর কি কি যেনো, এরা আসবে কোথা থেকে? বলে নীলুদা।
এরা তো তোমার রামচন্দ্রের সঙ্গেই এসেছে। দেশের ভালো চায়। এমন মানুষ একজন কখনো হয়! এরা রামচন্দ্রের পাশাপাশিই হাজির হবে। এবং…।
এইবার এই এতজন দেশহিতৈষীর মধ্যে কলকে পেতে হলে তোমার ইমেজটাও ইউনিক করতেই হবে, নয়ত পাবলিকের মাঝে পপুলার হবে কিভাবে। কাজেই অবিবাহিত বিষয়টা অন্য ভাবে ভাব।
রামচন্দ্রের সংসার, স্ত্রী পুত্র, কন্যা নেই। তবে কিসের সঞ্চয়? কার জন্য সঞ্চয় ? অর্থাৎ রামতা যোগী বহেতা পানি। তুললো ঝোলা চলল ভোলার মতো ব্যাপার। তাকে সন্ন্যাসী বা ফকির বলে মনে হবে সহজেই।
মোট কথা নির্লোভ মানুষ হিসাবে মেনে নেওয়া সহজ হবে পাবলিকের। আর আম জনতার কাছে ফকির বা সন্ন্যাসী মানেই অন্য ডিগনিটি। ট্রান্সপারেন্ট ক্যারেকটার। স্ট্রং মরালিটি। নো আপস। নো কোরাপসন।
এইবার এই কথাগুলো আম জনতাকে শোনাও। রোজ রোজ তোমার মনের কথা শোনাও। কারন পাবলিকের মেমোরি খুবই দূর্বল। বারবার না শোনালে চলবে কেন। রামচন্দ্র একজন সর্বত্যাগী পুরুষ। যদি রামচন্দ্র সঙ্গে থাকে, দুর্নীতি আসবে কিভাবে। এমন জবরদস্ত স্লোগান ও দিতে পারো। আকাশে বাতাসে ভাসিয়ে দাও মহান রামচন্দ্রের অবিবাহিত থাকার কারণ। মানে সব সময়। সব মিডিয়াতে। শুনতে শুনতেই তো বিশ্বাস। আর বিশ্বাস থেকেই ভরসা। তারপর স্বপ্ন আর আশা। এই ব্যাপারগুলো তোমায় নিপুণ ভাবেই গল্পে গুঁজে দিতে হবে।
নীলুদা থ। কিছুটা সময় নিয়ে বলে, আমার ইচ্ছে তো অন্য ছিল। আচ্ছা দেশ বানানোর জন্য একজন সাচ্চা মানুষ হাজির করে ছিলাম গল্পে।
তাতে কি? রামচন্দ্র সাচ্চাই রইল। বলি আমি।
নীলুদা চুপ। হয়তো আমার ভাবনা শুনে বর্তমান অবস্থা রিলেট করতে চাইছে। বলে, যতই বল তুই যা বললি এইসব শুনে আমার কেমন মনে হচ্ছে।
কি মনে হচ্ছে?
না, মানে আমি যা বলতে চেয়েছিলাম কেমন সব পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। কনসেপ্টটাও তো আলাদা। আর রামচন্দ্র কি থাকছে সাচ্চা! বলে নীলুদা
আচ্ছা। আগে গুছিয়ে লেখো, তারপর বাকি কথা। উঠে এসেছিলাম আমি।
তারপর নীলুদা লিখেছে কিনা খবর পাইনি। বলেছে লেখা শেষ করি। তারপর একদিন শোনাব।