যুদ্ধজয়ের রিলে রেস – ভাসিল বাইকোভ

যুদ্ধজয়ের রিলে রেস         

ভাসিল বাইকোভ

 (রাশিয়ান গল্প, ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ সদানন্দ সিংহ)

এক ডজন পদক্ষেপের পরই ছোট স্প্লিন্টার-দাগযুক্ত সাদা কুটিরটাতে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়ে তিনি রান্নাঘরের বাগানের নরম, ক্ষতবিক্ষত মাটিতে পড়ে গেলেন, যে কুটিরের টাইলের ছাদ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং আগের দিন এটাই ছিল “চেক পয়েন্ট নং ৩”।

কয়েক মিনিট আগে, এপ্রিলের সেই সকালে যেখানে মৌমাছিরা সকাল থেকে বোঁ বোঁ আওয়াজ করে উড়ছিল দূরবর্তী স্বল্প রেখার চিত্রকল্পের মতো কুটিরগুলির দিকে তাকিয়ে। সেখানে তিনি একটি ঘন কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তার পরিধেয় টিউনিকটি ফালাফালা করেই। সাবমেশিনগান বন্দুকের গুলিবৃষ্টির ফট-ফট-ফট-ফট আওয়াজের মধ্যেই তিনি হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেনন, “বাঁদিকে! চার্চের দিকে! চা-র্চ।”
তারপরেই তিনি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, তার মাথার অভুক্ত টুপিটি বাতাসকে ঝাঁকিয়ে তার পিস্তলটিকে নিচে ফেলে দিয়েছিল এবং তিনি নরম, স্নিগ্ধ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলেন।
সেই মুহূর্তে, সার্জেন্ট লেমেশেঙ্কো, যিনি সাবধানে কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় ছেঁটে ক্লান্ত হয়ে দুলতে দুলতে পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছিল, মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া তাঁর কমান্ডারের সাথে প্রায় ধাক্কাই খেল। প্রথমে সে অবাক হয়ে ভাবল লেফটেন্যান্টের এইসময়ে হোঁচট খাওয়া কি উচিত। কিন্তু তারপরেই সে বুঝতে পারল আসলে কী ঘটেছে! লেফটেন্যান্ট চিরকালের জন্য স্থির হয়ে গেছেন। তাঁর ফর্সা চুলের মাথাটি টুকরো টুকরো মাটির ভেতর ঢুকে গেছে, তার বাম পা শরীরের নিচেই চাপা পড়ে আছে এবং তার ডান পা প্রসারিত হয়ে আছে।

লেমেশেঙ্কো কিন্তু থামল না, কেবল তার ঠোঁট নার্ভাসভাবে কাঁপছিল। তার ঊর্ধ্বতনের আদেশ গ্রহণ করে সে চিৎকার করে উঠল, “প্ল্যাটুন! বাঁদিকে, গির্জার দিকে! মানে চা-র্চের দিকে!”
কিন্তু সে তার লোকদের দেখতে পেল না। প্রায় দুই ডজন সাবমেশিন-গানার ইতিমধ্যেই ঝোপঝাড় পেরিয়ে বাগান এবং ভবনগুলিতে পৌঁছেছিল এবং তীব্র যুদ্ধের কোলাহলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তার ডানদিকের আঙ্গিনা এবং বিল্ডিংগুলিকে ঘেরা বেড়ার মধ্য দিয়ে সে মেশিন-গানার, নাতুঝনি-এর সাবমেশিনগানের অগ্নিবৃষ্টি এবং তার ছাই মুখের একটুকু আভাস পেল। সোনালি চুলের তরুণ তারাসভ তার পিছনে কোথাও আবির্ভূত হল, এবং সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল আবার। তার প্লাটুনের আর অন্য কোন লোককে চোখে পড়ল না, তবে মাঝে মাঝে তাদের সাবমেশিনগান বন্দুকের ফট-ফট-ফট আওয়াজ লেমেশেঙ্কোকে বলছিল যে প্লাটুনের সেনারা কাছাকাছি কোথাও আছে।
প্রস্তুত অবস্থায় বন্দুকটাকে ধরে সার্জেন্ট কুটিরের চারপাশে দৌড়ে গেল; তার ধুলিধূসরিত বুটের নিচে কাঁচের স্প্লিন্টার এবং কুঁচকে ছাদ থেকে ধ্বসে পড়া টাইলগুলির ধুলোয় ঢাকা। মৃত্যুমুখে পতিত কমাণ্ডারের জন্য শোকে তার হৃদয় ভারাক্রান্ত, যাঁর তাৎক্ষণিক পরিকল্পনায় – গির্জার দিকে প্লাটুনকে পরিচালিত করার জন্য – তিনি নিজেকে একটি রিলে ব্যাটনের মতো করে তুলেছিলেন। লেমেশেঙ্কো পুরোপুরি বুঝতে পারছিল না কেন প্লাটুনকে চার্চের দিকে পরিচালিত করা হয়েছিল, তবে কমান্ডারের শেষ আদেশ ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এবার সেই-ই প্লাটুনকে সেদিকে পরিচালিত করে নিয়ে যাচ্ছিল।

কংক্রিটের তৈরি সরু পথ ধরে কটেজ থেকে দৌড়ে সে গেটে পৌঁছল। বেড়ার ওপারে বিস্তৃত সরু গলি। সার্জেন্ট প্রথমে এক দিকে তাকাল, তারপর অন্য দিকে। তার লোকেরাও উঠোন থেকে ছুটে যাচ্ছিল, চারিদিকে তাকাচ্ছিল। সেখানে আখমেদভ একটি ট্রান্সফরমার হাউজিং এর পিছন থেকে লাফ দিয়ে বেরোল এবং লেনের মাঝখানে তার সেকশন কমান্ডারকে দেখে তার আদেশের অপেক্ষায় রইল। বাগান এবং ধূসর কটেজ এবং বাংলোগুলির মধ্যে কোথাও একটি মাইন এক প্রচণ্ড আওয়াজে বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণে পাশের এক কটেজের ছাদের টাইলস ভেঙে পড়ল।
“বাঁদিকে! চার্চের দিকে,” সার্জেন্ট চিৎকার করে তারের বেড়া বরাবর দৌড়ে গেল, সেখানে কোথাও কোন ফাঁকফোকরের সন্ধান করতে লাগল। তার সামনে আকাশে সমান উঁচুতে গির্জার নীল খাড়া টাওয়ার। এটাই তাদের আক্রমণের নতুন চেক পয়েন্ট।
এদিকে, একের পর এক তার সাবমেশিন-গানাররা গলিতে উঠতে থাকে। ধনুক পায়ে ক্ষতবিক্ষত পুটিস সহ বেঁটে এবং আনাড়ি নাটুঝনি, যাকে নতুন রিক্রুট করা তারাসভ অনুসরণ করছিল, যে সকাল থেকেই তার অভিজ্ঞ এবং অত তরুণ নয় এমন সহযোদ্ধা থেকে পিছিয়ে না থাকার জন্য তার পেছনে চলছিল। আর সেই বাম্পকিন, বাবিচ, শীতের টুপির কানের ফ্ল্যাপ উঁচিয়ে, উঠোন থেকে বেড়ার উপরে উঠছিল।
“ওফ, অন্য উপায় কি খুঁজে পাওয়া যাবে না?” সার্জেন্ট ভাবল।
এবার সার্জেন্ট ইশারা করল, “এখানে, এখানে, তাড়াতাড়ি!” তার রাগ বেড়েই চলেছে, কারণ বাবিচ, তার স্বয়ংক্রিয়টি বন্দুকটি তুলে তার ময়লা হাঁটু থেকে ময়লা ঝেড়ে ফেলতে শুরু করে। “তাড়াতাড়ি!”
তার লোকেরা শেষ অর্ডারটা শুনে, এবং বেড়ার ফাঁকের সন্ধান পেয়ে উঠোন এবং ভবনগুলির গেটের পিছনে অদৃশ্য হয়ে যায়। লেমেশেঙ্কো একটি মোটামুটি চওড়া পীচের রাস্তা ধরে দৌড়ে গেল যেখানে একটি নিচু ভবন ছিল। আখমেদভ, নাতুঝনি এবং তারাসভ তাকে অনুসরণ করল, বাবিচ পেছন পেছন গেল।
“তারা আমাদের লেফটেন্যান্টকে মেরে ফেলেছে!” সার্জেন্ট তাদের কাছে চিৎকার করে বলল, যখন সে একটি সঠিক জায়গা খুঁজছিল। “চলো, সাদা কুটিরের কাছে।”
সেই মুহূর্তে মেশিনগানের গুলির শব্দ শোনা গেল এবং বুলেটগুলি ছুটে এসে পীচ রাস্তার ওপরে বিদ্ধ হতে থাকে। লেমেশেঙ্কো উঠোনে ঘেরা শক্ত কংক্রিটের দেয়ালের পিছনে আত্মরক্ষার জন্য লেপটে রইল। অন্যরা তার অনুসরণ করল। আখমেদভ একা হোঁচট খেয়ে তার বেল্টে জলের বোতলটা চেপে ধরল, ফলে সেখান থেকে জল বেরিয়ে ছুটে আসছিল।
“বাস্টার্ড! দেখ ওরা কি করেছে…”
“তারা গির্জা থেকে গুলি করছে,” নাটুঝনি বলল, গির্জার টাওয়ারের দিকে ডালপালার মধ্য দিয়ে উঁকি দিয়ে। উদ্বেগের ছাপ ফুটে উঠল তার বিকট, বসন্ত-দাগ চিহ্নিত মুখে।

গ্যারেজের পিছনে একটি গেট ছিল, সেই গেটের দরজা তারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সার্জেন্ট তার হাতের ছুরি বের করে দুই কোপে তার কেটে ফেলল। তারা ধাক্কা দিয়ে গেট খুলল। সেখানে তারা একটি পুরানো পার্কিং স্থানে নিজেদেরকে আবিষ্কার করল। তারা নিচে শুয়ে পড়ল। লেমেশেঙ্কো তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি চালাতে লাগল। আখমেদভ এবং তারাসভ তাকে অনুসরণ করল। তারা দেখল, গাছের আঁধারযুক্ত কালো কাণ্ডের ফাঁকে সবুজ পোশাকে সজ্জিত শত্রুরা ছুটে পালাচ্ছে। গাছের পিছনে অনেকাংশ দৃশ্যমান ছিল এবং তার পরেই গির্জাটি ছিল। সেখানে জার্মানরা দৌড়াচ্ছিল এবং গুলি করছিল।
তবে শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছিল, এবং তাদের প্রথম মেশিনগানের ফায়ারের গুলি কংক্রিটের দেয়ালে লেগে দেয়ালের ফাটলের ছালগুলি থেকে পাথরের স্প্লিন্টারগুলি এক ঝরনার মত ছড়িয়ে পড়ছিল। আক্রমণকারীরাও জানে যে তাদের এই চত্বর পেরিয়ে চার্চের দিকে আরও দৌড়াতে হবে। তাই এটা করতে হবে শত্রুদের বুটের হিলের ছোটাছুটির মধ্যেই, কি ঘটছে তা বোঝার সময় না দিয়ে। কিন্তু তাদের সেই সময়টুকু এত কম ছিল! সার্জেন্ট তাকিয়ে দেখল, তাদের সেনারা কেউ এখনও এই পার্কিং পয়েন্টে পৌঁছায়নি। বেড়া এবং দেয়াল তাদের ধরে রেখেছিল এক বাধা হয়ে।
শত্রুর মেশিনগানের গোলাগুলি গ্যারেজের দেয়াল এবং টাইলযুক্ত ছাদে কেন্দ্রীভূত ছিল। এই বসন্তের দিনে তারা ঘাসের উপর লেপ্টে শুয়ে থেকে অল্প অল্প গুলি বর্ষিয়ে যাচ্ছিল। নাটুঝেনি তার বন্দুকের ম্যাগাজিনের অর্ধেক গুলি চালাল, তারপর বন্ধ করল। কারণ গুলি চালানোর মত কোনো লক্ষ্যবস্তু পাওয়া যাছিল না। জার্মানরা গির্জার কাছে লুকিয়ে ছিল এবং তাদের গোলাগুলি আরও বেড়ে যাচ্ছিল।
আখমেদভ, যে তার পাশেই শুয়ে ছিলো, সে তার পাতলা নাকের ছিদ্র রাগে প্রসারিত করে কেবল আওয়াজ করে নিঃশ্বাস-প্রঃশ্বাস চালাতে লাগল। মাঝে মাঝে সে সার্জেন্টের দিকে তাকাচ্ছিল। তার প্রশ্নবোধক তাকানোর ধরন যেন বলতে চাইছে, “আচ্ছা, এখন আমরা কি করব?” সেটা লেমেশেঙ্কোও জানত যে অন্যরাও তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং একটি আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে, যা দেওয়া তার পক্ষে একটু কঠিন ছিল।
“বাবিচ কোথায়?”
তাদের মধ্যে যে চারজন ছিল, সবাই বলে উঠল। সার্জেন্টের বাঁদিকে নাতুজনি এবং ডানদিকে আখমেদভ এবং তারাসভ। কিন্তু বাবিচ উঠান থেকে এদিকে দৌড়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছিল। লেমেশেঙ্কো কাউকে বলতে চেয়েছিল বাম্পকিনের কী হয়েছে তা খুঁজে বের করতে, কিন্তু সেই মুহূর্তে সে দেখতে পেল তার বাঁদিকে তাদের প্লাটুনের সেনারা একে একে এসে পড়ছে । তারা কোত্থেকে হঠাৎ উঠে এসে একত্রে গুলি চালাতে লাগল শত্রুস্থান লক্ষ্য করে। লেমেশেঙ্কো এটা ভাবতেও পারেনি, বরং আগেই অনুভব করেছিল যে চার্চের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। সে এবার হাত উঁচিয়ে বাঁদিকে এগিয়ে যাবার জন্য অঙ্গুলি নির্দেশ করল। তারপর সে এগিয়ে গেল। সেনাদের এগিয়ে যাবার নিয়ম মতো সে কয়েক কদম দৌড়ে আবার শুয়ে পড়ল এবং দু’বার গুলি চালাল। এগোবার সময় কাছাকাছি কারুর সঙ্গে ঢাক্কা লাগল। সেটা কে সে তা দেখেনি। তবে তার মনে হল যে এটা নাটুজনি। তারপর সে লাফিয়ে উঠে আরও কয়েক গজ দৌড়ে গেল। তার বাঁদিক থেকেও গোলাগুলি আর থামেনি; তার লোকেরা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
“দ্রুত। আরো দ্রুত!” গোলাগুলির মাঝে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এই চিন্তাটি বারবার এসে যাচ্ছিল, “আমাদের উচিত শত্রুদের মাথায় কোনো পরিকল্পনাই যেন আসার সুযোগ না পায়। আমাদের অবশ্যই চাপে রাখতে হবে।”
সে আরও কয়েক কদম দৌড়ে স্যাঁতসেঁতে গন্ধযুক্ত মাটিতে পড়ে গেল। তার সামনে এখন পার্কের শেষ প্রান্ত। পিছনে সবুজ তারের জাল, সূর্যালোক চত্বর আলোকিত। চত্বরের শেষে গির্জার কাছে, হেলমেট পরা জার্মানরা ছুটে যাচ্ছিল।
“কিন্তু এখন কোথায় বাবিচ?”
এই চিন্তাটি তাকে বিরক্ত করেই যাচ্ছে। যদিও এখন অন্য আরেকটি চিন্তা তাকে আরও বেশি উদ্বেগের কারণ করে তুলছিল যে তাদের কোনও না কোনওভাবে গির্জা আক্রমণ করতেই হবে।
এরজন্য তাদের এই চত্বরটি অতিক্রম করতে হল, যেটা করলেই তাদের উদ্দেশ্য থেকে একটু দূরে এসে যাবে।
তার সেনারা এলো্পাথারিভাবে গুলি চালাচ্ছিল, গাছের আড়াল থেকে দৌড়ে বেড়ার নীচে নিজেরাই মাটি খুঁড়ছিল। কিন্তু দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া আর সম্ভব ছিল না, আর সার্জেন্ট তারের ঘেরা পার্ক থেকে কীভাবে বের হওয়া যায় তা নিয়ে এক উত্তেজনা সহ ভাবছিল। শেষে সে এক সিদ্ধান্ত নিল। সে তার পকেট থেকে একটি গ্রেনেড বের করল, এবং অন্যদের কাছে আদেশ দেওয়ার জন্য ফিরে গেল। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের প্রচণ্ড আওয়াজে তার চিৎকার কোনো কাজে এল না! আদেশ দেওয়ার একমাত্র উপায় রইল নিজের কাজের মাধ্যমে উদাহরণ প্রতিস্থাপন করা – তাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কমান্ডারের মত সে আদেশ দিল, “আমাকে অনুসরণ করো!” লেমেশেঙ্কো গ্রেনেডের পিনটি খুলে ঝাঁকুনি দিয়ে বেড়ার তারের নীচে গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারল।
গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে একটা ছোট গর্ত হল যেখানে তারের বেড়ার ছিঁড়ে যাওয়া তারের মুখগুলি দেখা যাচ্ছিল। পরিধেয় টিউনিক ছিঁড়ে গেলেও সার্জেন্ট নিজেকে তার জালের ফাঁক গলে বেড়ার ওপারে এগিয়ে গেল। পিছনে তাকিয়ে দেখল, আখমেদভ খুব কাছেই পিছনে অনুসরণ করছে। আর নাতুঝনিও লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হাতে মেশিনগান নিয়ে।
তারপর সে না থেমে যত দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই অভাবনীয় কিছু ঘটে গেল। সমস্ত চত্বর গোলাগুলিতে কেঁপে উঠল। আকাশের মত চার্চের টাওয়ারের উঁচু প্রান্ত থেকে গুলি ছুটে আসছে এবং গুলি এসে তার মুখে এবং পাশে আঘাত করেছে। তার বুকে ঝোলানো পদকগুলি ওপরে শক্ত কিছুর দ্বারা জোরে আঘাত করার সাথে সাথে এক সংক্ষিপ্ত এবং জোরে ক্লিং আওয়াজ সে শুনল। তার মুখের কাছে কারো রক্ত ছিটিয়ে এসে পড়ল। কারুর রক্ত ধুলোয় পড়ে জমাট বেঁধে গেল। এবার সে নিজের দিকে খেয়াল করল, এবং টের পেল তার সমস্ত শরীরটা পাথরের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সে দেখল নীলাকাশের কোথাও থেকে যেন আখমেদভের ভীত চোখ তার মুখের দিকে তাকালো এবং সাথে সাথে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য সে অনুভব করল কাছাকাছি কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তারপর সে ঝাপসা চোখে দেখল অনেক পদচিহ্ন, যেগুলি গির্জার দিকে ধেয়ে গেল, যেখানে থেকে অনবরত গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

“বাবিচ এখন কোথায়?”
ভুলে যাওয়া চিন্তাটা এক ঝলকে আবার ফিরে এল। তার প্লাটুনের জন্য তার উদ্বেগ তার প্রতিটি স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করছিল এবং সে আলোড়িত হচ্ছিল। “কিন্তু এই সব কি হচ্ছে?” আবার একটা অব্যক্ত প্রশ্ন তাকে ভীত করে তুলছিল।
“গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে,” কেউ একজন বলছিল।
সে জানত না এটা বাবিচের নাকি নিজের সম্পর্কে উক্তি। শুধু সে বুঝতে পেরেছিল যে তার সাথে খারাপ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু সে কোন ব্যথা অনুভব করছে না – শুধুমাত্র এক ক্লান্তি যা তার শরীরকে জব্দ করে ফেলেছে। এক কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাদের আক্রমণ সফল হয়েছে কিনা তা দেখতে পেল না।

একটি সাময়িক ব্ল্যাকআউটের পরে তার জ্ঞান আবার ফিরে এল, এবং সে আকাশ দেখতে পেল, যা ব্যাখ্যাতীতভাবে নীচে নেমে এসে যেন একটি বিশাল হ্রদে পরিণত হয়েছে। আর এই যুদ্ধক্ষেত্রের চত্বরে মানুষের এক মৃতদেহ তার ওপরে পড়ে আছে, নির্দয়ভাবে তাকে চেপে।
সে পাশ ফিরে শোয়, বেঁচে আছে এমন কাউকে দেখতে। যুদ্ধক্ষেত্র এবং আকাশ সবই যেন গোলাগুলিতে দুলছে।
শেষে যখন সব কিছু থেমে গেল, তখন সে গির্জাটিকে চিনতে পারল, যা সবেমাত্র দখল করা হয়েছে, কিন্তু সে অংশ নিতে পারেনি। সেখান থেকে আর কোন গুলিবর্ষণ আসছিল না, কিন্তু তাদের সেনারা এর দরজা দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে অন্যে কোণে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল।
মাথাটাকে পিছনে টেনে নিয়ে সার্জেন্ট গভীরভাবে তাকালো, নাতুঝনি বা আখমেদভকে দেখার জন্য, কোথাও চাপা পড়ে গেল কিনা। না, তারা সেখানে ছিল না। তবে সে নতুন নিযুক্ত তারাসভকে দেখতে পেল। নিচু হয়ে যুবক সৈনিকটি নীরবে রাস্তা পার হচ্ছিল। যেতে যেতে সে থামল এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে কাউকে হাত নাড়াল, “এখানে এসো! এখানে!” বলেই বড় গির্জার ভেতরে সেঁধে সে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
অন্যান্য লোকেরা তাকে অনুসরণ করল এবং চত্বরটি খালি হয়ে গেল।
সার্জেন্ট শেষ গভীর শ্বাস নিল এবং তারপর চিরদিনের মতো শুয়ে পড়ল।
কিন্তু অন্যরা যুদ্ধজয়ের জন্য এগিয়ে গেল . . .

(Vasil Bykov –19 June 1924 – 22 June 2003)