স্বামী বিবেকানন্দ এক দার্শনিক ও সন্ন্যাসীর মেলবন্ধন – সুদীপ ঘোষাল

স্বামী বিবেকানন্দ এক দার্শনিক ও সন্ন্যাসীর মেলবন্ধন

সুদীপ ঘোষাল

প্রথম পর্ব

নরেন বা বিলে, উত্তর কলকাতার এক দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দত্ত-পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত দত্ত-ডেরিয়াটোনা বা দত্ত-ডেরেটোনা গ্রাম। দত্তরা উক্ত গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। গবেষকরা অনুমান করেন যে তারাই ছিলেন ওই গ্রামের জমিদার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দত্ত-পরিবারের সদস্য রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন দত্ত ও পৌত্র রামসুন্দর দত্তকে নিয়ে গ্রামে আসেন। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু হলে উক্ত এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে দত্তরাও সুতানুটি গ্রামে চলে আসেন। এখানে প্রথমে তারা মধু রায়ের গলিতে একটি বাড়িতে বাস করতেন। ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটের যে বাড়িতে বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই বাড়িটি নির্মাণ করেন রামসুন্দর দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামমোহন দত্ত। রামমোহন দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গাপ্রসাদ দত্ত ছিলেন বিবেকানন্দের পিতামহ। তিনি সব ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। ২৫ বছর বয়সে একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথ দত্তের জন্মের পর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। বিশ্বনাথ দত্ত দুর্গাপ্রসাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কালীপ্রসাদ কর্তৃক প্রতিপালিত হয়েছিলেন। দেওয়ান-ই-হাফিজ ছিল তার প্রিয় বই। তিনি সুলোচনা ও শিষ্টাচার-পদ্ধতি নামে দুইটি বই রচনা করেছিলেন। বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের সমর্থনে তিনি প্রকাশ্যে মতপ্রকাশ করেছিলেন। দুর্গাপ্রসাদের সংসারত্যাগের পর কালীপ্রসাদের অমিতব্যয়িতায় দত্ত-পরিবারের আর্থিক সাচ্ছল্য নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অ্যাটর্নিরূপে বিশ্বনাথ দত্তের সুদূর-প্রসারিত খ্যাতি সেই সাচ্ছল্য কিয়দংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। তার স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন সিমলার নন্দলাল বসুর মেয়ে। তিনি বিশেষ ভক্তিমতী নারী ছিলেন। তার প্রথম কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু ও কন্যাসন্তানের জন্মের পর পুত্রসন্তান কামনায় তিনি তার এক কাশীবাসিনী আত্মীয়াকে দিয়ে, শিবের নিত্য পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা করান। এরপরই স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হওয়ায় তার বিশ্বাস হয় যে, তিনি শিবের কৃপায় পুত্রলাভ করেছেন। পিতার প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মায়ের ধর্মপ্রাণতা বিবেকানন্দের চিন্তা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। সাহিত্য, ইতিহাস ও ধর্মগ্রন্থ পাঠে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ধর্ম বিষয়ে তিনি উদার ছিলেন।বিবেকানন্দের প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল বীরেশ্বর, সংক্ষেপে বিলে। তার পোশাকি নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ। ছোটবেলায় নরেন ছিলেন খুব জেদি ও দুরন্ত মনের, তিনি যা মনে করতেন তাই করতেন। মাঝে মধ্যে খেলায় সে সন্ন্যাসী সাঁজতো আর তার মা কে গিয়ে বলতেন, দেখো মা আমি কেমন শিব সেজেছি। ছোটবেলা থেকে স্বামীজী আধ্যাত্মিক দিক আগ্রহ ফুটে উঠে। তিনি ছোটবেলা থেকেই রামসীতার এবং শিবের মূর্তি পূজা করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ পূজা করতে করতে ধ্যান মগ্ন হয়ে যেতেন।
নরেনের বন্ধু একদিন বলে তার মাকে, নরেন হলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। নরেন শিবঠাকুরের পুজো করত আর বন্ধুরা প্রসাদ পাওয়ার আশায় বসে থাকত। গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম নরেনের নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। বন্ধুর মা বললেন, নরেন খুব ভাল ছেলে। ওর সঙ্গে খেলবি, কিছু শিখতে পারবি।
নরেন বন্ধুর বাড়ি এসে বললেন, চল বটতলায় যাই। তার বন্ধু বলল, বটতলায় যেতে গা ছমছম করে।কোনোবন্ধুই ভয়ে সেদিন বটতলায় গেল না। বন্ধুরা কোন লোকের মুখে শুনেছে, গাছে ভূত আছে।
নরেন একা একা চলে গেলেন গাছতলায়। বন্ধুরা খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখল ভূতথাকা গাছটায় নরেন বাদুড়ের মত ঝুলছে। তাকে দেখে অন্য বন্ধুদের সাহস বেড়ে গেল। নরেন, ছোটোবেলা থেকেই নিজের বন্ধুদের নিয়ে দলগঠন করেছিলেন। বন্ধুরা নরেনকে দলের নেতা বলে মেনে নিয়েছিল, তার সাহস, বুদ্ধি ও উদার হৃদয় তাঁকে নেতা হতে সাহায্য করেছিল। ছোটবেলা থেকে নরেন ছিল শিবের ভক্ত, তিনি শিবের পুজো এবং শিবের সামনে বসে ধ্যান করতে ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে নরেন এবং তার বন্ধুরা ধ্যান ধ্যান খেলতো। একদিন সেই রকম ধ্যান ধ্যান খেলতে খেলতে একটি সাপ এসে হাজির হয়, এই দেখে তার বন্ধুরা পালিয়ে যায় আর নরেনকে উঠতে বললে নরেন ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর সাপটি নরেনকে কিছু না করে অদৃশ্য হয়। পরে নরেনের ধ্যানভঙ্গ হলে নরেন বলেছিল যে তিনি তার বন্ধুদের ডাক বুঝতে পারেনি বরং তার মনে হচ্ছিল যে সে নাকি এক অন্য জগতের বাসিন্দা হতে গিয়েছে, যেখানে আনন্দের ঢেউ। স্বামীজীর ছোটবেলার ওপর আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাই, ধ্যানপরায়ণতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, কর্মপ্রিয়তা, পরোপকার ইত্যাদি ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর চরিত্রের মধ্যে বীজের আকারে নিহিত ছিল। পরবর্তীকালে তাদের সম্যক বিকাশ ঘটে যায়। তাঁর শিক্ষা তার মা এর কাছে থেকে শুরু হয়। তার মা তাকে সর্বপ্রথম বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার বর্ণমালাগুলির শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া তার মা তাকে রামায়ণ এবং মহাভারতের বিভিন্ন গল্প বলতেন যা স্বামীজী খুবই মনোযোগ সহকারে শুনতেন।
এরপর ছ বছর বয়সে নরেনকে স্থানীয় এক পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। এরপর পাঠশালা থেকে তাকে স্কুলে নিয়ে আসা হয়। নিযুক্ত করা হয় এক গৃহশিক্ষক। নরেন পড়াশোনা করতে ভালোবাসেন, এর পাশাপাশি ছেলেমানুষি দুষ্টুমিতে ছিলেন সবার সেরা। ছোটবেলা থেকেই ছিল তার দারুণ স্মরণশক্তি। ছোটবেলা থেকেই স্বামীজীর মধ্যে নেতৃত্ব ভাবের জাগরণ ঘটে গিয়েছিল। তার সমস্ত বন্ধুরা তাকে তার নেতা বলে মনে করত কারণ সে তার সমস্ত বন্ধুকে সমান ভাবে দেখতো, কখনো কাউকে ছোট করত না। এছাড়া ছোট থেকে তার মন ছিল উদার সহানুভূতিসম্পন্ন। শিক্ষক মহাশয় যখন ক্লাস পড়াতেন, তখন স্বামীজি ধ্যানমগ্ন হয় শিক্ষকের পড়া শুনতেন, এই দেখে শিক্ষক মাহাশয় মনে করেন যে স্বামীজি ক্লাসে ঘুমাচ্ছে। এই দেখে তার শিক্ষক ভীষণ রেগে যান, তখন স্বামীজিকে পড়া ধরলে স্বামীজি শিক্ষক মহাশয়ের সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে থাকে, এই দেখে শিক্ষক খুব খুশি হন।
একবার অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে জমে যাওয়া জলের বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন বন্ধু দলের নেতা নরেন। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ নরেনের হাতে জড়িয়ে ধরেছে। নরেন এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে তাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা নরেনের ছিলো। সে সামনে আর বন্ধুরা চলেছে তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেল স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। নরেন সকল বন্ধুদের নিজের টিফিন বের করে দিতে বলল। বন্ধুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিল। তারপর সে বলল, এসো সবাই এক হয়ে না খেয়ে গরীবদের খাবার বিলিয়ে দিই। নরেন আগেই সকলকে বলে রেখেছিল, একটা করে মা, মাসির কাপড় নিয়ে আসবি ফুটপাতের গরীব মানুষের জন্য।

পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। নরেন কল্পনায় কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। বন্ধুরা ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেল। সেখানে দেখে নরেন হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। দিনের বেলা, এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা মনদেশ ছাড়িয়ে চলে গেছে অভাবী বাতাসে। পুজো বাড়িতে বন্ধুদের দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো। বন্ধুরা জানে, সে এখন চাল, ডাল নিয়ে গরীব বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। নরেন বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? আমি ওকে কতটুকু দিতে পারি।

পরবর্তীতে তিনি ১৮৭১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্থাপিত বিদ্যাসাগর ইনস্টিটিউট এ তার পড়াশোনা শুরু হয়, সেখানে নরেন প্রতি বছর প্রথম স্থান অধিকার করতেন। সেখানে পড়াশোনা চলাকালীন তার পিতার কর্মসুত্রে নরেনকে তার পরিবার সহ মধভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়পুর এ স্থানান্তর করেন। কয়েক বছর পর তারা কলকাতায় ফিরে আসেন, এবং ১৮৭৯ সালে ষোলো বছর বয়সে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি তার স্কুলের পড়াশোনার সাথে সাথে ছোট থেকেই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, দর্শন, বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি পড়ার সাথে সাথে খেলাধুলা ও সামাজিক কাজকর্মে বিশেষ ভাবে অংশগ্রহন করতেন।

দ্বিতীয় পর্ব

পিতার চাকরিসূত্রে বিলের জীবন কেটেছে নানা জায়গায়। তাঁর দলগঠনের ক্ষমতার সঙ্গে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে মনের জোর বাড়িয়ে দিল এক অদৃশ্য শক্তি।
শিক্ষার পরে তিনি এবার চাকরির সন্ধান করতে শুরু করলেন। বাবার মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হয়। কারণ পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বভার তখন তাঁর কাঁধে এসে পড়ে | তিনি তাঁর পরিবারের আর্থিক সহায়তার জন্য মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন কিছুদিনের জন্য। এত কাজের মধ্যেও তিনি শরীরচর্চা করতেন নিয়মিত। একদিন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করে বসেন, আপনি ঈশ্বর দেখেছেন কোনদিন। মহর্ষি এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। বেকারজীবনেও তাঁর বন্ধুবান্ধব অনেক ছিল। তাঁর বন্ধু বলেছিলেন, তুই আমাদের মত সাধারণ মানুষ নস। তোর গতিপথ আলাদা। বিলে বলতেন, আমি তোদের মত সাধারণ জীবনযাপনে খুশি নই। আমি মিথ্যে ভাঁওতা না, সত্যিকারের মানুষ চাই। দশটা ভাল মানুষ, সমগ্র দেশ শুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। তাঁর বন্ধুরা তাঁর সংস্পর্শে থাকলে খুশি হত। ঘনিষ্ঠদের কাছে একবার স্বামীজি বর্ণনা করেছিলেন ১৮৮১ সালের সেই যুগান্তকারী ঘটনা। যে সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসেন বিবেকানন্দ। বাংলার বুকে তখন নবজাগরণের এক দৃপ্ত মশাল জ্বলতে শুরু করেছে সবে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির আধ্যাত্ম চেতনাতেও তখন যুক্তিবাদ জায়গা করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। আর সেই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ স্বামীজির। তিনি রামকৃষ্ণদেবকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনি ভগবান দেখেছেন? স্বামীজির উত্তরে ইতিবাচক জবাব দিয়ে বলেছিলেন সেদিন, ‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেই রূপে দেখি। বরং আরও স্পষ্টতর আরও উজ্জ্বল রূপে দেখি।’ শ্রীরামকৃষ্ণের এই বক্তব্যই পাল্টে দেয় স্বামীদির আধ্যাত্ম চেতনা। পাল্টে যায় স্বামীজির জীবনদর্শন। বাংলা যখন এক অগ্নিগর্ভ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সেই সময় এগিয়ে চলেছে, তখন দেশকে উদ্বুদ্ধ করার আরও একটি অধ্যায় উঠে আসতে শুরু করল স্বামীজির হাত ধরে। যে স্বামীজি মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ নির্বিষেশে খুঁজে পেতে লাগলেন ঈশ্বরকে।

তৃতীয় পর্ব

স্বামী বিবেকানন্দের যে শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেছেন সেই শিক্ষার মূল ভিত্তি হবে ধর্ম এবং সেই ধর্মে বৈজ্ঞানিক অনুশীলন থাকবে, থাকবে তাত্ত্বিক ভাবনা।
মানবজীবনের সমস্ত স্তর বা অবস্থার সাথে শিক্ষা কীভাবে যুক্ত থাকতে পারে, সে প্রসঙ্গে তিনি তাঁর নিজস্ব মতবাদ বারবার ব্যক্ত করেছেন। পাশ্চাত্য বিভিন্ন দেশে গিয়ে তিনি শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক আয়োজন প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাকে নিজের দেশে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলা হয়, সেই সময়কালে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা সম্পর্কে যা চিন্তা ভাবনা করেছিলেন তা সমকালীন খুব কম মনীষী সেইভাবে শিক্ষা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ তার বিভিন্ন গ্রন্থ ও তার ভাষণের মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কিরূপ হওয়া উচিত এবং কেমন শিক্ষা মানব কল্যাণের জন্য গ্রহণ করা উচিত সেই প্রসঙ্গে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেই সময় তিনি বলছেন শিক্ষা সবার অধিকার এবং ভারতের সমগ্র মানুষের কাছে শিক্ষা পৌছিয়ে দিতে হবে।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিক্ষাচিন্তায় দুই ধরনের শিক্ষার কথা তুলে ধরেছেন। নেতিমূলক শিক্ষা ও দ্বিতীয়টি হলো ইতিবাচক শিক্ষা।
নেতিমূলক শিক্ষা – তখনকার দিনে ব্রিটিশ ভারতে আমাদের বিদ্যালয়গুলিতে যে শিক্ষা ব্যবস্থার পদ্ধতি চালু ছিল স্বামীজী তাকে একেবারে নেতিবাচক শিক্ষা বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নেতিমূলক শিক্ষা কোনো উন্নতি করে না এবং চরিত্র গঠনে জন্য উপযোগী নই। এই শিক্ষা মানুষে মানুষে বিভাজন রেখার জন্ম দেয়। একদল এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অন্য দলের ওপর প্রভুত্ব করার অধিকার অর্জন করে।
ইতিবাচক শিক্ষা – ইতিবাচক শিক্ষা বলতে স্বামীজী যা বলেছেন – “আমরা সেই শিক্ষা চাই, যার দ্বারা চরিত্র গঠিত হয়। মনের জোর বাড়ে, বুদ্ধি বিকশিত হয় এবং মানুষ নিজে সম্ভল হতে পারে। মানুষ গঠন করাই সমস্ত শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। স্বভাব অনুযায়ী মানুষকে বর্ধিত হতে দেওয়াই শিক্ষার লক্ষ্য যার দ্বারা ইচ্ছা শক্তি বিকশিত, বর্ধিত এবং সৎভাবে চালিত হয়, তাই শিক্ষা।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখ থাকা দরকার। শিক্ষা শুধু টাকা রোজগারের পন্থা হবে না, শিক্ষা আমাদের বিকশিত করবে। আমরা আরও আত্মানুসন্ধানী হয়ে উঠব। পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের মনে ঔৎসুক্য জাগবে।
স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাদর্শন আলোচনায় তিনি আসল উদ্দেশ্য কি হওয়া দরকার সেই প্রসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। স্বামীজির মতে শিক্ষার লক্ষ্য কি হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে নিম্নে আলোচনা করা হলো –
(১) আবিষ্কার (২) স্বাধীনতা এবং (৩) আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস

আবিষ্কার – আমরা কী এবং কাকে আবিষ্কার করি? আমরা আবিষ্কার করি নিজের সাহস এবং শক্তিকে। এই পৃথিবীর সকল মানুষই যে বিশ্ববিধাতার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, সেই বিষয়টি আবিষ্কার করতে হয়। যখন আমাদের মধ্যে সত্যি সত্যি উপলব্ধি জাগ্রত হয়, তখন আমরা পাহাড়ের মতো উঁচু এবং বাতাসের মতো গতিবান হয়ে উঠি।

স্বাধীনতা – শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল স্বাধীনতা। কীসের স্বাধীনতা? চিন্তার স্বাধীনতা ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা। স্বাধীনতাই শিক্ষার আসল বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা মানুষকে স্বাধীনচেতা করে তোলে। মানুষ মানসিক, দৈহিক, বৌদ্ধিক, আত্মিক, আধ্যাত্মিক দিক থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে।

আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস – শিক্ষার তৃতীয় বিষয় হল আত্মপ্রত্যয়। শিক্ষিত মানুষ সবসময় আত্মপ্রত্যয়ী হয়। এই আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস আমাদের জন্য খুব দরকারি, আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস না থাকলে কোনো মানুষ জীবনে সফল হতে পারে না।

চতুর্থ পর্ব

নরেনের চোখের সামনে ভেসে উঠল আর এক মহাপুরুষের জীবনের অন্তিম সময়ের ছবি। কুশীনগরের এক শালবনে ভগবান বুদ্ধ ডানপাশ ফিরে শুয়ে আছেন — মহানির্বাণের প্রতীক্ষায়। হঠাৎ একজন ছুটে এল তাঁর কাছে, সে উপদেশ চায়। শিষ্যরা সেই লোকটিকে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আচার্যের শান্তি যেন বিঘ্নিত না হয়। কিন্তু বুদ্ধ তাঁদের কথাবার্তা শুনতে পেলেন, বললেন না, না, ওকে আসতে দাও। তথাগত সদা প্রস্তুত! তারপর কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে একটু উঠে তাকে উপদেশ দিলেন। এমন ঘটনা ঘটল পরপর চারবার। তারপর বুদ্ধ প্রস্তুত হলেন নির্বাণের জন্য। হ্যাঁ, এবার তিনি মুক্ত। বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের এই পর্বটি যেন আবার অভিনীত হল প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। পরবর্তী কালে স্বামী বিবেকানন্দ ভগবান বুদ্ধের অসাধারণ ত্যাগ ও স্বার্থশূন্যতার প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের শেষদিনের এই ঘটনাটি বলেছিলেন নিবেদিতা ও অন্যান্য অন্তরঙ্গ শিষ্যদের কাছে।
স্বামীজীর কাছে বুদ্ধ ছিলেন জগতের ইতিহাসের ‘মহত্তম চরিত্র’, কর্মযোগের আদর্শের মূর্ত বিগ্রহ “বুদ্ধ ব্যতীত জগতের অন্যান্য মহাপুরুষগণের সকলেই বাহ্য প্রেরণার বশে নিঃস্বার্থ কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন।… মহাপুরুষগণের মধ্যে একমাত্র বুদ্ধই বলিয়াছিলেন, ‘আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমাদের ভিন্ন ভিন্ন মত শুনিতে চাই না। আত্মা সম্বন্ধে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মতবাদ বিচার করিয়াই কি হইবে? ভাল হও এবং ভাল কাজ কর। ইহাই তোমাদের মুক্তি দিবে, এবং সত্য যাহাই হউক না, সেই সত্যে লইয়া যাইবে। সাধারণ মানুষের কাছে এর চেয়ে সরল উপদেশ আর কী হতে পারে?’