আটপৌরে গল্প – বিজয়া দেব

আটপৌরে গল্প       (ছোটোগল্প)

বিজয়া দেব

তেমন কিছু কাজ তো নেই ভবেশের। ছোটখাট কাজ করে কখনও কিছু জোটে কখনও জোটে না। এটা ওটা সারাইয়ের কাজ তো, তাই পকেটে একটা পুরনো ছোট মোবাইল ফোন নিয়ে ঘোরে। কাস্টমারদের সবাইকে ফোন নং দিয়ে রাখা। ঐ ফোনেই ভরসা। গ্যাসের উনুন ঠিক করে দেওয়া, চিমনির টুকিটাকি সারাই সাফ করে দেওয়া। চায়ের দোকানে ছোট পোর্টেবল গ্যাসের উনুন রিফিল করা এইসব কাজ। বউকে খাওয়াতে পারবে না বলে বিয়েও করল না সে। পয়সায় কুলোয় না তাই সুন্দর করে কথা বলতে শিখেছে ভবেশ। কিন্তু তারপরও সে চালাতে পারল না। শরীর ভালো নেই। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ঢেঁকির পাড় দেওয়ার মত ডুব ডুব করে আর ঘাড়টা সোজা রাখা যায় না। কাজ করতে গেলেই বেড়ে যাচ্ছে।

পাড়ার শিবেনবাবুর একটা ছোটখাটো মেরামতির দোকান আছে। কাজ নাকি খুব ভালো। ভিড় হয় খুব। ঐ প্রেসার কুকার, গ্যাসের উনুন, কড়াই, প্যান, মিক্সার, জুসার রোজকার হেনতেন তো লেগেই আছে সংসারে। সে দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে তো শিবেনবাবু হাঁক পাড়ল — কি রে ভবেশ, কোথায় যাস? শুনে যা তো! শিবেনবাবুর সহকারী ছেলেটা বাড়ি গিয়ে অসুখ পড়েছিল। সেদিন খবর পাঠিয়েছে সে আর এই কাজ করবে না। শিবেনবাবু বললেন — তোর ব্যবসাপত্তর কেমন চলছে? ডাক পাস?
— কমে গেছে একেবারে। তাছাড়া আমার খুব গ্যাস অম্বল হচ্ছে গো। বুকের ভেতর ঢেঁকির পাড়। ঘাড় সোজা করে রাখতে পারছি না।
— তাই তো দেখছি। থেকে থেকে মাথাটা নড়ছে। মনে হয় তোর ঘাড়ের ইস্ক্রুপগুলো ঢিলে হয়ে গেছে, টাইট করাতে হবে। শিবেনবাবু নিজের রসিকতায় নিজেই আমোদ পেয়ে দুলে দুলে হাসতে লাগলেন।
ভবেশ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক যেন ঘোর অপরাধী। মাথাটা একটু একটু নড়তেই থাকে।
— উঠে আয়।
রাস্তা থেকে খানিকটা উঁচুতে শিবেনবাবুর দোকান। কাঠের খুঁটির ওপর চওড়া জায়গা নিয়ে কাঠের মেঝে তৈরি করা ঝোলানো দোকান। দোকানের ভেতর গ্যাসের চুলা, প্রেসার কুকার ইত্যাদি সারাই এর হাজারও সরঞ্জাম সাজানো। ভবেশ উঠল। শিবেনবাবু বললেন — নে ঐ কোণে জুত হয়ে বোস। আর চিন্তা নেই তোর। খুটখাট করে কাজ কর।

চিন্তা নেই বললে কী হয়! নিজের শরীর ভালো নয়। হরেন কবরেজের জড়িবুটি দিয়ে চালাচ্ছে কোনও রকম। আলোপ্যাথি দেখাবে টাকা কোথায়? তবু সে হাসে। বলে — আপনি আছেন আর কী চিন্তা। দ্যান দেখি কী ঠিক করার আছে?
শিবেনবাবু অনেক লোক খুঁজেছেন, পাননি। দুজন পেয়েছিলেন, ওরা যা মজুরি চাইছিল তার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। ভবেশকে পেয়ে তিনি ভেতরে ভেতরে আরাম বোধ করছেন। এই লোক সহজে কাজ ছেড়ে যাবে না। একেবারে লজঝরে লোক। মাথা একটু একটু নড়ছে লাগাতার। একটা গ্যাসের চুলা টেনে বের করল ভবেশ। বলল — কাজে লেগে গেলাম।

রাত ন’টা পর্যন্ত কাজ করল ভবেশ। কাজে তো সে খুব ভালো। শিবেনবাবু এতদিন পর বড় নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। তাছাড়া একে তেমন কিছু মাইনেপত্তর দিতে হবে না। একা মানুষ, যেমন তেমন করে শুধু বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই হয়েছে।

কাজটা পেয়ে অব্দি খানিকটা নিশ্চিন্ত হল ভবেশ। এভাবে খুঁজে খুঁজে কাজ পেতে বেগ পেতে হয় খুব। এটা খুব ভালো হল যে কাজ পেতে তাকে এপাড়া ওপাড়া এ গলি ও গলি ঘুরে বেড়াতে হবে না। ঘুম থেকে উঠে একটু নিশ্চিন্ত ভাব আসে।
এভাবে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর শিবেনবাবু একদিন রাতে বললেন — চল ভবেশ, আজ রাতে হোটেলে খেয়ে আসি। বউ গেছে এক বন্ধুর বিয়েতে। ওখানে খেয়েদেয়ে আসবে। তুই আর আমি আজ হোটেলে খেয়ে নিই। ভবেশ ইদানীং শিবেনবাবুর বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফেরে। ভবেশ খুশি হলো। কতদিন হলো সে হোটেলে খায়নি। শেষ কবে সে হোটেলে খেয়েছিল মনে করতে পারে না। যেতে যেতে শিবেন বলেন — হোটেলে খেয়েছ কখনও ভবেশ?
— খেয়েছি। তবে সে অনেক আগের কথা। তখন ছোট। আমাদের ছোটমামা আমাকে ও ভাইকে হোটেলে নিয়ে মাছভাত খাইয়েছিল।
— ভাই? তোমার ভাই আছে? সে এখন কোথায়?
ভবেশ নিঃশব্দে আকাশ দেখায়।
— তোমার ছোট ছিল?
— আজ্ঞে।
শিবেন অতঃপর চুপ হয়ে গেলেন। ভাবলেন, থাক, কী দরকার! দুঃখ খুঁড়ে লাভ কী!
ভবেশের সুখ দুঃখের অনুভব বিলকুল নেই। কবে কখন যে ওসব গায়েব হয়ে গেছে সে বলতে পারে না। সে জানে সকাল হবে আর তাকে কাজের ধান্দায় বেরোতে হবে। ভোরের সকাল তার কাছে কোনও বিশেষ বার্তা নিয়ে আসে না, নিবিড় সন্ধ্যায় একা একাই সূর্য অস্ত যায়, সূর্যাস্তের লালিমা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভবেশ কিছুই অনুভব করে না।

শিবেনবাবু রাস্তার পাশে এক সস্তার হোটেলে বসে মাছ ভাতের অর্ডার দিলেন।
হোটেল সস্তার হলেও মাছ ভাত খেতে বেশ লাগল ভবেশের।
খাওয়াদাওয়ার পর শিবেনবাবু বললেন — সিনেমা দেখবে ভবেশ?
ভবেশ তো হাঁ।
শিবেনবাবু মানুষটা রসিক প্রকৃতির। বাইরে থেকে দেখলে তেমন বুঝা যায় না। হোটেলের ম্যাদামারা আলোয় ভবেশের মুখে এই প্রথম ভাবান্তর তার চোখে পড়ল। ভবেশ আমতা আমতা করে বলল — সিনেমা? এখন?
— হ্যাঁ। লেট নাইট।
— আমাকে নিয়ে লেট নাইট ফিলিম দেখবেন? ভালো লাগবে? বউদি হলে ভালো।
— বউদি তো আছেই। ও হবে পরে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে দেখব সেটা সেই সকাল থেকেই ভেবে রেখেছি।
ভবেশের মাথাটা গুলিয়ে যায়। সে কতকাল সিনেমা দেখে না। গান শোনে না। পথ দিয়ে চলতে চলতে শুধু কিছু গানের টুকরো টাকরা সুর কানে আসে। কিন্তু ওসব ভেতরে যায় না। মোটা মোটা দেয়াল তার সবকটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারে শক্ত ভিতে দাঁড়িয়ে। সে শিবেনবাবুর অতি সাধারণ কর্মচারী। সে কিনা মালিকের পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখবে? তাছাড়া কখন কী ভুল হবে কে জানে! ভুল হলে চাকরি খোয়াতে পারে। তখন তো আবার ঘুরে ঘুরে তাকে চাকরি খুঁজতে হবে।
সে আমতা আমতা করে — আমি নিজের ঘাড়টা তো ঠিক ধরে রাখতে পারিনা। ঘাড় সোজা রেখে সিনেমা দেখাটা ঠিক সুবিধে হবে না বাবু।
— তুমি আকাশ দেখতে পারো না?
— পারি না বাবু। উপরে তাকাতে পারি না।
তারপরও শিবেনবাবু ভবেশকে সিনেমায় নিয়ে গেলেন।
ভবেশ রঙ দেখল আওয়াজ শুনল নারী পুরুষের মুখ দেখল হাসিকান্নার আওয়াজ শুনল। আর খুব সতর্ক হয়ে থাকল। মাঝে মাঝে কাঁপতে থাকা ঘাড় ঘুরিয়ে শিবেনবাবুকে দেখল ভয়ে ভয়ে।
ভাবতে লাগল — সবটাই তো ঠিকঠাক ভাল ছিল, কিন্তু শিবেনবাবুর এই খেয়ালী মনটা না থাকলে সত্যি খুব ভালো হত। কখন কী হয় বলা যায় না। বড়দের খেয়াল আর গরীবের ঘোড়ারোগ কোনওটাই খুব সুবিধের ব্যাপার নয়।