অমিতাভের বন্ধু (অনুগল্প)
সদানন্দ সিংহ
গিন্নির শাকসবজির ফর্দ নিয়ে আমি বাজারের দিকে হেঁটেই যাচ্ছিলাম। এই সময় সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক পরা একজন বৃদ্ধলোক আমার সামনে এসে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কি রে, আমাকে চিনতে পারছিস? আমি একটু ভাল করে লক্ষ্য করলাম। চিনতে পারলাম, শ্যামলদা।
শ্যামলদা লোকটা প্রথমে খারাপ ছিল না। হয়তো গরীব ছিল। সিনেমা হলে টিকিট চেকারের কাজ করত। তখন আমাদের শহরের তিনটে বড় সিনেমা হল ছিল এবং শহরতলিতে ছোটো ছোটো বেশ কিছু সিনেমা হল ছিল। ডিজিটাল যুগে এখন অবশ্য ঐ সমস্ত সিনেমা হলগুলি বন্ধ হয়ে গেছে কালের নিয়মে। তখন ঐ সব হলগুলিতে রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, জীতেন্দ্র, ঋষি কাপুর ইত্যাদি নায়কের ফিল্ম এলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। টিকিট ব্ল্যাকে বিক্রি হত। শেষ শো ছিল রাত নয়টা থেকে বারটা পর্যন্ত। সিনেমার শেষ শো’র পর শ্যামলদা প্রায় রাত একটার দিকে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিজেদের বাড়িতে যেত। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় তখন স্ট্রীট লাইট ছিল না। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে শ্যামলদা অসম্ভব জোরে হিন্দি সিনেমার গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরত। ঐ রাতে বহু দূর থেকে শ্যামালদার গানের গলা শোনা যেত। আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি, রাতে ভূতের ভয় পেতাম। ভাবতাম, ভূতের ভয়েই শ্যামলদা ওভাবে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। আমার হিরো ছিল অমিতাভ বচ্চন। আমি শ্যামলদার বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতাম অমিতাভের বই কবে আসছে ? কোথায় কী সিনেমা চলছে। ফিল্মকে তখন আমরা বই বলতাম।
পরে শুনেছি, সঙ্গদোষে শ্যামলদা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শ্যামলদার এক নতুন বন্ধু জুটেছিল। সেই বন্ধুর প্ররোচনাতেই সিনেমা হল থেকে দর্শকদের সাইকেল চুরি করে বিক্রি করতে শুরু করেছিল। পরে একদিন সাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ল। পুলিশ এসে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেল। কয়েক মাসের জেল খেটে একদিন ছাড়াও পেল। তারপর আমাদের পাড়া থেকে ওরা কোথায় জানি চলে গেছিল। পরে আবার কীসব মামলায় নাকি আবার জেলে ঢুকে গেছিল।
সেই শ্যামলদাকে আজ দেখলাম, তার দাঁত সব পড়ে গেছে। বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে একটু গলা কাঁপছে। তবে চুল কলপ করে কালো করেছে। বুঝতে পারলাম, চুল সাদা থাকলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ হয়তো পাবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘শ্যামলদা ভালো আছ ?’ শ্যামলদা বলল, ‘আমার আর এই বয়েসে ভাল থাকা আর না থাকা একই।’ শ্যামলদা আমার সব খোঁজ খবর নিল। আমাকে জানাল এই সত্তর বছর বয়েসেও পেটের জন্যই সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করছে। রাতে ডিউটি ছিল। এখন ঘরে যাচ্ছে। ‘পরে কথা হবে, এখন যাই’ — বলে শ্যামলদা সাইকেলে উঠে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। আমার মনে হল, সাইকেলে করে অমিতাভ বচ্চনের একজন প্রকৃত বন্ধু ধীরে ধীরে আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।