চালক – সুদীপ ঘোষাল

চালক          (ছোটোগল্প)

সুদীপ ঘোষাল

অনিল আর বিমল একই স্কুলের শিক্ষক। একই স্কুলে চাকরি করার দরুন তারা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে যায় মোটর সাইকেলে। একটা মোটর সাইকেলে চেপে যায়। বিমল চালায় আর অনিল পিছনে বসে থাকে। বিমল গাড়ি চালানোর সময় মাঝে মাঝে ঢুলতে থাকে। গাড়ির গতি কমে যায়। অনিল মিটার রিডিং এ দেখে কাঁটা কুড়ির ঘরে নেমে গেছে। অনিল বিমলের পিঠে হাত বুলোয় তাকে জাগানোর জন্য। অনিল জানে, কলিগরা কখনও বন্ধু হয় না। হলেও কোটিতে গুটি। বিমল পিঠে হাত দিলে অসন্তুষ্ট হয়। বিমল একবার অনিলকে বলেছিলো, কেউ আমার গায়ে হাত দিলে খুব খারাপ লাগে। এখন বিমল মোটর সাইকেল চালানোর সময় ঘুমিয়ে গেলেও গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে সাহস করে না। মনে পড়ে যায় বিমলের কথা। গায়ে হাত দিলে তার ভালো লাগে না।
একদিন মোটর সাইকেল একটা উঁচু মাটির ঢিপির ওপর উঠে গিয়ে থমকে গেল। বিমল কিছুক্ষণ দুদিকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে নিল। তারপর পিছনে বাইকটা সরিয়ে এনে আবার রাস্তায় নেমে এল।
অনিল জানে এ এক ভীষণ বাজে রোগ। বিমল রোগের স্বীকার। অনিলের ডাক্তার বন্ধু সব শুনে বলল, স্লিপ অ্যাপনিয়া হলে ঠিকঠাক ঘুমের পরও ক্লান্তিভাব আসে। এই অসুখে প্রবল নাক ডাকার সঙ্গে শ্বাস বন্ধ হয়ে মাঝেমধ্যে ঘুম নষ্ট হয়। ভাঙা ভাঙা ঘুম। ফলে কম ঘুম গোটা দিনের জন্য ক্লান্তিতে ভরিয়ে তোলে। তোর কলিগেরও এই অবস্থা হয়েছে। হয়ত অনেক রাত অবধি পড়ে। হয়ত কোনো ডিপ্রেশন কমানোর ওষুধ খায়। তাহলে সারাদিন ঢুলুনি ভাব থাকবে। খুব সাবধান কিন্তু। অনিল বলে, আমি সাবধান হয়ে কি করব। গাড়ির চালককে বুঝতে হবে কারণ তার উপরেই নির্ভর করছে দুটি প্রাণ। অনিলের ডাক্তার বন্ধু আর কিছু না বলে চিন্তিত হয়ে হাঁটতে শুরু করল হাসপাতালের দিকে।
অনিল বাড়ি এল। তার স্ত্রীকেও এই কথাটা বলল। স্ত্রী বললেন, রোগ হলে তো কিছু করার নেই। আমার মামার এই রোগ আছে। একবার সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিলো মামার, এই ঢুলুনি রোগের জন্য। তোমার ভয় লাগলে ওর সঙ্গ ছেড়ে দাও। অনিল বললো, না গো লোকটা খুব ভালো। আমার কাছে কোনো টাকা পয়সাও নেয় না তেল খরচের। আমি চাইছি দুজনে একসঙ্গে ট্রেনে যাওয়া আসা করলে বেশ হয়। কিন্তু বিমল বলে, ট্রেনে গেলে স্কুল পৌঁছতে দেরি হবে। বদনাম হবে লেট হলে রোজ।

অগত্যা অনিল প্রাণ হাতে করে বিমলের সঙ্গেই যায়। কিছুতেই ওর সঙ্গ ছাড়তে মন চায় না। বিমল ফোন করে ডেকে নেয় রোজ। কেমন একটা আকর্ষণে জড়িয়ে গেছে অনিল। হয়ত এটাই বন্ধুত্ব। অনিল ভাবে, ভালো সঙ্গ পাওয়া দুস্কর। তাই তার সঙ্গ সে ছাড়তে চায় না।
অনিল আর বিমল আজ স্কুলে যাচ্ছে। বিমল সেই একইভাবে ঢুলতে শুরু করলো। অনিল বললো, এত বুদ্ধিমান লোক হয়ে আপনি গাড়ি চালানোর সময় ঘুমুচ্ছেন। বিমল বলে, না না। কত কাজ জানেন সারাদিন। মা বাবা দুজনে বয়স্ক লোক। তাদের দেখাশুনা করি। মেয়ে ও মেয়ের মা স্কুলে চলে যায়। তারপরে আমি বের হই। অনিল বলে, মেয়ের মা স্কুলে যায় কেন? বিমল বলেন, ও একটা স্কুলের টীচার। সারাদিন বাবা মা একা। রাত হয়ে যায় শুতে। কি বলব আপনাকে অনিলদা। কিছু বলার নেই।
অনিল আর কিছু বলতে পারে না। সবটাই ছেড়ে দেয় ঈশ্বরের হাতে। যা হয় হবে। আর কি করব। এই ভেবে সেও চোখ বন্ধ করে থাকে।
এখন বিমল স্পিডে গাড়ি চালায় আর তারই ফাঁকে ঘুমিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে হ্যান্ডেল কাঁপে। অনিল ভাবে এ তো বেশ চালাকি শুরু করেছে। ও মনে করছে জোরে গাড়ি চালালে হয়ত বুঝতে পারবে না অনিল। অনিল একদিন বলেই ফেললো বিমলকে, আপনি এইভাবে গাড়ি চালান। পুলিশ দেখলে কিন্তু পেটাবে। আর তাছাড়া আমরা দুজনেই তো সোজা নিমতলার শ্মশানে চলে যাবো। বিমল বললো, না না। কিছু হবে না। তবে আমি একবার প্যারাডাইস লজের কাছে পড়ে গেছিলাম গাড়ি নিয়ে। হাত, পা ছিঁড়ে গেছিলো। বাড়িতে বলিনি। বললে আর গাড়ি চালাতে দেবে না। অনিল বললো, বিমলবাবু আপনি এভাবে গাড়ি চালাবেন না প্লিজ। তারপর দুদিন খুব ভালোভাবে তারা স্কুলে গেলো। কিন্তু তারপর থেকে সেই একই অবস্থা। আবার ঢুলুনি। গাড়ি চলছে কম গতিতে। এক একবার গাড়ি রাস্তার পাশে খালে পড়ছে তো আবার উঠছে উঁচু স্থানে। অনিল ভাবে, ভারি মুস্কিল তো। মানুষের কোনো হাত থাকে না কিছু কিছু জায়গায়। হয়তো সেখানে অজানা অদৃশ্য এক চালক ঠিক করে মানুষের আগামী জীবনের গন্তব্য ।