গোবর্ধনের কেরামতি
সদানন্দ সিংহ
আমাদের পাড়ার শেষপ্রান্তে যে নতুন একতলা বাড়িটা তৈরি হয়েছে সে বাড়িটার সামনে দিয়ে যাবার সময় রাস্তা থেকে লক্ষ করলাম গোবর্ধনদা বারান্দায় একমনে চেয়ারে বসে রয়েছেন। তখনই বুঝলাম হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন এঁরা আমাদের পাড়াতেই নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন। অবশ্য আমি আগেই খবর পেয়েছিলাম কোলকাতার কারা নাকি এই বাড়িটা করাচ্ছিলেন এখানে এসে কীসব ব্যবসা করবেন বলে।
সেদিন জংলিমামার বাড়িতে এনারা আমাদের সঙ্গে বেশি কথা বলেননি। প্রায় একরকম এড়িয়েই গেছেন আমাদের। মনে হয় জংলিমামা আমাদের বিরুদ্ধে আকথা-কুকথা এঁদেরকে বলেছিল।
বাড়ির সীমানার সামনের গ্রীলের গেট খোলাই ছিল। গেট থেকে বাড়ির বারান্দার দূরত্ব প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ ফুটের মতো হবে। ভেতরে ঢুকব কি ঢুকব না চিন্তা করছিলাম। শেষপর্যন্ত ঢুকেই গেলাম। চুপিচুপি আমি গোবর্ধনদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। গোবর্ধনদা আমাকে লক্ষই করলেন না, কি এক গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। তখন বিকেলবেলা। তাঁর এক হাতে একটা কলম, আর অন্য হাতে লাল কাপড় দিয়ে বাঁধানো একটা লম্বাটে খাতা।
আমি আস্তে আস্তে ডাক দিলাম, গোবর্ধনদা।
গোবর্ধনদা চমকে লাফিয়ে উঠলেন, হাত থেকে খাতা-কলম ছিটকে নিচে পড়ে গেল। তারপর আমাকে দেখে বললেন, অঃ। আপনি। আমি ভেবেছিলাম কোন ভূতের ডাক বুঝি।
আমি বললাম, ভূতের ডাক! এই বিকেলে?
– কেন ? এমন কোন আইন আছে নাকি যে বিকেলে ভূত বেরুতে পারে না ? এমন আইনের কথা আমি কোনদিন শুনিনি তো। বলেই গোবর্ধনদা নিচ থেকে খাতা-কলম তুলে নিলেন।
আমি এবার বললাম, ভূতের কথা এখন থাক। আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি আপনার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। আমি স্কুলে পড়ি। আমার নাম হাবু। আপনি আমাকে হাবু বলেই ডাকবেন।
– তাই তো, তাই তো, হাবু বলেই ডাকা উচিত। আচ্ছা একটা কথা, ভূতের মুখে কেন রামনাম হয় না তুমি বলতে পার ? তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একদিন সকালে কথা বলব। এখন বিকেল হয়ে গেছে, আর রাতে আমার বড় ভয় করে। কোলকাতায় একজন আমাকে বলেছিল আগরতলায় নাকি বাঁশভূত আছে। বাঁশ হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে। পথচারী কেউ তার ওপর দিয়ে গেলেই নাকি দুম করে খাড়া হয়ে যায়। ভাবলেই গা-টা শিউরে ওঠে। রাম রাম। বলে গোবর্ধনদা দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম সারলেন। তারপর আবার বললেন, তবে ত্রিপুরার আবহাওয়াটা একটু অন্যরকম। এখানে এসে রবীন্দ্রনাথের মতো আমারও কবি কবি ভাব এসে গেছে।
সামনের একটা খালি চেয়ারে বসে আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম, তাই নাকি!
– হ্যাঁ ভাই। রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় আগমনের গল্পটা দাদাই আমাকে গতকাল শুনিয়েছিল। তারপর থেকেই আমি কেবল কবিতা লিখে যাচ্ছি। এই দেখো। বলেই গোবর্ধনদা তাঁর লম্বাটে খাতাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
খাতাটা হাতে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই দেখলাম বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে –
“জল পড়ে পাতা নড়ে,
পাগলা কুকুরের মাথা নড়ে।”
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা খুলে আমি দেখলাম, ঐ বড়ো বড়ো অক্ষরেই লেখা রয়েছে –
“রামছাগলের ছানা,
কাঁদতে তাদের মানা।
কান্নার কথা বললে,
কাঁদে না না না না।”
ঠিক সেভাবেই তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে –
“জাট্টিমা টিং টিং
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা জাট্টিমা টিং টিং।”
লেখাগুলি পড়তে পড়তে আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। হি হি করে হাসতে লাগলাম। আমাকে ওভাবে হাসতে দেখে গোবর্ধনদা বললেন, কেমন লাগল ? ভালো লেগেছে ?
হাসি থামাবার চেষ্টা করতে করতে আমি জবাব দিলাম, ভালোই লেগেছে। তবে লেখাগুলি যে নকল মনে হচ্ছে।
এবার গোবর্ধনদা একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ধূর। লেখাগুলি কেন নকল মনে হবে। আমি যেভাবে জল পড়ার কথা, পাগলা কুকুরের কথা, রামছাগলের কথা, জাট্টিমার কথা বলেছি, ঠিক সেভাবে আগে কি কেউ কোনদিন বলতে পেরেছে ? বলো বলো।
– না।
– তাহলে ওগুলো কেন নকল হবে ? আচ্ছা তুমি বাকি কবিতাগুলি পড়ে যাও।
আমি আবার পাতা উলটিয়ে যেতে লাগলাম। চতুর্থ পাতায় লেখা আছে সন্দেশ, পঞ্চম পাতায় লেখা আছে রসগোল্লা, ষষ্ঠ পাতায় লেখা আছে রসমালাই। এরপর আর কিছুই লেখা নেই। আমি বললাম, এগুলি কি কবিতা ?
– না। এগুলি কবিতার নাম। কবিতাগুলি এখনো লেখা হয়ে ওঠেনি। কি করে লিখবো বুঝতেই পারছি না। সন্দেশের কথা ভাবলেই জিবে হু হু করে জল এসে যাচ্ছে। রসগোল্লা, রসমালাইয়ের কথা ভাবলেও ঐ একই অবস্থা। অনেকক্ষণ ধরে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিছুতেই হচ্ছে না। তুমি একটু লিখে দেবে ভাই ?
– আ-আমি ? বলে আমি ঢোক গিললাম। কবিতা লেখার অভ্যাস আমার কিছু কিছু ছিল, কিন্তু আমি কোনদিন সন্দেশ, রসগোল্লা, রসমালাই নিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবিনি। আর এগুলির কথা ভাবতেই আমারও জিবে জল এসে গেল। আমি ধীরে ধীরে বললাম, আচ্ছা, এগুলি খেলে হয়তো লেখা যাবে।
– একদম ঠিক। দেখি আমি একটা-দুটো রসগোল্লা পাই কিনা। বলেই গোবর্ধনদা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। আমি তো আনন্দে আটখানা, এবার প্লেট ভর্তি রসগোল্লা হয়তো আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম গোবর্ধনদা একটা বড় পাতিল নিয়ে আসছেন। পাতিলটাকে দেখে মনে হল, এটাকেই হয়তো আমি জংলিমামার বাড়িতে গোবর্ধনদার হাতে দেখেছিলাম।
কাছে এসে গোবর্ধনদা বললেন, কোলকাতা থেকে এক পাতিল রসগোল্লা এনেছিলাম। কিন্তু ভাই, খুবই দুঃখিত। সব আমি আর দাদা খেয়ে ফেলেছি। খালি পাতিলটা আছে, তাই-ই নিয়ে এলাম। তুমি এই পাতিলটা দেখে একটু লেখার চেষ্টা করবে ভাই ?
ব্যাপার দেখে আমার বেশ রাগ এল। রেগেই বললাম, না। সম্ভব নয়। আমি এখন যাচ্ছি।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু গোবর্ধনদা আমাকে টেনে বসিয়ে বললেন, বসো ভাই। রাগ করো না। কোলকাতা থেকে এবার রসগোল্লা আনলে তোমার জন্যে লুকিয়ে রেখে দেবো। দাদার সামনে পড়লে আস্তে আস্তে সব শেষ হয়ে যায়। অবশ্য আমিও কম নই।
এমন সময় আমি ঘরের ভেতর থেকে একটা খ-র্-র্ আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি ঘরের ভেতরের দিকে তাকালাম। গোবর্ধনদা বললেন, ও কিছু না। দাদার নাক ডাকার আওয়াজ। এই সন্ধ্যের দিকে কী ঘুম রে বাবা। অথচ দাদাই প্রায়সময়ে বলে থাকে বেশি ঘুম নাকি শরীরকে ধ্বংস করে দেয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার গোবর্ধনদা বললেন, ঘুম থেকে ওঠানোর কোন কবিতা তোমার মনে আছে কি ?
একটু ভেবে আমি বললাম, ভোর হল, দ্বার খোল, খুকুমণি উঠো রে।
– পেয়েছি। বলেই গোবর্ধনদা কবিতার খাতায় খসখস করে লিখে বারবার জোরে পড়তে লাগলেন, সন্ধ্যে হল, দ্বার খোল, হর্ষবর্ধন উঠো রে।
হঠাৎ দেখলাম ঘরের ভেতর থেকে হর্ষবর্ধনদা বেরিয়ে এসে বলতে লাগলেন, আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছিস, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে গোবরা ?
– না না দাদা। আমি কবিতা লিখছি। এই দেখো। বলে গোবর্ধনদা লম্বাটে খাতাটা বাড়িয়ে ধরলেন।
খাতাটাকে হাতে নিয়ে হর্ষবর্ধনদা বেশ দুঃখিত হলেন, হায় হায়, এ কি করলি তুই! ব্যবসার হিসেবপত্র লিখবো বলে এটা কিনে এনেছিলাম, আর তুই এটার বারোটা বাজিয়ে দিলি ?
শুনে গোবর্ধনদা অখুশি হয়ে বললেন, বারোটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। এখন মাত্র ছয়টা বাজে। আর কবিতা লেখা কি খারাপ ? রবীন্দ্রনাথ তো কবিতা লিখেই বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন। তাছাড়া খাতাটা মোটেই নষ্ট হয়ে যায়নি। পিছে অনেকগুলো পাতা আছে। খালি জায়গায় তুমি হিসেব লিখো। হিসেব লেখার পর যে জায়গা খালি থাকবে সেখানে আমি আবার কবিতা লিখব। তারপর তুমি আবার হিসেব লিখবে।
– বাঃ বাঃ, তোর মাথায় দেখছি শুধু গোবর।
একজন কবির প্রতি এ হেন মন্তব্য শুনে গোবর্ধনদার মুখটা যেন ঝুলে পড়লো।
আমিও আর দাঁড়ালাম না, চুপিচুপি চলে এলাম।