ঝাল (অনুগল্প)
সদানন্দ সিংহ
মেজাজ কার নেই? একটু কম-বেশি মেজাজ সবারই থাকে। কিছুদিন আগেও একটু মেজাজ চড়লেই সুকান্ত বলে উঠতো, লে-লে-লে-লে। এই লে-লে-লে-লে জিনিসটা কি সেটা অবশ্য সুকান্ত নিজেও জানতো না।
আর এই লে-লে-লে-লে আওয়াজটা শুনলেই সুকান্তর বৌ রেবা একদম ক্ষেপে লাল, ছিঃ তুমি অভদ্রের মতো কীসব শুরু করলে! তাতে সুকান্ত আরো বেশি করে রেবাকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্যে এই আওয়াজটা আবার করে যেতো।
সুকান্ত-রেবার সংসারটা প্রায় পনের বছরের। একমাত্র ছেলে পিকুর বয়স বারোর কাছাকাছি এবং সে এবার দুপুরের স্কুলে অ্যাডমিশান নিয়েছে। সংসার একটু পুরোনো হলে যা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু-আধটু তর্ক সাধারণ ব্যাপার।
রেবা বলে, পুরুষমানুষদের বোঝাই মুশকিল। সবাই বলে বিয়ের প্রথম দু বছর এরা স্ত্রীদের চন্দ্রমুখী ফুল মনে করে, পরের দু বছর স্ত্রীদের মনে করে সূর্যমুখী। আর তার পরে স্ত্রীরা কিছু বললেই মনে করে স্ত্রীরা যেন জ্বালামুখী।
সুকান্তও উত্তর দেয়, স্ত্রীদের নিয়েও সবাই কী বলে শোনো। বিয়ের প্রথম বছর স্ত্রীরা নাকি স্বামীকে প্রাণনাথ মনে করে। দ্বিতীয় বছর স্ত্রীদের কাছে স্বামী হয়ে যায় শুধুই নাথ; প্রাণ শব্দটা উড়ে যায়। আর তারপর? স্বামীকে দেখে স্ত্রীদের মনে হয় শুধু অনাথ আর অনাথ।
— কী? আমি তোমাকে কোনোদিন অনাথ বলে ভেবেছি? কোনোদিন ভাবিও নি।
তারপর সুকান্ত আওয়াজ করতো, লে-লে-লে-লে। এতে রেবা আরো ক্ষেপে লাল হয়ে যেত।
একদিন কিন্তু এই সুকান্তর এই লে-লে-লে-লে আওয়াজটা হঠাৎ থেমে গেল। পিকু তখন টেবিলে বসে হোম টাস্ক করছিল। এইসময় সুকান্ত হঠাৎ রেবাকে লক্ষ্য করে লে-লে-লে-লে শব্দটা করতেই পিকু বলে উঠল, লে-লে-লে-লে চুম্মা লে। তারপর বাবা-মাকে লক্ষ্য করে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল।
ব্যাপার দেখে রেবা আর সুকান্ত দুজনেই থ’ মেরে গেল। রেবা ছেলেকে বললো, অ্যাই তুই কীসব শিখেছিস? কোত্থেকে শিখেছিস এসব?
পিকু স্বাভাবিক গলায় বলল, স্কুলে এক দাদাকে এসব করতে দেখেছি।
— খবরদার, এসব খারাপ কথা-আচরণ আর কোনোদিন করবি না। স্কুলে খারাপ ছেলেদের কাছে যাবি না। বলেই রেবা সুকান্তের দিকে চেয়ে বলল, তুমি যদি এই শব্দগুলি আরেকবার উচ্চারণ কর তাহলে আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
সুকান্তও আর কোনোদিন উচ্চারণ করেনি।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সুকান্ত রেবাকে ক্ষেপাবার জন্যে লে-লে-লে-লের বদলে নতুন শব্দ বলতে শুরু করলো, আ-আ-আ-আ বা-আ-আ-আ। যথারীতি রেবাও ক্ষেপে লাল আগের মতোই। কিন্তু এই শব্দগুলির উচ্চারণও কিছুদিনের মধ্যেই সুকান্তকে থামিয়ে দিতে হলো।
হোম টাস্ক করার সময় ঠিক আগের মতোই বাবার মুখ থেকে শব্দগুলি শুনে পিকু বললো, আ অক্ষরের পরে হবে মার। আর বা-এর পরে হবে ল। স্কুলে এক দাদাকে বলতে শুনেছি।
পিকুর কথা শুনে রেবা আর সুকান্ত থমকে গিয়ে একে অপরের দিকে চেয়ে রইল।