আশার আলো – ড: নিতাই ভট্টাচার্য্য

আশার আলো    (ছোটোগল্প)

ড: নিতাই ভট্টাচার্য্য

অটিজম। এই একটি শব্দই তছনছ করে দিলো নীলার জীবন। সে বছর দশেক আগের কথা। বুবু তখন আড়াই বছরের বাচ্ছা। হঠাৎ করেই নীলার সুখের সংসারের ছন্দপতন। একমাত্র সন্তানকে ঘিরে আবেশী স্বপ্নগুলি চুরমার হয়ে যায় এক মুহূর্তে। পায়ের নিচের পৃথিবী কেঁপে ওঠে সশব্দে।
সে দিনের ছোট্ট বুবু পা রেখেছে স্কুলে। মাত্র কয়েক ঘন্টা সমবয়সীদের ভিড়ে থাকা। খেলার ছলে কিছু অভ্যাস তৈরির পাঠ নেওয়া। সাদা কাগজে রঙিন পেন্সিলের বাঁকা দাগ। সহস্র কথা। হাসির হিল্লোল। নিত্য নতুন বায়না আর অভিযোগের ছড়াছড়ি। স্কুলের একটি শিশু অপর একজনের প্রতিচ্ছবি যেনো। ব্যতিক্রম শুধু বুবু। এক অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা তার চারপাশে। অনেকের মাঝে অন্যরকম। কখনো স্থির, অস্থির কখনো। তীব্র অনীহা অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায়। দিদিমণিদের হাজার কথায় নির্বিকার। জিজ্ঞাসা শূন্য দৃষ্টি সংকোচে ঘোরা ফেরা করে মেঝের উপর। রা টি নেই মুখে। ‘ওর কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন…’।

দিদিমনিদের কথা নীলাকে শোনায় শান্তি। শোনে অভীকও। মানতে নারাজ দুজনেই। নতুন স্কুলে যাচ্ছে ছেলে। অচেনা পরিবেশ। মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই। তাছাড়া সবাই তো এক রকম নয়। বুবু বাইরে গেলে চুপ করেই থাকে। সময়ে ঠিক হবে সব। এই নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। এমনই ভেবেছিলো নীলা আর অভীক।

স্কুলের শেষে বুবু শান্তির কাছে থাকে। ওদিকে নীলার স্কুল। অভীকের অফিস। দিন শেষে নীলা বাড়ি ফিরলে ছুটি পায় শান্তি। সন্ধ্যার পর অভীক ফিরলে দুজনে ব্যস্ত হয়ে পরে বুবুকে নিয়ে। ছেলের নিত্যনতুন কাণ্ড আনন্দের হাট সাজিয়ে তোলে বাড়িতে। কতো রকম ভাবভঙ্গী বুবুর। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরপাক খাওয়া। দুই হাত সামনে রেখে মাথা দোলানো অনবরত। দুচোখের সামনে থাকা সব বস্তুই বুবুর হাতের চাপড়ে বাধ্য হয়েছে বেজে উঠতে। অস্পষ্ট শব্দ একই তালে বলে চলে নাগাড়ে। কুচকুচে কালো মণি দুটিকে দুচোখের কোলে ঠেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ। কখনো বা ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখে দিয়ে আনমনা বুবু। এই সব কিছুই শিশুর খেয়ালী মনের কাণ্ড ভেবে দেখেছে নীলা । ধরে রেখেছে ছবিতে। হেসেছে অঝোরে। অভীকের মুখেও ফুটে উঠেছে হাসি। প্রত্যেকটি সন্ধ্যায় দুজনে ভিজেছে খুশির জোছনায়। দিনান্তে শ্রান্ত শরীরে ফুটফুটে ছেলের স্পর্শ পেয়েই খুশি হয়েছে ওরা। খুশি হয়েছে একরত্তি দুষ্টুকে বুকে ধরে। বাবা মায়ের স্নেহের চোখে সব কিছুই ছিলো স্বাভাবিক। সোহাগ আর আদরের ছায়ায় নাড়া দেয়নি বুবুর স্কুলের দিদিমনিদের দেওয়া পরামর্শ। আলাদা গুরুত্ব পায়নি সেগুলি নীলা আর অভীকের কাছে। দিন যত এগিয়েছে শান্তির নজরে ধরা পড়েছে বুবুর পরিবর্তন। বাচ্ছা ছেলে আজ প্রথম দেখছে শান্তি এমন তো নয়, এই কাজ করেই চুল পাকিয়েছে সে। শান্তি খুঁটিয়ে দেখেছে বুবুকে রোজ। নীলাকে শুনিয়েছে তার ভাবনার কথা, ‘ দিদিমনি বুবু যেনো পাল্টে যাচ্ছে দিনে দিনে। অতো টুকু বাচ্চা সারাদিন আনমনা, কেমন যেনো… ‘। সহজে মানেনি নীলা সে কথা, বিরক্ত হয়েই বলেছে শান্তিকে, বাচ্ছা তো এই ভাবেই বড়ো হয়। সে কথা শান্তিও জানে, তবুও। তাই জোর দিয়ে জানায় নীলাকে তার মনের খটকা। তারপরেই তো…

হ্যাঁ, অটিজম।
বুবুর সমস্ত রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন আলম, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। টেবিলের ওপাশে চেয়ারে বসে রয়েছেন আলম। নীলা আর অভীক বসে এই পাশে, মধ্যিখানে বুবু। আলমের অনুসন্ধানী দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে বুবুকে। সঙ্গে নিচু স্বরে বলে চলেছেন অটিজম সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক কথা। একরাশ অজানা আতঙ্কের ঘেরাটোপে আটকা পরে বিহ্বল নীলা। ‘এমন ভাবে ভেঙ্গে পড়বার মতো কিছু হয়নি, অটিজম কোনো রোগ নয় মিসেস সেন। বরং স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলতে পারেন । পার্মানেন্ট সলিউশন হয়তো নেই, তবে নিরন্তর প্রচেষ্টা ওদের অনেকটাই এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, এইটা পরীক্ষিত সত্য’, বলে চলেছেন আলম। নীলার ঝাপসা দৃষ্টি ততক্ষণে হারিয়ে গেছে আলমের ঠিক পিছনের দেওয়ালে। বিভিন্ন বয়সের বেশ কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ের ছবি ঝুলছে সেখানে। পাথর দৃষ্টিতে চেয়েছিলো নীলা। অভিব্যক্তিহীন সেই সব মুখগুলির মাঝে বুবুকেও বুঝি দেখতে পেয়েছিল সেদিন।
‘রিপিটেডলি একই কাজ অটিস্টিক চাইল্ড করে। সবার থেকে নিজেকে আলাদা রাখা ওদের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া …’, পরপর বলে চলেন আলম অটিজমের লক্ষণগুলি। ডাক্তার আলমের সহজ সাবলীল অটিজমের লক্ষণ উপস্থাপন কাঁপিয়ে দেয় নীলার মন। অজস্র টুকরো মুহূর্ত ভিড় করে নীলার চারপাশে। বুবুর দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপ আলমের বলা অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলির বিশ্বাসযোগ্য চিত্ররূপ যেনো। তবুও, নীলার মনের অতলে প্রবাহিত অবিশ্বাসের শীর্ণ ধারা ক্ষীণ সুরে বাইরে আসে,  বুবুর অটিজম? এমন পরিস্থিতি অচেনা নয় আলমের। সন্তান বা প্রিয়জনের সমস্যার কথা শুনে সবার মনের সন্দেহ এমন প্রশ্নের হাত ধরেই বাইরে আসে। আলমের প্রত্যয়ী অভিব্যক্তি সায় দিয়েছিলো সেই দিন নীলার প্রশ্নে।

বুবু, বুবু, বুবু…
আলমের চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরে সেদিন ছেলেকে মন উজাড় করে ডেকেছিলো নীলা। বুবুকে স্পর্শ না করে সেই ডাকের প্রতিধ্বনি নির্মম বিদ্রুপের রুঢ় সুর হয়ে এসেছিল ফিরে। বদ্ধ ঘরের চার দেওয়ালের ফিরিয়ে দেওয়া শব্দ অসহনীয় আর্তনাদ বলে মনে হয়েছিল নীলার। ‘…নিজের নাম শুনে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানো ওদের সহজাত নয়। অটিজম আক্রান্ত শিশু আপন জগতেই নিমজ্জিত সর্বক্ষণ…these are the very common symptoms of autistic children.’। আলমের কথাগুলি অদূরে দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে চেয়ে ছিলো নীলার দিকে। জীবনের এক অচেনা বাঁকে এসে পৌঁছায় নীলা সেইদিন।

তারপর এক নতুন খাতে এসে পড়েছে জীবন। কতো না ঘুমানো রাত ভোর হয়েছে নীলার অনিদ্রিত চোখের পাতায়। উচ্ছল আনন্দগুলি হয়েছে মলিন। হাস্যোজ্জ্বল সোনালি দিনগুলি দাঁড়িয়ে থেকেছে দূরে, মাথা নত করে। একরাশ উদ্বেগ নীলার ছায়াসঙ্গী। একমাত্র সন্তান অটিজমের অন্ধকূপে বন্দী। দিনের প্রতিটি পল-অনুপল মনে করিয়ে দিয়ে যায় সেকথা নীলাকে। বড়ো বিষময় এই দিনগুলি। নিরবিচ্ছিন্ন দুশ্চিন্তার প্রবাহে ভেসে চলে নীলা রাতদিন। নিবিড় বিষণ্ণতা সঙ্গ পায় অবিরাম অশ্রুধারায়। একান্তে অভিসম্পাত করে নিজের অদৃষ্টকে বারবার। না জানি কোন দুষ্ট গ্রহ আপন মর্জিতে ছিনিমিনি খেলে নীলার ভাগ্য নিয়ে। দিনে দিনে ভাবনার প্রশস্ততা হয়ে উঠেছে সংকীর্ণ। পাছে ছেলের কথা জানতে চায় কেউ তাই পথে ঘাটে চেনা মানুষের থেকে মুখ ফিরিয়ে পথ চলেছে নীলা। মনের সমস্ত জানালা করেছে রুদ্ধ। বদ্ধ ঘরের গুমোট বাতাসের শ্বাসে দিনে দিনে ক্লান্ত হয়েছে মন। বুবুর ভবিষ্যৎ, সে তো ঢেউ এর উপর মিনার গড়ার স্বপ্ন দেখার সামিল। অটিজম আক্রান্ত বাচ্চা, বেড়ে উঠবে দিনে দিনে। নিস্তেজ শৈশব পার হবে নিঃশব্দে। তারপর জীবনের বাকি পর্বগুলি আসবে একে একে বুকে হেঁটে, সরীসৃপের মতো। পরজীবী হয়েই কাটবে বুবুর জীবন। অপরের অনুকম্পাই বুঝি তার বেঁচে থাকার রসদ। হায় ভগবান! কতো স্বপ্ন ছিলো নীলার। বড়ো হবে বুবু একদিন। সন্তান যেমন বড়ো হলে গর্ব সুখ হয় মায়ের, তেমন বড়ো। সব কিছুই আজ ওলটপালট হয়ে গেছে। জীবনের এই পর্বে দিশাহীন নীলা।

চোখের সামনে কতো বাচ্ছা স্কুলে যায়, চেয়ে দেখে নীলা। নিজের স্কুলের ছেলেমেয়েদের আনন্দমুখর রূপ মনে করে বুবুর কথা বুকে বেজেছে বড়ো। বুবু স্কুল যাবে না কোনোদিন, সে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা চাক্ষুষ করেছে ভাবনায়। বুকের মধ্যে বোবা যন্ত্রণা ডুগরে উঠেছে নীরবে। অশেষ মনোবেদনার উত্তাল তরঙ্গ টেনে নিয়ে গেছে নীলাকে ঊষর উপত্যকার নির্জনে, সঙ্গী হয়েছে অফুরন্ত ধারাপাত। ধীরে ধীরে নিজের বাড়িতেই সীমায়িত হয়েছে নীলার উদভ্রান্ত পৃথিবী। দ্বাররুদ্ধ কক্ষের দুর্ভেদ্য আঁধারে রচনা করেছে দুশ্চিন্তার পাহাড়। উজ্জ্বল ভাবনাগুলি আলোকহীনতায় অন্ধ ততদিনে। অভীকের ভালোবাসার স্পর্শ ব্যর্থ হয়েছে বারবার। অনাগত দিনের করুণ পরিণতি পাগল করে তুলেছিল নীলাকে। জীবন বুঝি একটি প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে এগিয়ে চলা ‘ কি হবে বুবুর?’।

‘সেকথা কে বলতে পারে নীলা? অনাগত দিনের গর্ভে কোন বিস্ময় লুকিয়ে থাকে তা কি বলা সম্ভব!’, বলেছিলো শতরূপা। অটিজমের ছোবলে দীর্ণ শিশুদের ধরিত্রীর সবুজ প্রান্তরে এগিয়ে দেবার প্রয়াসে ব্রতী উত্তরণ, একটি সংস্থা। শতরূপা সেই ঐকান্তিক প্রয়াসের মূলসুর। বুবুকে নিয়ে উত্তরণে যায় নীলা। বুবুর মতো আরো অনেকে শিশুর ভিড় সেখানে। পৃথিবীর এক অন্য রূপ দেখতে পায় নীলা এখানে, আঁতকে ওঠে। এমন শিশুদের কি এগিয়ে নিয়ে চলা সম্ভব?
কেনো নয়? ওরা তো সুস্থ। বয়সের সঙ্গে বুদ্ধির বিকাশ হয়নি সেই ভাবে। ওরাও পছন্দের কাজ খুব ভালো ভাবেই করতে পারে। মনের ভালোলাগা আমাদের মত ওদেরও আছে। হৃদয় দিয়ে যদি চেষ্টা করেন বুবুর জগতের অশ্রুত নিক্কন শুনতে পাবেন, অনুভূতির ক্ষীণ অভাসও ধরা দেয়। তবে সে কাজ কঠিন, অসম্ভব নয় মোটেই। এক অতুল আশার সুর শতরূপার গলায়। চোখ নামিয়েছিলো নীলা। রাতদিন নৈর্ব্যক্তিক ভাবনার দাপটে ততদিনে সে হয়ে উঠেছে জীবনবিমুখ। বুবুকে নিয়ে এগিয়ে চলবার মত মনের জোর তার অবশিষ্ট কোথায়! আগামী, সে তো অনিশ্চিত। ভালোমন্দ দুইয়েরই সম্ভাবনা সমান সেখানে। তবুও মন্দ ভেবে নিজেকে নিরন্তর কষ্ট দেওয়াতো অর্থহীন। কর্মবিমুখ জীবন তো স্থবির, সেখানে বাঁচবার পুষ্টি কোথায়? দুর্ভাবনায় কি সমাধানের পথ মিলেছে কখনো। আপনি স্কুলে যান, কাজের মধ্যে থাকুন। নিজের ভাবনার পরিবর্তন না হলে বুবুর পৃথিবী চিনবেন কিভাবে!

নীলার মনের নিভৃতে বেজেছে শতরূপার সুর, মেনেছে সত্যি বলে। তবে নিজের ভাবনার গতি পরিবর্তন করা সে কি অতই সহজ! ক্ষুদ্র আত্মজগতে আবদ্ধ থেকে রাতদিন অলীক ভাবনায় অভ্যস্ত নীলা ততদিনে নিজেকে করে তুলেছে বিপন্নবিলাসী। ভবিষ্যৎ বুঝি বর্তমান দিনের বেড়া টপকে অতি রুক্ষ্ম চেহারায় এসে আঁকড়ে ধরেছে তার বুবুকে। স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ কষ্টে আগুন পাখির মতই বাঁচতে চেয়েছে নীলা সেই ভগ্ন স্বপ্নকে জড়িয়ে। গতিহীন জীবনের পরাভব মেনে নিয়ে নিজেই হয়ে উঠেছে নিজের প্রতিপক্ষ।

সময় বড়ো আশ্চর্য বস্তু। মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা
বিহ্বলতা বিপন্নতা খণ্ডসময়ের এই সমস্ত অনুভূতিগুলো আবহমান স্থাণু মহাকালের বুকে দ্রুতই অপসৃয়মান, কালের নিয়ম মেনে। খণ্ডসময়ের প্রবাহমনতাই মানুষকে অভিযোজিত করে তোলে তার ব্যথা বেদনার সঙ্গে । তাই যন্ত্রণার কথা সযত্নে স্মৃতিতে সাজিয়ে রেখে মানুষ ফিরে আসে পুরনো ছন্দে। তেমনই নীলার মনের ঝড়ের দাপট এসেছে কমে। হীনম্ম ন্যতার বর্ণও হয়েছে ফিকে। মেনে নিয়েছে বাস্তবকে। বুবু আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা। তাই সাধারণের এগিয়ে চলার চেনা পথ বুবুর নয়। ছকভাঙ্গা এক নতুন পথের সন্ধান চেয়েছে নীলা। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধ স্রোতে এগিয়ে চলার মনোবল সঞ্চয় করেছে ধীরে ধীরে। একাজে শতরূপাই এগিয়ে দিয়েছে নীলাকে।
রোজ রাতে পশ্চিমের জানালায় এসে দাঁড়ায় নীলা। নিবিড় রাতে ফেলে আসা দিনের যন্ত্রণাময় সমস্ত চিত্র ফুটে ওঠে একে একে আকাশের গায়ে। একান্তে প্রত্যক্ষ করে সেই সব চিত্র। নক্ষত্রদের প্রবেশপ্রস্থানে চালচিত্রের পরিবর্তন পেরিয়ে আসা দিনের বিভিন্ন বাঁকে যে ব্যথা বেদনা বিস্ময় উপস্থিত থেকেছে তাদের কথা ভরিয়ে তোলে ক্যানভাসের গায়।
আজ বুঝি বড্ড ঝলমলে উত্তর আকাশ। রোজ রাতে টিমটিমে আলো জ্বেলে রাত জাগে ধ্রুবতারা। নিদ্রামগ্ন এ বিশ্বচরাচের এক মাত্র অতন্দ্ররক্ষী যেনো। আজ সপ্তর্ষিমণ্ডল আর ধ্রুবতারা একযোগে নতুন আশার ছবি এঁকেছে উত্তরাকাশে। আজকের সে ঘটনার চিত্রায়ন ভিজিয়ে দিয়ে যায় নীলার দুচোখের পাতা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে নীলার মুখে সমস্ত কথা শোনে অভীক। আজ সেও যেনো আশাবাদী। আজকের ঘটনা আশার আলো এনেছে অভীকের মনেও।

পল্টুদের বাড়ি গেছে বুবু আজ সকালে। সঙ্গে গেছে শান্তি। অভীক অফিসে রওনা দিয়েছে, নীলার ছুটি। রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলো নীলা। মাঝে মাঝেই নজর ফেলে বাড়ির পিছন দিকে। নীলার রান্না ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যায় পল্টুদের বাড়ি। নীরবে ব্যস্ততার যজ্ঞ চলছে সেখানে। নিমাই বিখ্যাত মৃৎশিল্পী। নিমগ্ন প্রতিমা নির্মাণে। এই কয়মাস নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না তার। ব্যস্ত পল্টুও। দশ বছরের পল্টু হাত পাকাচ্ছে বাবার কাজে। খড় কাঠামো তৈরি, তাতে মাটি ধরানো, নিমাইয়ের পাশে রং এর পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই সব কাজে বেশ কয়েক কদম এগিয়েছে পল্টু। এই কয় মাস স্কুল ভুলে নিমাইয়ের ছায়াসঙ্গী সে।
পল্টুকে বুবু পছন্দ করে। ভালোবাসে তার সঙ্গ। সাড়া দিনে বেশ কয়বার যায় ওদের বাড়ি। তবে নীলা বা শান্তি সঙ্গে কেউ একজন থাকে। আজ বুবুর সঙ্গে ছিলো শান্তি। পল্টু ছিলো না বাড়িতে। প্রয়োজনে বাইরে পাঠিয়েছে নিমাই। শান্তি কথা বলছে পল্টুর মায়ের সঙ্গে। ঠিক তখনই ঘটে সেই কাণ্ড। একপাশের একটি খড় কাঠামোয় আপন মনে মাটি মাখাতে থাকে বুবু। নিমাই, পল্টুর মা , শান্তি সবার অলক্ষ্যে বুবুর অপটু দুটি হাত আপ্রাণ চেষ্টা করছে কাঠামোয় নরম মাটির প্রলেপ দিতে। বুবুর মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট দেখেছে নীলা। অন্তরের আনন্দের সুরভি বুবুর দু চোখে ঘনিয়ে আছে। এই কয় বছরে বুবুকে চিনেছে নীলা। ওর মুখে ফুটে ওঠা আঁকিবুঁকি পড়তে পারে। জীবনে বাঁচার রসদ হয়তো খুঁজে পেয়েছে বুবু।

আশ্বিনের আকাশ। রাতচরা সাদা মেঘের দল ভেসে চলে পরিযায়ী পাখির মতো। ডানা মেলে নীলা। মেঘের দলের সঙ্গে ভেসে চলে উত্তর আকাশে। পুলহ, পুলস্ত্য, ক্রতু হয়ে উড়ে চলে ধ্রুবতারার দিকে। এতদিন এক পথের সন্ধান পেয়েছে নীলা। জীবনের নৈর্ব্যক্তিক ভাবনা পিছনে ফেলে সাহসী ডানা মেলে তার ভাবনা। পারবে সে বুবুকে নিয়ে এগিয়ে যেতে। আজ অসীম আশার আলো নীলার দু’চোখে।