লালাবাড়ির বোবাকান্না – সুদীপ ঘোষাল

লালাবাড়ির বোবাকান্না  (ছোটদের গল্প)

সুদীপ ঘোষাল

গোয়েন্দা সুমন ও সহকারী তোতন এবার পশ্চিমে পাড়ি দিলেন। সুমনদা তোতনকে বলেন, বেড়াতে যাওয়ার আগে পড়তে হয়, জানতে হয় অঞ্চলটির সম্বন্ধে কিছু কথা।
তিনি বলতে থাকেন, “ছোটনাগপুর মালভূমি ভারতীয় উপদ্বীপীয় মালভূমির অন্তর্গত। প্রায় সমগ্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই মালভূমি গঠিত। কর্কটক্রান্তি রেখা ছোটনাগপুর মালভূমির প্রায় মধ্যভাগ দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদনদী, কৃষিকাজ, খনিজ সম্পদ প্রভৃতি বিভিন্ন দিক দিয়ে নানা রূপ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে ছোটনাগপুর মালভূমির বৈশিষ্ট্য গুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –
“বহু বছর ধরে বিভিন্ন নদী দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছোটনাগপুর মালভূমি বর্তমানে ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে অর্থাৎ এটি একটি ব্যবচ্ছিন্ন মালভূমি। উপদ্বীপীয় মালভূমি রংস ছোটনাগপুর মালভূমি মূলত আর্কিয়ান যুগের গ্রানাইট ও নিস শিলা দ্বারা গঠিত। ভূ-প্রাকৃতিক তারতম্য অনুসারে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলকে রাঁচি মালভূমি, হাজারীবাগ মালভূমি, কোডার্মা মালভূমি, বাগমুন্ডি উচ্চভূমি, রাজমহল পাহাড় প্রভৃতি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। হাজারীবাগ মালভূমিতে অবস্থিত পরেশনাথ পাহাড় ছোটনাগপুর মালভূমির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সমগ্র অঞ্চলটি পশ্চিম থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বে ঢালু।
“ছোটনাগপুর অঞ্চলের প্রধান নদী হল দামোদর সুবর্ণরেখা। এছাড়া এ অঞ্চলে প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অজয়, ময়ূরাক্ষী, বরাকর প্রভৃতি। ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের মাটি তেমন একটা উর্বর নয়। এখানকার অধিকাংশ অঞ্চলে ল্যাটেরাইট ও লোহিত মাটির প্রাধান্য দেখা যায়। এখানে মৌসুমী পর্ণমোচী উদ্ভিদের প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন – শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, সেগুন প্রভৃতি। প্রায় সব ধরনের ধাতব খনিজ সম্পদ যেমন কয়লা, আকরিক লোহা, তামা, বক্সাইট, চুনাপাথর, ইউরেনিয়াম প্রভৃতি এ অঞ্চলে পাওয়া যায় বলে, ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল কে ভারতের খনিজ ভাণ্ডার বলা হয়।”
তোতন বলে, রাঢ় অঞ্চল বলতে কোন অঞ্চলকে বোঝায় দাদা?
সুমনদা বলেন, পশ্চিমের মালভূমি থেকে কাঁকুড়ে পলিমাটি বয়ে এনে এই অঞ্চলের নদীগুলি এই সমভূমি সৃষ্টি করেছে। যদিও সঠিক অর্থে সমতলভূমি নয় রাঢ় অঞ্চল। স্থানে স্থানে ঢেউখেলানো অসমতম ভূমি ও টিলা এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পুরনো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলে ল্যাটেরাইট লাল মাটির প্রাধান্যই বেশি। মাটির স্তর এখানে অগভীর। মাটির জলধারণ ক্ষমতা কম।
তোতন বলে, ভূগোলে পড়েছি, সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় রাঢ় অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উত্তর রাঢ়ের তুলনায় দক্ষিণ রাঢ়ে বেশি। এপ্রিল-মে মাস নাগাদ কালবৈশাখী ও অক্টোবরে আশ্বিনের ঝড়ও এই অঞ্চলের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সুমন ও তোতন ট্রেনে উঠে দেখে এক রোগা পাতলা লোকের কোলে একটি বছর দশের কন্যা কাঁদছে। সুমনদা ও তোতন ব্যাগ রেখে জানালার পাশে বসলেন। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যায় পাহাড় আর বনের সৌন্দর্য। ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ সুন্দর।

সুমনদা হোটেল থেকে বেড়িয়ে পরের দিন হাঁটতে বেড়িয়ে দেখেন, ট্রেনের সেই রোগা লোকটা আর পাঁচজন মেয়েকে নিয়ে হনহনিয়ে চলেছে। সুমনদা ও তোতন ওদের সঙ্গ নিলেন হাঁটার ছলে। একসময় একটা লাল বাড়িতে রোগা লোকটা ঢুকে পড়ল।
সুমনদা বললেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। নজর রাখনা পরেগা।

তোতন পরেরদিন খবরের কাগজ পড়ে চিৎকার করে সুমনদাকে ডেকে বলল, এই দেখো দাদা, হেডিং এ লেখা দশজন বালিকা নিঁখোজ।

গিরিডি শহরে এসে থানায় পরিচিতি পর্ব সেরে এসে সুমনদা তোতনের কাছে বসলেন।
তোতন কফি নিয়ে এল দু কাপ, সেও বসল পাশের চেয়ারে। তোতন জিজ্ঞেস করল, ঝাড়খণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাস কিছু বলো সুমনদা।
সুমনদা শুরু করলেন ইতিহাস। তিনি বললেন, কেন্দ্রীয় সরকার 1989 সালে ঝাড়খণ্ড বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এটি এলাকার জন্য উন্নয়ন তহবিলের বৃহত্তর বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। এটি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
তোতন বলে, ইতিহাসে পড়েছি, মনে পড়ছে আমার, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা আরও প্রতিনিধিত্ব চেয়েছিল এবং অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এর বিরুদ্ধে ছিল। মতপার্থক্যের কারণে এই দলগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আন্দোলনে সহিংসতার উপাদান প্রবর্তন করে এবং নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় যখন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এর বিরোধিতা করে। ঝাড়খণ্ড এরিয়া স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিল বিল 1994 সালের ডিসেম্বরে বিহারের বিধানসভায় পাস হয়। ঝাড়খণ্ড এরিয়া স্বায়ত্তশাসিত কাউন্সিলকে কৃষি, গ্রামীণ স্বাস্থ্য, জনসাধারণের কাজ, জনস্বাস্থ্য এবং খনিজ সহ চল্লিশটি ক্ষেত্রে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
তোতন বলল, শুধু রাজনীতি করে কিছু হবে না। তার সঙ্গে মানব সম্পদ উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে।
সুমনদা বলেন, দারিদ্র্য এখনও শিকড় গেড়ে বসে আছে। এদেশ থেকে অভাব মুছে নতুন ভোর আসবে, দেখবি তোতন, একদিন আমরা পারবই।

খবরের কাগজের খবর পড়ে সুমনদা লালবাড়িটার উপর নজর রাখতে শুরু করলেন। হাঁটাপথে ওদিকে যান আর দেখেন লালবাড়িটার বোবা কান্না। কেমন বর্ষার মেঘের মত গুমরে মরছে বাড়ির আশপাশ। কেউ যায় না। একদিন তিনি দেখলেন ট্রেনে দেখা সেই রোগা লোকটা লালবাড়ি থেকে বেড়িয়ে সুমনদাকে দেখে আবার ঢুকে পড়ল। প্রায় দশমিনিট তোতন আর সুমনদা লুকিয়ে থাকলেন। তারপর দেখলেন, লোকটা হিন্দি ভাষায় বলছে, এ হি আদমি হামকো ট্রেন মে মিলা থা। এ খতরনাক লোক নেহি তো ভাইয়া।
ভাইয়া বলল, চল্ আজ উসে খতম কর দেতে হ্যায়। এ খতরনাক ভি হো সেকতা হ্যায়।
ওরা এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা শব্দ শুনে দুজনকে তাড়া করে। দু দুটো গুলিও ছোঁড়ে। কিন্তু সুমনদা ও তোতন আত্মরক্ষা করতে জানেন। তারা পাশ কাটিয়ে হোটেলে ফেরেন।

সুমনদার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে ওরাই দোষী নারী পাচারচক্রের সদস্য। কিন্তু মেয়েদের বাঁচানোর জন্য আর অপেক্ষা করব না, বললেন সুমনদা। এবার ওদের হাতেনাতে ধরব।
সুমনদা রাতে বললেন, গিরিডি এই রাজ্যের গিরিডি জেলার সদর দফতর। গিরিডির আক্ষরিক অর্থ পাহাড় এবং পাহাড়ের জমি – গিরি, একটি হিন্দি শব্দ, এর অর্থ পাহাড় এবং ডিহ, স্থানীয় একটি শব্দ, এর ভূমি নির্দেশ করে। ১৯৭২ সালের আগে, গিরিডি হাজারীবাগ জেলার অংশ ছিল।

তোতন বলল, জানালায় একজন লোকের ছায়া দেখলাম। সুমনদা রিভলবার হাতে ছুটলেন নিচে। থানায় ফোন করল তোতন। লালাবাড়ির কাছে গিয়ে গেট খুলে সুমনদা ভেতরে ঢুকলেন। তোতন সঙ্গে আছে ছায়ার মত। এ ঘরে দেখলেন দশ বারোজন বালিকা বসে আছে। তাদের হাত পা বাঁধা। তোতনকে ধরে ফেলেছে রোগা লোকটা। তোতন একটা ঘুসি মারতেই লোকটা পড়ে গেলো ধপাস করে। সুমনদাকে পাঁচজন লোক ধরে ফেলেছে। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে গেছে। সকলকে হাতেনাতে ধরে বালিকাদের মুক্ত করে আই সি বললেন, বহুত সুক্রিয়া আপকো সুমনদা। ম্যায় ভি আপকা ফ্যান হুঁ।

পরেরদিন আই সি সুমনদা ও তোতনকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। আই সি বললেন, দেখিয়ে আপকো পাহাড় দেখনে ইঁহা লে আয়া হ্যায়। তারপর তিনি যা বললেন বাংলায় তর্জমা করলে যা হয় তাহল এই —
সুমনদা এই হলো, অযোধ্যা পাহাড়। বর্ষা ছাড়াও শীতকালে বেড়াতে যাওয়ার জন্য অন্যতম পর্যটনস্থল। সবুজ গাছপালায় ভরা পাহাড়, জঙ্গল, পাহাড়ের পাদদেশ, নদী এবং লেক সবই রয়েছে এখানে। উইকেন্ড কেন, ৩-৪ দিনের ছুটি কাটানোর জন্য দুর্দান্ত জায়গা। অযোধ্যা পাহাড় ছোট নাগপুর মালভূমির অন্তর্গত। কলকাতা থেকে দূরত্ব ৩৩২ কিলোমিটার। শহরের কোলাহল থেকে দূরে সবুজের মাঝে আপনি মন চাইলেই হারিয়ে যেতে পারেন শান্ত পরিবেশে। পশ্চিমে রয়েছে সুবর্ণরেখা নদী আর উত্তরে রয়েছে কংসাবতী ও কুমারী নদী। আপনি যদি ট্রেকিং ভালোবাসেন, তাহলে আপনার জন্য অযোধ্যা পাহাড় ভালো টুরিস্ট ডেস্টিনেশন হতে পারে। পর্বোত আরোহণ শেখার জন্য অযোধ্যা পাহাড়ের আলাদা গুরুত্ব আছে। অযোধ্যা পাড়ে আসার উদ্দেশ্যে মূলত তিনটি পথ ব্যবহার করা হয় – শিরকাবাদ, ঝালদা এবং বাগমুণ্ডি। পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসার জন্য দারুণ জায়গা। প্রকৃতির মাঝে আপনার সব টেনশন দূর হয়ে যাবে।