হর্ষবর্ধনের কারবার (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
গোবর্ধনের মাথায় এখন অনেক চিন্তা। অনেক প্রশ্ন। অনেক কাজ। কিন্তু কোন কিছুই হচ্ছে না। হর্ষবর্ধন তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন একজন কাঠের কারবারিকে নিয়ে আনতে। কারণ হর্ষবর্ধন আগরতলায় কাঠের কারবার শুরু করতে চেয়েছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে আগরতলায় বাড়ি বানিয়েছিলেন। এই পরিকল্পনার কথা শুনে গোবর্ধন আগে মন্তব্য করেছিল, কোন চিন্তা নেই দাদা, আমি আছি। কথাটা তখন বলেছিল বটে, কিন্তু এখন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কত ধানে কত চাল। দাদার নির্দেশ শুনে গোবর্ধন জিজ্ঞেস করেছিল, কাঠের দোকান আছে এমন কাউকে আনলে চলবে দাদা ? তাতে হর্ষবর্ধন জবাব দিয়েছিলেন, আরে মূর্খ, কাঠের দোকানের লোক থেকে কাঠ নিয়ে কি ব্যবসা করা যাবে ? এমন লোক নিয়ে আনবি যারা ঐ কাঠের দোকানগুলিতে মাল সাপ্লাই করে।
দাদার মুখে মূর্খ কথাটি শুনে গোবর্ধন বেশ অখুশি। বলল, সেটা আমিও জানি এতে ব্যবসায় লাভ হবে না। কিন্তু ব্যবসা তো শুরু করা যাবে। ব্যবসায় প্রথম প্রথম ক্ষতি করেই শুরু করতে হয়।
শুনে হর্ষবর্ধন তো অবাক, বলিস কী, ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসা শুরু করব !
এতে গোবর্ধন সাফ জবাব দেয়, কেন ? জিও কোম্পানি তো প্রথমে ফ্রীতে ব্যবসা শুরু করেছিল বলেই তো আজ তাদের এতো উন্নতি।
— তার মানে? তুই কি ফ্রীতে কাস্টমারকে মাল দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে বলছিস ?
গোবর্ধন গোমড়া মুখে বলে, আমি কি তাই বলেছি নাকি ? আমি কি এতোই বোকা ? আমি বলেছিলাম ব্যবসায় প্রথম একটু ক্ষতি স্বীকার করেই শুরু করতে হয়।
জবাবে হর্ষবর্ধন বলেন, বুঝতে পারছি, তোর দ্বারা কিছুই হবে না। তোকে কিছুই করতে হবে না, যা করার আমিই করছি।
শুনে গোবর্ধন আরো অখুশি, বলে, ঠিক আছে। তোমার কথামত আমি তেমন লোককেই ধরে আনছি। পাঁচটা দিন আমায় সময় দাও।
সেই পাঁচটা দিনের মধ্যে দু দিন এমনিই কেটে গেল। তৃতীয় দিন গোবর্ধনের টনক নড়ল। তখন সে বাজারের এক কাঠের দোকানের সামনে গোয়েন্দার মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে লক্ষ রাখতে লাগল, মাল সাপ্লাই দেওয়া কোন লোক সেই কাঠের দোকানে ঢুকছে কিনা। সে দেখল, দোকানে কেউ কেউ ঢুকছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই লোকগুলির মধ্যে কে যে কাঠের যোগানদার তা সে বুঝতেই পারল না। চতুর্থ দিন সে দেখল কালো মত এক লোক সেই কাঠের দোকানের মালিকের সাথে হেসে হেসে কথাবার্তা বলছে। তারপর লোকটা কাঠের দোকানের মালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসছে। গোবর্ধনের আর সন্দেহ রইল না লোকটা কাঠের সাপ্লাইয়ার। গোবর্ধন লোকটির পিছু নিল। কিছুটা যাবার পর সে লোকটিকে ডাকল, এই যে দাদা, শুনতে পাচ্ছেন ?
লোকটা পেছন ফিরে বলল, আমায় ডাক্তাছেন নাকি?
— হ্যাঁ।
— বলেন কী বানাইবেন ? খাট আলমারি টেবিল ?
— আপনি কি কাঠের সাপ্লাইয়ার না ? দোকানে দোকানে কাঠ সাপ্লাই দেন না ?
— আমি কাঠমিস্তিরি। ফার্নিচার বানাই। তবে আপনার যদি কাঠ লাগে, তবে তাও দিমু। কোন্সময় কত কাঠ লাগব আমারে কন্।
লোকটাকে পেয়ে গোবর্ধন মহাখুশি। লোকটাকে বাড়িতে এনে হর্ষবর্ধনকে বলল, চারদিনের মধ্যেই কাঠের সাপ্লাইয়ারকে এনেছি দাদা।
তারপর চা-বিস্কুট খেতে খেতে লোকটার সঙ্গে হর্ষবর্ধনের বেশ আলাপ জমে উঠল। লোকটা কাঠের ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। গামাই কাঠ, শাল-সেগুন-করুই ইত্যাদি কাঠের বৈশিষ্ট্য কী, কোথায় বেশি পাওয়া যায়, বাজারের দোকানে প্রতিটি কাঠের কী রেট চলছে — সমস্ত কিছু গড়গড় করে বলে গেল। হর্ষবর্ধনও বেশ খুশি — এত দিনে গোবর্ধন সঠিক লোককে ধরে এনেছে।
হর্ষবর্ধন লোকটিকে বললেন, আমি প্রথমে একটা কাঠের দোকান খুলব, তারপর ফার্নিচার তৈরি করে আসবাবপত্রের ব্যবসাও করব। আপনাকে আমার দরকার। আচ্ছা বলুন তো আপনি আগে কোথায় কোথায় কাঠ সাপ্লাই করেছেন ?
লোকটা বলল, আইজ্ঞে আমি আসলে কাঠমিস্তিরি। আপনে যদি কন্, কাঠের সাপ্লাই দিতে আমি দিমু অনেক কম দামে। সব আমার জানাই আছে।
হর্ষবর্ধন জিজ্ঞেস করেন, কত কমে দেওয়া যাবে ?
— তা ধরেন, বাজারের দোকানের রেইট থাইক্যা অর্ধেক কম দামে।
— বাঃ বাঃ। বেশ ভাল।
হর্ষবর্ধন লাভের অঙ্ক মনে মনে কষতে থাকেন। দাদার অবস্থা দেখে গোবর্ধন বিজয়ীর হাসি হাসে। কথাবার্তায় ঠিক হয় প্রথমে এক ট্রাক গামাই, করুই এবং সেগুন কাঠের বিভিন্ন সাইজের ফাইল কেনা হবে। ট্রাকের মাল এই বাড়িতেই রাখা হবে, পরে কোনো দোকান ভাড়া করে দোকানে কাঠের স্যাম্পল রাখা হবে। তবে কাঠের গুদামঘর বাড়িতেই করা হবে। লোকটা বলল, হাজার দশেক টাকা অ্যাডভান্স লাগব।
হর্ষবর্ধনের কাছে দশ হাজার টাকা নগদ ছিল না, তাই বললেন, ব্যাঙ্ক থেকে তুলতে হবে। আগামীকাল দেবো।
গোবর্ধন বলে উঠল, আমার কাছে নগদ দেড় হাজার টাকা আছে।
লোকটা বলল, আজকে তাই দ্যান। কালকে বাকি টাকা দিয়েন। গোবর্ধন তাড়াতাড়ি উঠে দেড় হাজার টাকা এনে লোকটার হাতে তুলে দেয়।
ফিরে যাবার সময় লোকটি হর্ষবর্ধনকে বলল, তবে দাদা, মালগুলির ডেলিভারি রাইত এগারোটার পরে হইব।
শুনে হর্ষবর্ধন একটু অবাক, রাতে ডেলিভারি ! দিনে কেন হবে না ?
লোকটা হেসে বলল, আরে দাদা, চালানের মাল, দিনে একটু পুলিশের ঝামেলা আছে। তবে আপনার কুনু চিন্তা নাই। আমি আপনের বাড়িতে মাল পৌঁছাইয়া দিয়াই টাকা নিমু।
দিনে পুলিশের ঝামেলা শুনে হর্ষবর্ধন বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা ভাই, আপনার ফোন নাম্বারটা আমাকে একটু বলুন।
লোকটা বলল, আইজ্ঞে আমার ফোন নাম্বার মনে থাকে না। আপনার নাম্বারটা কন্, আমি আপনারে ফোন করতাছি।
হর্ষবর্ধনের ফোন নাম্বার আবার গোবর্ধনের মুখস্ত, তাই সে টপাটপ নাম্বারটা বলে দিল। লোকটা সেই নাম্বারে ফোন করে বলল, রিং হইতাছে। আমার নাম্বারটা সেইভ কইরা নিয়েন।
লোকটা চলে গেলে হর্ষবর্ধন তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, আমার ফোনটা ঘরের ভেতর থেকে নিয়ে আয় গোব্রা।
গোবর্ধন দৌড়ে ফোনটা নিয়ে এসে দাদার হাতে তুলে দিল। হর্ষবর্ধন ফোনের মিস কল থেকে লোকটার ফোন নাম্বারে ফোন করে লোকটাকে বললেন, ভাই, আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, কোলকাতায় চিকিৎসার জন্যে যাবো। তাই আপাতত আমি কাঠের ব্যবসায় যাচ্ছি না। দরকার হলে আপনাকে ফোন করব।
কথাগুলি শুনে গোবর্ধন আকাশ থেকে পড়ল, তাহলে তুমি কাঠের কারবারে যাচ্ছ না তাহলে ?
— কেন ? তুমি কি চাও পুলিশের ঝামেলায় আমি জেলে যাই ?
— কিন্তু কিন্তু আমার দেড় হাজার টাকা।
— ফেরত নিয়ে এসো।
— দেবে কি ? বলেই গোবর্ধন লোকটার উদ্দেশ্যে ছুটে বেরিয়ে গেল।